AkramNadwi

কিভাবে ইসলামী চিন্তাধারার অধ্যয়ন করা উচিত? ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5868
بسم الله الرحمن الرحيم.


——————–

|| প্রশ্ন :

একজন সম্মানিত আলিম ও শিক্ষক (যিনি কোনো কারণে নিজের নাম প্রকাশ করতে চান না) প্রশ্ন করেছেন:
“মাওলানা! আপনি ইসলামী চিন্তাধারার অধ্যয়নের ওপর গুরুত্ব দেন। দয়া করে বলুন, ইসলামী চিন্তাধারা কী? এবং কীভাবে এর অধ্যয়ন করা উচিত?”

উত্তর:

আপনার এই প্রশ্ন আপনার চিন্তার স্বচ্ছতা ও বুদ্ধির প্রগাঢ়তার প্রমাণ। সমস্ত উপকারী জ্ঞানের লক্ষ্য ইতিবাচক হয়ে থাকে—অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী এ জ্ঞান অর্জন করে যাতে সে সত্যে পৌঁছাতে পারে, নিজে উপকৃত হতে পারে এবং অন্যদেরও উপকৃত করতে পারে। এর বিপরীতে, ক্ষতিকারক জ্ঞানের মূল লক্ষ্য নেতিবাচক হয়; এগুলো সাধারণত অন্যদের ক্ষতি করার জন্য অর্জন করা হয়, যেমন জাদু ও তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ। একই শ্রেণিতে তর্ক-বিতর্ক, বাদানুবাদ এবং প্রত্যাখ্যানমূলক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত।

সংজ্ঞা:

চিন্তা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া, যা যুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কোনো বিষয় তখনই চিন্তা হিসেবে বিবেচিত হবে, যখন তা যুক্তির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হবে। ইসলামী চিন্তাধারার অর্থ হলো বুদ্ধিবৃত্তিক নীতির আলোকে ঈমান, ইসলাম, ইবাদত, সমাজব্যবস্থা, লেনদেন, সভ্যতা, নৈতিকতা এবং ইতিহাস ইত্যাদির ব্যাখ্যা করা। যুক্তির ভিত্তি যত দৃঢ় হবে, চিন্তাধারাও তত সুসংহত হবে। ইসলামের এমন যে কোনো ব্যাখ্যা, যা যুক্তিবিচারকে উপেক্ষা করে, তা টেকসই নয় এবং তাকে কোনোভাবেই চিন্তাধারা বলা যায় না।
ইসলামী চিন্তাধারার অধ্যয়ন কেবল গ্রন্থ ও ইতিহাস বোঝার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া, যেখানে ধারণা, কল্পনা এবং সংস্কৃতিকে তাদের কালানুক্রমিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বোঝার চেষ্টা অন্তর্ভুক্ত থাকে। ঐতিহাসিক উপলব্ধি, পাঠ বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে একজন গবেষক ইসলামী চিন্তাধারার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারে এবং নতুন বিশ্বে এর কার্যকারিতা তুলে ধরতে পারে।

ভিত্তি:

ইসলামী চিন্তাধারার মূল ভিত্তি মাত্র দুটি: আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নাহ। এই উভয়ই পবিত্র ও অপরিবর্তনীয়। ইসলামী চিন্তাধারার যে কোনো ব্যাখ্যা, তা কোনো আলিম, ফকিহ, দার্শনিক বা বুদ্ধিজীবী যেই প্রদান করুন না কেন, তা কখনো মূল ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেতে পারে না। বরং যে কোনো ব্যাখ্যা যাচাই করার একমাত্র মানদণ্ড এই দুটি উৎস—আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাহ। যে ব্যাখ্যার প্রমাণ ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়, তা ইসলামী এবং গ্রহণযোগ্য; আর যার কোনো ভিত্তি ধর্মগ্রন্থে নেই, তা ইসলামের পরিপন্থী এবং প্রত্যাখ্যাত।
ইসলামী চিন্তাধারার বোঝাপড়ার প্রথম ধাপ হলো এই দুটি উৎসের সামগ্রিক, বিশ্লেষণাত্মক ও গভীর অধ্যয়ন। এগুলোর হিকমত, কারণ ও লক্ষ্য বোঝার চেষ্টা করা। ভাষা ও সাহিত্য, সভ্যতা ও ইতিহাস, তাফসির ও হাদিসের ব্যাখ্যা অধ্যয়ন করা, যাতে এসব ধর্মগ্রন্থকে তাদের ভাষাগত, শরিয়তি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বোঝা সহজ হয়।

ইতিহাস:

ইসলামের ইতিহাস একটি গৌরবময় ইতিহাস। বিভিন্ন যুগ ও স্থানে ইসলাম কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা জানা ইসলামী চিন্তাধারার বিকাশ বোঝার জন্য অপরিহার্য। ইসলামী চিন্তাধারাকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা সম্ভব নয়, যেখানে এটি জন্ম নিয়েছে, বিকশিত হয়েছে এবং ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে।
ইসলামী চিন্তাধারার মূলধারার ধারণাগুলো ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোতে বিকশিত হয়েছে এবং সেসময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের অধ্যয়ন, নবী যুগ, খিলাফতে রাশিদা, উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসন এবং পরবর্তী ইতিহাস বুঝতে সাহায্য করে যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি কীভাবে ইসলামী চিন্তার গঠন ও রূপান্তরে ভূমিকা রেখেছে।
ইসলামী চিন্তাধারায় বিভিন্ন মাযহাব ও মতবাদ গড়ে উঠেছে, যেমন মুতাজিলা, আশআরিয়া, মাতুরিদিয়া ও সুফিবাদ। প্রতিটি ধারা তাওহীদ, রিসালাত, তাকদির, ইবাদত, লেনদেন ও নৈতিকতা বিষয়ে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে। এসব ধারার অধ্যয়ন ইসলামী চিন্তাধারার বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা বোঝার জন্য সহায়ক।
ইসলামী দর্শন ইসলামী চিন্তাধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফারাবি, ইবন সীনা ও ইবন রুশদের মতো মুসলিম দার্শনিকদের কাজ ইসলামী চিন্তার ঐতিহ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামী দর্শনের অধ্যয়ন দেখায়, ইসলামী চিন্তাধারা কীভাবে গ্রিক দর্শনের মতো অন্যান্য দর্শনকে আত্মস্থ করেছে, কী গ্রহণ করেছে এবং কী বর্জন করেছে।

পরিশুদ্ধি:

ইসলামী চিন্তার ব্যাখ্যা আসমানিভাবে অবতীর্ণ নয়; বরং এটি মানুষের প্রচেষ্টার ফল। তাই পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাব এর ওপর অনিবার্য। ইসলামী চিন্তার বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব হলো সর্বদা পরিশুদ্ধি ও সংশোধনের কাজ চালিয়ে যাওয়া, নইলে মানুষের সংস্কৃতি—অর্থাৎ ঐতিহ্য, রীতি-নীতি ও অভ্যাসও ইসলামের অংশ হয়ে যাবে।

পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়ায় অবহেলার ফল হলো এমন এক ইসলাম, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সংমিশ্রণ ঢুকে পড়েছে। ফিকহ ও কালামের উপকারী দিকগুলোকে অস্বীকার করা যায় না, তবে এটিও সত্য যে, এই দুটোর মধ্যে বহু নেতিবাচক বিষয় প্রবেশ করেছে, যা দ্বীনের মৌলিক নীতির পরিপন্থী।

ফিকহ, কালাম ও সুফিবাদের বিকাশের একটি বেদনাদায়ক দিক হলো, এই তিনটি পথ ও মতভেদে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর ফলে, পরস্পরের খণ্ডনের প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছে। যখন খণ্ডন প্রবণতা প্রকট হয়ে যায়, তখন চিন্তা নেতিবাচক হয়ে পড়ে। এটা বাড়িয়ে বলা হবে না যে, ফিকহ ও কালামের বহু অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ নেতিবাচক মানসিকতার প্রতিফলন ঘটায়। এসব বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তিদের লক্ষ্য থাকে না সত্যের অনুসন্ধান; বরং নিজেদের মতবাদের বিজয় ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যারা এসব ক্ষেত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তারা কোনো গঠনমূলক কাজ করতে পারে না।

সুফিবাদের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, এর মাধ্যমে ইসলাম-বহির্ভূত ধারণাগুলোকে ইসলামের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ হলো ‘আহওয়াল’, ‘মাকামাত’, ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’, ‘ওয়াহদাতুশ শুহুদ’ ইত্যাদির মতো অনর্থক, বরং বাতিল তর্ক-বিতর্ক।

সমকালীন ইসলামী চিন্তা:

সমকালীন ইসলামী চিন্তাকে বোঝার জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি, যা এর ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নেয়। ন্যায়বিচার, সাম্য, নারীর অবস্থান ও মানবাধিকার ইত্যাদির সঙ্গে ইসলামী চিন্তার সম্পর্কের অধ্যয়ন, এই চিন্তাগুলোর বাস্তব জীবনে প্রয়োগের উপায় বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।

আজকের ইসলামী চিন্তা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যেমন বিশ্বায়ন, আধুনিকতা ও বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক। তাই এর অধ্যয়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত—ইসলামী চিন্তা এসব চ্যালেঞ্জের কীভাবে উত্তর দিচ্ছে।

সমগ্রিক অধ্যয়নের জন্য বিভিন্ন শাস্ত্রের—যেমন ধর্মীয় জ্ঞান, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন—মিশ্রণ ঘটানো দরকার। এ ধরনের পদ্ধতি ইসলামী চিন্তার একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত চিত্র তুলে ধরতে সহায়তা করে।

সমকালীন ইসলামী চিন্তার সূত্র:

আমাদের শিক্ষক মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ওয়াজিহ রশিদ নদভী রহ. সম্ভবত এই যুগের শেষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি সমকালীন ইসলামী চিন্তার বৈচিত্র্যকে বুঝতেন, বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে ন্যায়সংগত তুলনা করতেন এবং কোনো পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই প্রতিটির বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতেন ও তার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করতেন। ভারত ও আরব বিশ্বের চিন্তাবিদ ও তাদের রচনার প্রতি তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আমরা তাঁর কাছ থেকেই ইসলামী চিন্তা অধ্যয়ন করেছি, এরপর তা বিস্তৃত করেছি, কিন্তু সম্মানিত শিক্ষকের প্রশিক্ষণের ফল ছিল যে, বিদেশি চিন্তাধারাগুলোর প্রভাব থেকে আমরা নিরাপদ ছিলাম।

সমকালীন ইসলামী চিন্তার অধ্যয়নের জন্য নিম্নলিখিত বইগুলো সহায়ক হবে:

প্রাথমিক অধ্যয়ন:

ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমা,

ইবনে তাইমিয়ার আর-রাদ্দু আলা আল-মানতিকিয়্যিন,

ড্রেপারের ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব,

এবং ইউরোপের দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থসমূহ।

ইসলামী চিন্তার পরিচয়:

মুহাম্মদ মুবারকের আল-ফিকরুল ইসলামি,

এবং মালিক বিন নবীর গ্রন্থাবলী।

বিস্তৃতি ও গভীরতা:

মুহাম্মদ আসাদের ইসলাম অন দ্যা ক্রসরোড,
সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, মুহাম্মদ গাজ্জালি ও মরিয়ম জামিলার রচনাবলী।

অন্য গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলী:
সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর তানকীহাত, খুতুবাত, রসাইল ও মাসাইল, সূদ, তাজদিদ ও ইহইয়ায়ে দ্বীন, তাফহিমুল কুরআন,

আবুল হাসান আলী নদভীর তারীখে দাওয়াত ও আজমত, ইনসানি দুনিয়ায় মুসলমানদের উত্থান ও পতনের প্রভাব, ইসলামিয়াত ও মাগরিবিয়াতের সংঘর্ষ, আসর হাজিরে দ্বীনের তাফহিম ও তাশরীহ,

মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহীর দাওয়াতে ইসলামি ও এর পদ্ধতি, তাদাব্বুরে কুরআন,

মাওলানা ওহীদুদ্দিন খানের ইসলাম ও আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ, তাবিরের ভুল,

এবং মাওলানা মুহাম্মদ ওয়াজিহ রশিদের বিভিন্ন গ্রন্থ।

——————–
# শিক্ষা, # পরামর্শ

মূল: ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *