AkramNadwi

তাবলিগের বিধি-বিধান বিষয়ে প্রাঞ্জল আলোচনা ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5757

بسم الله الرحمن الرحيم.

আলেম মুহাম্মদ ফারুক সাহেব উতরানভি (মৃত্যু: ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ) রহ. জামিয়া মজাহিরুল উলুম সাহারানপুরের স্নাতক ছিলেন এবং শাহ ওসীউল্লাহ ফতেহপুরি রহ. এর শিক্ষার্থী ও খলিফা ছিলেন। তিনি একজন গভীর জ্ঞানের অধিকারী, বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণশীল আলেম এবং নেক আমলকারী ছিলেন। তাঁর জীবন ইলমের প্রচার ও প্রসারে উৎসর্গীকৃত ছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর মর্যাদা উচ্চ করুন।

সম্প্রতি উল্লেখিত আলেমের বই “الكلام البليغ في أحكام التبليغ” (অর্থাৎ তাবলিগি জামাতের শরয়ি অবস্থান) পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। এই বইয়ে তাবলিগি জামাতের উপর গভীর গবেষণামূলক সমালোচনা করা হয়েছে। জ্ঞানপূর্ণ সমালোচনার মাধ্যমে সংশোধন হয় এবং ইলমের কাফেলা সামনে অগ্রসর হয়। আশা করা যায়, তাবলিগি জামাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই বই সেই উদ্দেশ্যেই পড়বেন এবং এর বিষয়বস্তুর উপর গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন।

এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সমালোচনার উদ্দেশ্য কখনোই কোনো বিষয়কে ধ্বংস করা নয়। এই সমালোচনার কারণে তাবলিগি কাজ থেমে থাকা উচিত নয়; বরং এর সংশোধনের প্রচেষ্টা থাকা উচিত। একই আহ্বান করেছেন মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহমতুল্লাহি আলাইহি ভিন্ন একভাবে।

উক্ত বইয়ে বিদআতের সাথে সম্পর্কিত এমন মৌলিক বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমাকে বইটির প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট করেছে এবং বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত করেছে।

নদওয়াতে অবস্থানের সময় আমি ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহমতুল্লাহি আলাইহির বইগুলো পড়েছিলাম, যা সুন্নত ও বিদআতের পার্থক্য আমার মনে পরিষ্কার করে দিয়েছিল। ইংল্যান্ডে স্থানান্তরের পর প্রথমদিকে আমার যেসব বই পড়ার সুযোগ হয়, তার মধ্যে ইমাম শাতিবির “আল-ই’তিসাম” ছিল। যদিও এটি অসম্পূর্ণ ছিল, আমি মনোযোগ দিয়ে এটি পড়ি এবং নোট নিয়েছিলাম। এরপর “আল-মুওয়াফাকাত” পড়েছি এবং পড়িয়েছি। এর ফলে, মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্নত ও বিদআতের পার্থক্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করি। কিছু ক্ষেত্রে ইমাম শাতিবির ব্যাখ্যাগুলো ইবনে তাইমিয়ার তুলনায় স্পষ্ট, শক্তিশালী এবং অধিক কার্যকর মনে হয়েছে।

সুন্নত ও বিদআতের বিষয়ে উর্দুতে কোনো মানসম্মত রচনা কখনো পাইনি। উপমহাদেশের বইগুলোতে জ্ঞান ও গবেষণার মান কমই দেখা গেছে। বরং বিতর্ক ও তর্কের প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এত দীর্ঘ সময় পর যখন এই বইটি পড়ি, তখন বিস্ময়কর আনন্দ হয় যে উর্দু ভাষায় অন্তত একটি বই রয়েছে, যা জ্ঞান ও গবেষণার মানদণ্ডে পুরোপুরি উৎরে যায়। এই বইয়ের রচনায় লেখক “আল-ই’তিসাম” থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছেন এবং জায়গায় জায়গায় এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
লেখক “حرف آغاز” (শুরুর কথা) অংশে লেখেন:
“কোনো কাজ শরিয়তের দৃষ্টিতে তখনই বৈধ হয়, যখন তা শরিয়তপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি তা শরিয়তপ্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে তা যতই উত্তম এবং যতই উপকারী হোক না কেন, তা শরিয়তের কাজ হবে না; বরং গায়রে শরিয়ত হবে।” (পৃষ্ঠা ৪১)

এই অংশ পুরোটা পড়ে আমার চোখ বিস্ময়ে খোলা রয়ে গেল। আমি ভাবলাম, উপমহাদেশের কোনো আলেম কি সত্যিই এতটা স্পষ্ট এবং সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলতে পারেন?

তিনি আরও লেখেন এবং একই স্পষ্টতা ও সাহসিকতার সঙ্গে বলেন:
“যখন কোনো কাজের বৈধ বা বিদআত হওয়ার মানদণ্ড হলো শরিয়তপ্রমাণ, বৈধতা বা অবৈধতার ভিত্তি হলো শরিয়তপ্রমাণ, এবং সঠিক ও ভুলের নির্ধারণ নির্ভর করে শরিয়তপ্রমাণের উপর, তখন এমন কোনো কাজ যদি শরিয়তপ্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত না হয়, তবুও যদি বহু আলেম এতে অংশগ্রহণ করেন, অথবা তা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়, এবং সেই কাজের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, কিংবা তার অনেক উপকারীতা দেখা যায়, অথবা কোনো ওলি আল্লাহর অন্তরে তা অনুভূত হয় বা প্রেরণা জাগে, অথবা সেই কাজের মাধ্যমে কোনো অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পায়, কিংবা সেই কাজের কোনো গুণ প্রকাশিত হয়, অথবা স্বপ্নে তা সম্পর্কে সুসংবাদ পাওয়া যায়, অথবা সেই কাজের ফলে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেন, অথবা বহু মসজিদ তৈরি হয়, অথবা অনেক মানুষ ধর্মীয় এবং নামাযি হয়ে যায় – এসব বিষয় শরিয়তের কাছে কোনো বৈধ প্রমাণ নয়। এই বিষয়গুলোর দ্বারা কোনো কাজের সঠিক বা ভুল হওয়া নির্ধারণ করা যায় না।” (পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)

এরপর লেখক তাঁর বক্তব্য সমর্থনে শাতিবির “আল-ই’তিসাম” থেকে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন এবং কুরআন মাজিদের কিছু আয়াত থেকে দলিল পেশ করেছেন।

এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো হাদিস এবং গবেষক আলেমদের বক্তব্যের আলোকে বিদআতের ধারণা ব্যাখ্যা করা। এর মধ্যে একটি উপকারী
“যেভাবে রাসুলের কাজ সুন্নত, তেমনি রাসুলের না-করা কাজও সুন্নত।” (পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪)

বইটির একটি আলোচ্য বিষয় হলো “তাবলিগ একটি সাধারণ আদেশ।” এটি পড়ে লেখকের বিদ্বানসুলভ মর্যাদা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই আলোচনারই অংশ হলো: “তাবলিগের সাধারণ প্রমাণ থেকে নির্দিষ্ট তাবলিগের প্রমাণ হয় না।” এই অংশ লেখকের গভীর চিন্তাশক্তি এবং গবেষণাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল সাক্ষ্য। তিনি বলেন:
“বিদআতিদের বড় একটি মৌলিক ভুল হলো, তারা সাধারণ ও মুক্ত নির্দেশ থেকে নির্দিষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো প্রমাণ করে। অথচ সাধারণ ও মুক্ত নির্দেশ থেকে নির্দিষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বিষয় প্রমাণিত হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র প্রমাণ না থাকে।” (পৃষ্ঠা ৯৯)

এরপর লেখক ইমাম শাতিবির কিছু বক্তব্য তার সমর্থনে তুলে ধরেছেন। এই আলোচনাটি যদি ভালোভাবে পড়া হয়, তবে আলেম ও পীর-মাশায়েখদের বহু দলিল ভিত্তিহীন প্রমাণিত হবে।

বইটি ৫৬৩ পৃষ্ঠার সমন্বয়ে গঠিত, এবং এর মৌলিক বিষয়গুলো অত্যন্ত উপকারী। এই সংক্ষিপ্ত লেখায় সব বিষয়কে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বইটি পড়ার পর বারবার আমার মনে হয়েছে, ইশ! যদি জীবদ্দশায় এই মহান গবেষকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হতো, তবে তার থেকে উপকৃত হতাম এবং অনুমতির জন্য চেষ্টা করতাম। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। হাদিসবিদগণের একটি উক্তি আছে: “শ্রবণ একটি রিজিক।”

এই রিভিউ লেখার উদ্দেশ্য তাবলিগি জামাতের উপর উত্থাপিত সমালোচনার পর্যালোচনা নয়। আমি এই কাজ অন্যদের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি। এবং যদি আমি এই সমালোচনাগুলোর বিষয়ে কোনো মতামত প্রকাশ করি, তবে হয়তো তা নিরপেক্ষ হবে না। কারণ, শৈশব থেকেই আমার এই জামাতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এবং আমি এর থেকে অনেক উপকার পেয়েছি।

বইটিতে কোথাও কোথাও বিতর্কমূলক ধারা চলে এসেছে। ইশ! এই ত্রুটি না থাকত। তবে সম্ভবত বিষয়বস্তুর কারণেই এমন হয়েছে, কারণ বইটির মূল বিষয়ই সমালোচনা। এই একটি বিষয় বাদ দিলে, এই বইটি উর্দু ভাষায় তার বিষয়ের উপর অতুলনীয়।

আমার মতে, উপমহাদেশের মাদরাসাগুলোর দায়িত্বশীলদের উচিত এই বইটিকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা। আর যদি কোনো কারণে তা সম্ভব না হয়, তবে অন্তত শিক্ষার্থীদের এই বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা উচিত।

———
# আলোচনা # সমালোচনা # গবেষণা

> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
> অনুবাদ ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *