AkramNadwi

ইমাম আবু হানিফা কি চল্লিশ বছর ধরে এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছিলেন? ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/6172

بسم الله الرحمن الرحيم.


——————–

প্রশ্ন:
ভারতের একজন প্রখ্যাত আলেম প্রশ্ন করেছেন: আমাদের এখানে একটি কথা প্রসিদ্ধ যে, ইমামে আজম আবু হানিফা (রহঃ) চল্লিশ বছর ধরে এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। আপনি অনুগ্রহ করে এই বর্ণনার সত্যতা যাচাই করে জানান।

উত্তর:
ইমামে আজম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) ইসলামের সেই শ্রদ্ধেয় ইমামদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের সম্পর্কে পুরো উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে যে, তিনি জ্ঞান, ফিকহ, ধর্মনিষ্ঠা, তাকওয়া ও পারহেজগারিতে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তিনি শুধু ইসলামি ফিকহকেই বিকাশ করেননি, বরং তাঁর গভীর জ্ঞান, অটলতা ও দ্বীনী অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে এমন এক ফিকহি ধারা রেখে গেছেন যা আজও কোটি কোটি মুসলমানের ধর্মীয় ও practically জীবনের দিশারী।

যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর উপর গর্ব করে, সেখানে কিছু গোষ্ঠী অতিরিক্ত ভক্তির বশবর্তী হয়ে তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু বর্ণনা ছড়িয়ে দিয়েছে, যা না বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে খাপ খায়, না শরিয়তের সঙ্গে, এবং না নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের মূলনীতির সঙ্গে।

এই প্রসিদ্ধ কিন্তু অপ্রমাণিত কাহিনিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই বর্ণনা— যে, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) চল্লিশ বছর ধরে এশার অজু দিয়েই ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। বাহ্যিকভাবে এটি তাঁর রাত্রিকালীন ইবাদত ও জাগরণের নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু যখন এই বর্ণনাকে বিশ্লেষণমূলকভাবে দেখা হয়, তখন তা একটি অলৌকিক এবং মানব স্বভাবের পরিপন্থী দাবি বলেই প্রতীয়মান হয়।

যদি এই দাবিকে সত্য ধরে নেওয়া হয়, তবে তার মানে দাঁড়ায় যে, ইমাম সাহেব চল্লিশ বছর এক রাতের জন্যও ঘুমাননি, কখনও প্রস্রাব কিংবা বাতাস ত্যাগ করার প্রয়োজন হয়নি, কখনও কিছু খাননি বা পান করেননি, কোনও রোগে ভোগেননি বা ভ্রমণ করেননি যাতে করে অজু ভঙ্গ হতো। এই সবকিছু এমনকি কোন কৃচ্ছসাধনকারী সাধকের জীবন থেকেও অনেক দূরের কথা।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই কথা প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ ইমাম সাহেব বিভিন্ন সফর করেছেন, হজে গিয়েছেন, এমনকি কারাবরণও করেছেন।

প্রশ্ন আসে, এমন কে ছিল যে চল্লিশ বছর ধরে ইমাম সাহেবের ইবাদতের নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ করে গেছে? এবং যদি কেউ থাকেও, তার সনদ কোথায়? হাদিস ও ইতিহাসের মৌলিক নীতি হলো: প্রতিটি ঘটনা বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে, অথচ এই বর্ণনার একটিও সহিহ ও যুক্ত সনদ নেই।

বিশিষ্ট আলেম আল্লামা ফাইরুজআবাদী (রহঃ) এই দাবিকে সরাসরি মিথ্যা বলেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থ “আর-রাদ ‘আলাল মু’তারিয” (খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৪)-তে লিখেছেন:

“এটি তাদের অন্যতম স্পষ্ট মিথ্যাগুলোর মধ্যে একটি, যেগুলো ইমাম আবু হানিফার প্রতি সম্বন্ধ করা উপযুক্ত নয়। এতে উল্লেখযোগ্য কোনো ফজিলত নেই। বরং এমন একজন ইমামের জন্য আরও উত্তম হতো যদি তিনি প্রতিটি নামাজের জন্য নতুন করে অজু করতেন, কেননা সেটাই অধিক ফজিলতপূর্ণ, পরিপূর্ণ এবং সুন্নতের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি ধরা হয় তিনি চল্লিশ বছর ধরে প্রতিরাত জেগে ছিলেন, তাহলে সেটি অসম্ভবের কাছাকাছি একটি বিষয়। এটি কিছু অজ্ঞ ও কট্টর অনুসারীদের কল্পিত রচনা, যা তারা আবু হানিফা ও অন্যান্য বুযুর্গদের সাথেও যুক্ত করেছে, অথচ এই সবই মিথ্যা।”

ইসলামে ইবাদত, পরহেজগারিতা বা অলৌকিকতার মানদণ্ড হলো রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ। তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী, কিন্তু তিনি কখনও চল্লিশ বছর জেগে কাটাননি, কিংবা এমন অমানবিক ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেননি যা মানব প্রকৃতির পরিপন্থী। তিনি ঘুমাতেন, পরিবারের হক আদায় করতেন, সাহাবাদের মধ্যেও ভারসাম্যের শিক্ষা দিতেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন যাতে তাঁর উম্মতের জন্য সহজতা হয়।

সুতরাং, যদি ধরে নেওয়াও হয় যে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) কোনো সময় এমন কিছু করে থাকেন (যা যৌক্তিক বা দলিলভিত্তিকভাবে প্রমাণিত নয়), তাহলেও সে বিষয়টিকে অনুসরণের মাপকাঠি বানানো যায় না। আমাদের প্রকৃত আদর্শ তো সেই মহান ব্যক্তিত্ব, যার অনুসরণ আমাদের উপর ফরজ — অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

দুঃখের বিষয় হলো, আজকাল কিছু লোক ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর প্রকৃত জ্ঞান ও ইজতিহাদি অবদানকে বুঝে তা উপস্থাপন করার পরিবর্তে তাঁর চারপাশে এমন সব কল্পিত ও অযৌক্তিক কাহিনি জড়ো করছে, যা শুধুমাত্র জনমোহনের পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ তাঁর প্রকৃত গৌরব হলো সেই গভীর ফিকহি অন্তর্দৃষ্টি যা ইসলামী আইনকে মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও ইজতিহাদের ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এটা সত্যিকার অর্থেই আমাদের মানসিক ও বৌদ্ধিক অবক্ষয়ের প্রতীক — যখন আমরা আমাদের ইমামদের প্রকৃত গুণাবলিকে পিছনে ফেলে, অপ্রমাণিত এবং অযৌক্তিক ঘটনাকে তাদের মর্যাদার ভিত্তি বানিয়ে ফেলি।

এই প্রবন্ধটি মূলত সেই বার্তারই বিশদ ব্যাখ্যা, যা প্রায় পনেরো থেকে বিশ বছর আগে আমার রচিত ইংরেজি গ্রন্থ “Abu Hanifah and His Legacy”-তেও উপস্থাপন করা হয়েছিল। ঐ বইয়ের উদ্দেশ্য ছিল ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর ব্যক্তিত্ব, তাঁর ফিকহি অবদান, জ্ঞানচর্চা এবং পরবর্তী প্রজন্মে তাঁর প্রভাবকে প্রমাণভিত্তিক, গবেষণামূলক এবং ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা। আলহামদুলিল্লাহ, এই গ্রন্থটি বিদ্বান মহলে প্রশংসিত হয়েছে এবং এখনো গবেষক ও পাঠকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত।

আমাদের উচিত ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা তাঁর জ্ঞান, আমল, তাকওয়া এবং ইজতিহাদের ভিত্তিতে — এমন মনগড়া কাহিনির উপর নয়, যা শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং অনেক সময় দ্বীনের মূলধারার বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। ইমাম সাহেবের প্রকৃত উত্তরাধিকার হলো তাঁর জ্ঞান, তাঁর ফিকহ এবং তাঁর নীতিভিত্তিক চিন্তাধারা — এবং এটিই কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর নামকে উজ্জ্বল করে রাখবে।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *