AkramNadwi

ফিতনার বিষয়ে একটি হাদিসের ব্যাখ্যা ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/2410

بسم الله الرحمن الرحيم.


—————————-

|| একটি প্রশ্ন:

ডক্টর সাহেব! কিছু লোক এই হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়:

“حدثنا إسماعيل قال: حدثني أخي عن ابن أبي ذئب عن سعيد المقبري عن أبي هريرة قال: حفظت من رسول الله صلى الله عليه وسلم وعاءين، فأما أحدهما فبثثته، وأما الآخر فلو بثثته قطع هذا البلعوم”।

এর কী উত্তর দেওয়া উচিত? আপনি যদি এই হাদিসের ওপর সংক্ষিপ্ত একটি নোট লিখে দেন, তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব, যাতে তারা, যারা সাহাবাদের ইনসাফের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে, যথাযথ উত্তর পেতে পারে।

|| উত্তর

এই হাদিস সহিহ বুখারি-এর কিতাবুল ইলম-এর বাব হিফজিল ইলম অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এর অনুবাদ হলো:

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন: আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে হাদিসের দুটি ভাণ্ডার সংরক্ষণ করেছি। একটির আমি প্রচার করেছি, আর অপরটি যদি আমি প্রচার করতাম, তাহলে এই গলাটাই কেটে ফেলা হতো।

প্রচারিত হাদিসের সংখ্যা বেশি ছিল:

এই হাদিসে দুটি ভাণ্ডার বলতে দুটি প্রকারের জ্ঞানবহুল হাদিস বোঝানো হয়েছে।

মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল-এর একটি বর্ণনায় এসেছে:

“حفظت ثلاثة أجربة، بثثت منها جرابين”

অর্থাৎ, আমি তিনটি ভাণ্ডারের সমপরিমাণ হাদিস সংরক্ষণ করেছিলাম, যার মধ্যে দুটি আমি প্রচার করেছি।

এছাড়া, আর-রামাহুরমুজির আল-মুহাদ্দিসুল ফাসিল কিতাবে পাঁচটি ভাণ্ডারের উল্লেখ রয়েছে।

হাফিজ ইবনে হাজার রহমতুল্লাহি আলাইহি “ফতহুল বারী”-তে বলেন, “এই বর্ণনাগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, বরং এর অর্থ হলো—যেসব হাদিস প্রচার করা হয়েছে, সেগুলোর সংখ্যা তাদের তুলনায় বেশি, যেগুলো প্রচার করা হয়নি।”

যে হাদিসগুলো প্রচার করা হয়নি:

যেসব হাদিস প্রচার করা হয়নি, সেগুলো ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিত হতে যাওয়া ঘটনাবলী নিয়ে ছিল।
এসব হাদিসের মধ্যে কিছু হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনকালের পর সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কিত ছিল।
এ কারণেই হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ৬০ হিজরি সালের আগমনের কথা শুনে শিশুদের নেতৃত্ব (আমির হওয়া) থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন।
আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন এবং ৬০ হিজরির এক বছর আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর ভয়ের কারণ:

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ভয় পেতেন দুই কারণে:
1️⃣ প্রথম কারণ:
কিছু লোক বিদ্বেষ, শত্রুতা, অজ্ঞতা বা রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে এই হাদিসগুলোর কিছু অংশ তাদের যুগের শাসকদের ও বিভিন্ন দলের ওপর খাটানোর চেষ্টা করত।

ফলস্বরূপ, চরম সংঘাত সৃষ্টি হতো, রক্তপাত ঘটত, এমনকি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর জীবনও হুমকির মুখে পড়ত।

2️⃣ দ্বিতীয় কারণ:
কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিত হতে যাওয়া ফিতনাগুলো অত্যন্ত বিস্ময়কর ও অদ্ভুত হবে।

অনেক মানুষের কাছে এসব বিষয় অবিশ্বাস্য মনে হতো।

এই হাদিসগুলো সাধারণ মানুষ জানত না, তাই যদি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সেগুলো প্রচার করতেন, তাহলে অনেকে ফিতনার হাদিসের ভাষা বুঝতে না পেরে সেগুলো অস্বীকার করত।

ফলে এই পরিস্থিতি শুধু অস্বীকার বা সন্দেহ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত না, বরং বিশৃঙ্খলা ও জান-মালের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াত।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ও ফিতনার হাদিস বর্ণনা :

যখন পরিস্থিতি অনুকূল ছিল এবং ভুল ব্যাখ্যার আশঙ্কা ছিল না, তখন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এই হাদিসগুলোর অনেক কিছু বর্ণনা করেছেন।

সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, জামে তিরমিজি ও মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল-এ ফিতনা, যুদ্ধ (মালাহিম) ও কিয়ামতের আলামত (আশরাতুস সাআহ) সম্পর্কিত বহু হাদিস হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।

এটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, ফিতনার বিষয়ে গোপন রাখা হাদিসের সংখ্যা খুবই কম ছিল।

এটির আরেকটি সমর্থন হলো, অন্য কিছু সাহাবিও ফিতনা সম্পর্কিত বিস্তারিত হাদিস বর্ণনা করেছেন, এবং তাদের বর্ণিত হাদিসগুলোও উপরোক্ত কিতাবগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে।


ফিতনার হাদিস গোপন রাখা—এটি নিজেই নবী করিম (সা.)-এর একটি সিদ্ধান্ত ছিল

ফিতনার হাদিস গোপন রাখার দায়িত্ব শুধু হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর ওপর ছিল না। বরং এটি স্বয়ং নবী করিম (সা.)-এর সিদ্ধান্ত ছিল।

নবী (সা.)-এর যুগের সবচেয়ে বড় ফিতনা ছিল—মুনাফেকি।

পবিত্র কুরআন এই ফিতনার আলোচনা দ্বারা পরিপূর্ণ, তবুও নবী (সা.) এই ফিতনার বিশদ বিবরণ প্রকাশে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবা হজরত আবু বকর (রা.), হজরত উমর (রা.), হজরত উসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) এবং তাঁর স্ত্রীগণকে (উম্মাহাতুল মুমিনিন) পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি।

তবে, তিনি শুধুমাত্র হজরত হুজাইফা বিন ইয়ামান (রা.)-কে মুনাফিকদের নামগুলো জানিয়ে দেন এবং তাঁকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেন এটি গোপন রাখতে।


হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ফিতনার হাদিস গোপন রাখার কারণ

ঠিক একইভাবে, নবী করিম (সা.) হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-কে কিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিত হতে যাওয়া ফিতনা, যুদ্ধ ও কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান দেন।

কিন্তু তিনি তা সাধারণভাবে প্রচার করেননি।

এর কিছু অংশ অন্য সাহাবাদের কাছেও প্রকাশ করা হয়েছে, এবং কিছু ফিতনার বিষয়ে নবী (সা.) জনসম্মুখে আলোচনা করেছেন।

তবে এই ধরনের হাদিসের বিষয়ে নবী (সা.) অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন, এবং সাহাবাগণও সর্বদা এই সতর্কতা মেনে চলতেন।


ফিতনার হাদিস গোপন রাখার কারণ:

ফিতনার হাদিস গোপন রাখার তিনটি কারণ ছিল-

ফিতনার হাদিস গোপন রাখার কারণসমূহ

ফিতনার হাদিস গোপন রাখার তিনটি কারণ উল্লেখযোগ্য—

১. ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বাণীর বিশেষ ভাষাশৈলী

ভবিষ্যতের ব্যাপারে নবী (সা.)-এর বাণীগুলো সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করা হয়নি; বরং এগুলো একটি স্বতন্ত্র ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, যা অনেকটা স্বপ্নের ভাষার মতো।

যারা স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, তারা বুঝতে পারবে না যে শব্দের সামান্য পরিবর্তনেও অর্থ কীভাবে বদলে যেতে পারে।

তাই, যারা এই বিশেষ ভাষা বোঝে না, তারা হয়তো শব্দগুলো এমনভাবে পরিবর্তন করবে, যা মূল অর্থের সম্পূর্ণ বিকৃতি ঘটাবে।

এ কারণেই এই হাদিসগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা জরুরি ছিল।


২. ভবিষ্যতের ঘটনাগুলোকে নিজের যুগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রবণতা

সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটি অস্থিরতা রয়েছে, যাতে তারা ভবিষ্যতের সব কিছু তাদের নিজেদের যুগের ঘটনাবলীর সাথে মেলানোর চেষ্টা করে।
এ ধরনের প্রবণতা বিভিন্ন বিপদের সৃষ্টি করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ইমাম মাহদির আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর ক্ষেত্রে যুগে যুগে মানুষ নিজের সময়ের বিভিন্ন ব্যক্তিকে মাহদি মনে করেছে।

ফলস্বরূপ, অনেকেই মাহদির দাবি করেছে এবং লোকদের বিভ্রান্ত করেছে।

ঠিক একইভাবে, দাজ্জাল ও ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কিত হাদিসগুলোকেও বিভিন্ন সময়ে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।


৩. রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থে হাদিসের অপব্যবহার

কিছু মানুষ তাদের রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এই হাদিসগুলোকে নিজের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে।

একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো—

“আকিল ও উরাইনা” হাদিস, যা সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে রয়েছে।

এই হাদিসে বর্ণিত আছে যে, নবী (সা.) একদল লোককে কঠিন শাস্তি দেন, কারণ তারা বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।

যখন হজরত আনাস (রা.) এই হাদিসটি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ-এর সময়ে বর্ণনা করেন, তখন বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি (রহ.) অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

কারণ, তিনি আশঙ্কা করেন যে, হাজ্জাজ এই হাদিস ব্যবহার করে নিজের অত্যাচারের বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করতে পারে।


ফিতনার হাদিসের প্রচার এবং এর অপব্যবহার:

এই গোপনীয়তা ও সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক।

নবী (সা.)-এর সতর্কতার কারণে প্রত্যেক যুগের মুসলমানদের উচিত ছিল এই হাদিসগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা এবং সাহাবায়ে কেরামের মতো গোপন রাখা।

বিশেষত, এই হাদিসগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করা থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল।

কিন্তু কিছু লোক এমনও ছিল, যারা শুধু এই হাদিসগুলো প্রকাশই করেনি, বরং অনুমান ও অনুমেয় তথ্যের ভিত্তিতে গোপন হাদিসগুলো জানার চেষ্টা করেছে।

তারা নিজেদের ধারণা ও কল্পনাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন নতুন ফিতনার দ্বার খুলে দিয়েছে।


সারসংক্ষেপ:

ফিতনার হাদিস সাধারণ শরিয়তের বিধানের হাদিসের মতো নয়।

শরিয়তের বিধান সম্পর্কিত হাদিস সবার জন্য জরুরি এবং এর ভাষাও সহজ ও স্পষ্ট।

কিন্তু ফিতনার হাদিসের উপকারিতা সীমিত, এর ভাষাও জটিল, এবং এগুলো ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার আশঙ্কা বেশি।

এ কারণেই এই হাদিসগুলো গোপন রাখা হয়েছে।

বর্তমানে যারা এই হাদিসগুলোকে নির্দিষ্ট যুগের ফিতনার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করছে, তারা আসলে অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো, কিছু লোক কল্পনার ওপর নির্ভর করে অপ্রকাশিত হাদিসগুলোর মনগড়া ব্যাখ্যা করছে।

বিনা জ্ঞানে কথা বলার ক্ষতি অনেক বেশি।

হাদিসের অনুমানভিত্তিক ব্যাখ্যা শুধু বিভেদ বাড়াবে এবং প্রত্যেক দল তাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে এই হাদিস প্রয়োগ করতে চাইবে।

সুতরাং, আমাদের হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর অনুসরণ করা উচিত এবং ভুল ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিকর আলোচনা থেকে বিরত থাকা উচিত।

পরিবর্তে, আমাদের আত্মশুদ্ধি, সৎ আমল ও উপকারী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের এবং সকল মুসলমানের কল্যাণে নিয়োজিত করা উচিত।

——————-

# হাদিস # তাফসির

লিখেছেন :
মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী – অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *