Source: https://t.me/DrAkramNadwi/5541
بسم الله الرحمن الرحيم
—
ইফতার ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সংস্কার
মাদ্রাসা ডিসকোর্সেস প্রোগ্রামে ২৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে প্রদত্ত বক্তৃতার মূল পয়েন্টসমূহ
নোট: এই পয়েন্টগুলো আমার বই “আল-মুউতামাদ ফি উসুলিল ফতোয়া” থেকে নেওয়া হয়েছে, তাই এখানে নির্দিষ্ট রেফারেন্স নেই। বিশদ আলোচনার জন্য মূল বইটি দেখুন।
✍️ লেখক: ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী,
অক্সফোর্ড
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট বাংলাদেশ।
—
⏳ সময় ও স্থান :
সময় ও স্থান এমন শক্তিশালী উপাদান যা প্রত্যেক বস্তুগত ও আত্মিক বাস্তবতাকে প্রভাবিত করে এবং এই মূলনীতি থেকে ধর্মও বাদ নয়। সময় ও ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক অঞ্চলের পরিবর্তনে অনেক ধর্মীয় অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। প্রতিটি যুগের আলেমদের দায়িত্ব হল ধর্মকে অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা, অতিরিক্ততা ও অভাব সংশোধন করা এবং মধ্যপথের শিক্ষা প্রদান করা।
⚖️ ফতোয়া
ফতোয়া ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং এটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। নিম্নলিখিত পয়েন্টগুলোর আলোকে দেখানো হবে কীভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে।
—
গভীরতা ও বিস্তৃতি:
ফিকহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্র হলো কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমগ্র ধর্মের গভীর জ্ঞান। এর মধ্যে ধর্মের মৌলিক ও শাখাগত সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত, যেমন- ঈমান, ইসলাম, তাকওয়া, সততা, আমানত, সৎ জীবনযাপন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা, এবং আখিরাতের প্রতি আগ্রহ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ফিকহ বাহ্যিক বিষয় ও শাখাগত বিষয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সমাজে ধর্মীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, অথচ নামাজে খুশু ও খুযু, পারিবারিক জীবনে শান্তি ও ভালোবাসা এবং সমাজে ইসলামের প্রচার ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ফিকহের আওতা থেকে বেরিয়ে গেছে।
ফতোয়া হলো নির্দিষ্ট কোনো সমস্যায় নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ফিকহি মতামত প্রদান করা। যখন ফিকহ সীমিত হয়েছে, তখন ফতোয়ার ক্ষেত্রও সংকুচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, মুফতি সরাসরি বলবেন যে এটি তালাকে মুগাল্লাযাহ, এবং সেই নারীর সাথে নতুন বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাকে বৈধ নয়। কিন্তু এর ফলে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান এবং পরিবারের উপর যে প্রভাব পড়ে, তা ফিকহে বিবেচনা করা হয় না। হালালার মতো অপমানজনক বিষয়ের প্রভাবও এভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।
—
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য:
ধর্মের মূল শিক্ষা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি আনুগত্য করা। ফতোয়ার অর্থ হলো মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যে উৎসাহিত করা। চতুর্থ শতাব্দী হিজরী থেকে ফিকহি মাযহাব শক্তিশালী হতে শুরু করায় ফতোয়ায় মাযহাবের প্রসঙ্গ যুক্ত হতে থাকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এসব মাযহাব এবং ইমামদের মতামতের ভিত্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশনা। তবে যখন ফতোয়ায় আল্লাহ ও রাসুলের উল্লেখ কমতে থাকে, তখন তাদের প্রতি আনুগত্য পিছনে চলে যায় এবং মাযহাবের প্রতি আনুগত্যই মুখ্য হয়ে ওঠে।
এটি আমাদের মনে সদা সতেজ ও জীবিত থাকা উচিত যে, এই ধর্মের মধ্যে শুধুমাত্র কুরআন ও রাসুলের উদাহরণই সকল কিতাবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। ইসলামে এই শ্রেষ্ঠত্ব কোনো ফিকহি বা কালামি কিতাবে নেই, কোনো ইমামের নেই, এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠান বা চিন্তার শৈলীতেও নেই। এই ভুল পথ গ্রহণে জাতির মাঝে তর্ক-বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনমনীয়তার একটি সঙ্কট তৈরি হয়েছে, যার ফলে অসংখ্য সংস্থার প্রচারিত বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও উপমাগুলো কুরআন ও সুন্নাহর প্রাথমিক অবস্থানকে এক ধরনের অপ্রাসঙ্গিক ধারণা থেকে বেশি মূল্য দেয় না।
—
উৎস ও রেফারেন্স:
ফতোয়ার পতনের আরেকটি চিহ্ন হলো, উৎস ও রেফারেন্সের গুরুত্ব কমে গেছে। মৌলিক উৎস ও সহায়ক উৎসের পার্থক্য মুছে গেছে। ফিকহ ও ফতোয়ার কিতাবের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কুরআন ও হাদিসের রেফারেন্স ভুলে গেছে। হাদিসের রেফারেন্স দেওয়ার সময় সহীহ ও দুর্বল হাদিসের পার্থক্যও অধিকাংশ সময় করা হয় না। এটি একটি গুরুতর বিষয়, যেমন মিশকাত আল-মাসাবিহ এর মতো কিতাবকে সরাসরি উল্লেখ করা হচ্ছে, অথচ এই বইয়ের মূল উৎসগুলো সহজলভ্য এবং এর রেফারেন্সগুলো মৌলিক উৎসে পাওয়া যায়।
এটি একটি মজবুত নীতি যে, যখন কোনো দাবি করা হয়, সেটি প্রমাণের সাথে হতে হবে, এবং প্রত্যেক প্রমাণের উল্লেখ থাকতে হবে। প্রমাণ সবসময় মৌলিক এবং প্রাথমিক উৎসে হতে হবে। সহায়ক উৎসগুলোকে কেবল প্রমাণের জন্য সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এটি দিয়ে দাবি প্রতিষ্ঠা করা উচিত নয়।
—
সহজীকরণ (তাইসীর):
ফতোয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো মুসলিমদের জন্য ধর্মকে সহজভাবে উপস্থাপন করা এবং তাদের সামনে সহজ সমাধান রাখা। সহজীকরণই ধর্মের আত্মা। আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, কষ্ট চান না” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৮৫) এবং আরেকটি আয়াতে বলেছেন, “তিনি তোমাদের জন্য ধর্মে কোনো কষ্ট রাখেননি” (সূরা আল-হাজ্জ, ২২:৭৮)। কুরআনের অনেক আয়াতেই এই মর্মবাণী রয়েছে এবং সহীহ বুখারীর একটি হাদিসে বলা হয়েছে, “ধর্ম সহজ”।
আজকের সময়ে ধর্ম পালন করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই যেখানে বৈধতা রয়েছে, সেখানে মুসলিমদের জন্য সহজ সমাধান বের করা উচিত, যেন তারা ইসলামের পথে অটল থাকতে পারে। শায়খ ইউসুফ আল-কারযাভী বারবার বলেছেন, সবকিছু হারাম ঘোষণা করা কোন ফিকহ নয়। সত্যিকারের ফকিহ তিনিই যিনি ধর্মীয় সীমারেখার মধ্যে থেকে সহজ পথ খুঁজে বের করতে পারেন। তিনি কঠোর পন্থা অবলম্বনকারী মুফতিদের অপছন্দ করতেন যারা সর্বদা “সতর্কতামূলক” ফতোয়া দিতেন।
কেউ কেউ সহজীকরণকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে মনে করতে পারেন। এটি ভুল বোঝাবুঝির ফলাফল। আল্লাহর আনুগত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতা একে অপরের বিপরীত। সহজীকরণের অর্থ হলো, যদি আল্লাহর আনুগত্যের দুটি পথ থাকে এবং একটি অন্যটির তুলনায় সহজ হয়, তবে সহজ পথ গ্রহণ করা। উদাহরণস্বরূপ, ওজু করার সময় মোজা পরার উপর মাসেহ করা, এটি অবশ্যই আল্লাহর আনুগত্যের একটি সহজ পদ্ধতি।
—
⚖️ ফতোয়া ও বিচার বিভাগের পার্থক্য:
ফতোয়া কেবল একটি আইনগত পরামর্শ, কিন্তু বিচার বিভাগ (ক্বাদাহ) বাধ্যতামূলকভাবে কাউকে কোন কাজের প্রতি বাধ্য করা। বিচার ব্যবস্থায় মামলা, বিবাদী ও বিবাদী পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা এবং প্রমাণাদি থাকে। বিচার হলো সরকারের কাজ, কারণ এটি বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হতে থাকে এবং ফতোয়ার মাধ্যমে এর ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, কারণ অনেক মুফতি তাদের পরামর্শমূলক ভূমিকার বাইরে গিয়ে বিচারকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, কোনও কিছুকে কুফরি বলে ঘোষণা করতে মুফতির কাছে প্রশ্ন আসে। মুফতি একতরফা সিদ্ধান্ত নেন এবং কেউ তাকে অপর পক্ষের কথা শোনাতে চায় না। তবে এভাবে শুধু একতরফা অভিযোগের ভিত্তিতে কারো বিরুদ্ধে কুফরির ফতোয়া দেয়া এবং মুসলিমদের গোমরাহ বলা ভুল। নবী করিম (সঃ) বলেছেন, মুসলমানকে কাফির বলা হত্যা করার চেয়েও বড় গুনাহ।
—
শিক্ষা ও ব্যাখ্যা:
জ্ঞানী আলেমদের মতে, ফতোয়া বিস্তারিত ও প্রমাণিত হওয়া উচিত যাতে মানুষ বুঝতে পারে কেন এ ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে এবং সহজে তা গ্রহণ করতে পারে।
কুরআন কেবল সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় না, বরং শিক্ষার জন্য বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করে। এর ফলে মানুষের মনে শান্তি আসে, সন্দেহ দূর হয় এবং তারা সেগুলো পরিপূর্ণ আস্থা নিয়ে পালন করতে সক্ষম হয়। এটি নবী করিম (সঃ)-এর পদ্ধতি এবং ইবন তাইমিয়াহ (রহঃ)-এর ফতোয়াগুলিও এই নীতির উপর ভিত্তি করে।
—
ভাষা ও শৈলী:
যখন কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা একে অপরের সাথে আলোচনা করেন, তারা টেকনিক্যাল শব্দ ব্যবহার করেন। এই শব্দগুলো সংক্ষেপে জটিল ধারণাগুলি বোঝায় এবং এটি একটি নির্ভুল অনুবাদ প্রদান করতে পারে। তবে, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলার সময় টেকনিক্যাল শব্দ ব্যবহার করা উচিত নয় বা প্রয়োজন হলে সহজ ভাষায় বোঝানো উচিত।
উদাহরণস্বরূপ, নামাজের গুরুত্ব বোঝানোর সময় “নামাজ ফরজ” বা “নামাজ পড়া আবশ্যক” বলা না বলে, নামাজের আধ্যাত্মিক ও মানসিক উপকারিতা বোঝানো উচিত। এতে নামাজের প্রতি মানুষের ভালবাসা ও গুরুত্ব বাড়বে এবং তারা তা আন্তরিকতার সাথে পালন করবে। একইভাবে, যদি ধূমপান নিয়ে আলোচনা করা হয়, তবে এর মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির দিকটি তুলে ধরা উচিত। এক কথায় “হারাম” বা “মাকরুহ” বলে না দিয়ে , এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বোঝানো উচিত। অনেকেই ফতোয়ার কঠোর ভাষার কারণে ধূমপান ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু বিজ্ঞ জনদের ব্যাখ্যা ও আন্তরিক পরামর্শের ফলে বহু মানুষ এটি ত্যাগ করেছে।
—
উপসংহার:
ফতোয়ার ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন যাতে এটি আজকের সমাজে পুনরায় প্রাসঙ্গিক ও কার্যকর হতে পারে। কুরআন ও সুন্নাহর মূল নীতিগুলোতে ফিরে যাওয়া এবং ধর্মীয় নির্দেশনাগুলো সহজীকরণ করা অপরিহার্য। ফতোয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শমূলক ভূমিকা পালন করা এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালন না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে, ফতোয়াগুলো সংক্ষিপ্ত না হয়ে সুস্পষ্ট, বিশদ এবং জনসাধারণের জন্য সহজবোধ্য হওয়া উচিত। এতে মানুষ ফতোয়ার পেছনের প্রজ্ঞা ও নির্দেশনা বুঝতে পারবে এবং তাদের জন্য তা অনুসরণ করা সহজ হবে।