AkramNadwi

“জ্ঞান-নিষ্ঠার ঝলক:

“জ্ঞান-নিষ্ঠার ঝলক: শায়খ তুরকী আল-ফাদলীর গ্রন্থে শায়খ মুহাম্মদ ইসহাক ক্বারী আল-বাকরী আল-মাক্কী”
——————–
بسم الله الرحمن الرحيم

আমি যখন লন্ডন ও অক্সফোর্ডের মাঝে চলাফেরা করছিলাম, আর আলেম ও ক্বারিদের আসরে উপস্থিত হচ্ছিলাম, তখন আমার হাতে এক চমৎকার বই এসে পড়ে—আকারে ছোট হলেও, বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিশাল, উদ্দেশ্যে মর্যাদাপূর্ণ। আমি ঠিক জানি না, বইটা নিজেই আমার কাছে এসেছে, না আমি নিজে গিয়ে ওর কাছে পৌঁছেছি। তবে যেটাই হোক না কেন, এটা কোনো সাধারণ বই নয়। এটা এক মহান মক্কাবাসী আলেমের জীবনের দিকে উঁকি দেওয়ার জানালা, যিনি প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছিলেন নামের ভিড়ে আর সময়ের ধারাবাহিক পরিবর্তনে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে এক বিশ্বস্ত, নিবেদিতপ্রাণ, আন্তরিক গবেষককে নিয়োজিত না করলে হয়তো তাঁর স্মৃতি বাঁচত না। এই মানুষটি তাঁর জীবনীকে জীবন্ত করে তুলেছেন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলোকে একত্র করেছেন, আর এমন একটি পরিপাটি রূপে তা প্রকাশ করেছেন, যা নিছক একটি জড় অনুবাদ নয় বরং জীবন্ত এক জ্ঞানোজ্জ্বল জীবনচরিত।

আমি এই মানুষ বলতে বুঝাচ্ছি আমাদের সম্মানিত বন্ধু, হাদিস বিশারদ ও গবেষক, শাইখ তুরকি বিন আব্দুর-রব্বি আর-রাসূল আল-ফাদলি—তিনি মক্কার বাসিন্দা। তিনি কেবল তর্জমা ও ইতিহাসগ্রন্থে আগ্রহী হিসেবেই পরিচিত নন, বরং তিনি তাঁর জীবনই উৎসর্গ করেছেন হাদিস পাঠে—প্রবীণ মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে সহীহ সনদে হাদিস শ্রবণ ও ইজাযত অর্জনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা করে গেছেন। এমনকি আজ তিনি হাদিস সনদের মহলে যেমন সুপরিচিত, তেমনি তর্জমা ও ইতিহাস অনুরাগীদের কাছেও সুপরিচিত।

তিনি এমন এক কাজ হাতে নিয়েছেন, যা এই যুগে খুব কম মানুষই করে—মক্কার আলেমদের জীবনী সংকলন। যাঁরা পবিত্র নগরীর অলিতে গলিতে বসবাস করতেন, শিক্ষাদান করতেন, আর যাঁদের হাত ধরে হিজাজসহ বিশ্বজুড়ে বহু আলেম, দাঈ ও ক্বারি তৈরি হয়েছেন, তাঁদের জীবনী সংরক্ষণ তাঁর কলমের একান্ত ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাঁদের স্মৃতি নবায়ন করেছেন, অবদানগুলোকে তুলে ধরেছেন, এবং এমন এক প্রজন্মের হৃদয়ে তাঁদের নাম পৌঁছে দিয়েছেন—যারা এতদিন তাঁদের কথা একেবারেই ভুলে ছিল।

এই বই—যার নাম “قبسات من حياة المقرئ الشيخ محمد إسحاق قاري البكري المكي (১২৯২–১৩৬৮ হিজরি)”—এটি প্রচলিত জীবনীগ্রন্থের মতো নয়, যেখানে কেবল নাম, জন্ম-মৃত্যু, কিছু গুণাবলি উল্লেখ করেই দায় শেষ করা হয়। বরং এটি এক জীবন্ত বর্ণনা, গল্পের ঢঙে লেখা, যাতে প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে, আছে এমন বাস্তবচিত্রণ—যা আলেমটিকে বইয়ের পৃষ্ঠায় নয়, বরং জীবনের মঞ্চে চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

এই বইতে আমরা শাইখ মুহাম্মদ ইসহাককে কেবল কাগজে-কলমে নয়, বাস্তব জীবনে মসজিদুল হারামে নামাজ আদায় করতে, ক্বিরাত শিক্ষা দিতে, মানুষকে জ্ঞান শেখাতে, মানুষদের সঙ্গে মিশতে দেখি। লেখক যেন তাঁকে মৃত্যুর পর আবার জীবন্ত করে তুলেছেন, ছাত্রদের মাঝখানে তাঁকে নিয়ে গেছেন, শুধু শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নয়—তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য, এবং দেখানোর জন্য—আলেমদের জীবন কেমন হওয়া উচিত।

এই জীবনী কল্পনা কিংবা অনুমানের ফসল নয়, বিচ্ছিন্ন তথ্যের ওপর দাঁড়ানো কোনো অস্থির নির্মাণ নয়। এটি বহু বছরের গবেষণার, নিখুঁত অনুসন্ধানের এবং সরাসরি সাক্ষাৎকার ও সাক্ষ্যগ্রহণের ফল। লেখক বহু উৎসে ফিরে গেছেন, যার মধ্যে কিছু ছিল দুর্লভ ও অচেনা—যেমন উর্দু ভাষায় রচিত মির্জা বিসমিল্লাহ বেগের বই “تذكرة قارئانِ هند”—যা কেবল ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের পরিচিত কেউই বুঝতে পারে।

তিনি এ ছাড়া হিজাজের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক উমর আবদুল জব্বারের লেখাকেও গ্রহণ করেছেন, যিনি স্বয়ং সেই যুগ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সেইসব মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।

এর সঙ্গে তিনি সংযোজন করেছেন শাইখের পুত্র মুহাম্মদ আলী আল-বাকরীর স্মৃতিকথা, এবং মৌখিক বর্ণনা গ্রহণ করেছেন সরাসরি তাঁর ছেলে হাসান ও নাতনি ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম এবং ফাতিমার কাছ থেকে—যাঁরা সকলেই শাইখের পরিবারভুক্ত।

লেখকের সততা পাঠকের চোখ এড়ায় না। তিনি সেই ফাতিমার অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি শাইখের একজন নাতনি হিসেবে তাঁকে এই কাজ শেষ করতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। লেখক তাঁর নাম লিখেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তাঁর জন্য দোআ করেছেন, এবং অন্য অনেক লেখকের মতো মানবিক সহযোগিতাকে গোপন করেননি।

আর এই গবেষণার মূল প্রেরণা ছিল কোনো আবেগ নয়—একটি প্রাঞ্জল ও জ্ঞানভিত্তিক প্রশ্ন, যা তাঁর শাইখ, ক্বারি আবদুল মালিক ইবন সুলতান মাহমুদের কাছ থেকে এসেছিল। যখন শাইখ তুর্কি তাঁর কাছে কিছু পাঠ পড়লেন, তখন তিনি তাঁকে ইজাজাহ দিলেন এবং জানালেন যে, হারাম মক্কির ইমাম শাইখ আবদুল্লাহ ইবন আবদুল গণি খাইয়াত তাঁকে একবার ক্বিরাত পরীক্ষায় নিয়েছিলেন, যেখানে তিনি সাত ক্বিরাত অনুযায়ী সূরা আদ-দুহা পাঠ করেন। তারপর তাঁকে একটি সনদ দেন, যাতে লেখা ছিল—এই সনদ শাইখ ইসহাক ক্বারি পর্যন্ত পৌঁছায়, যিনি ছিলেন ফাখিরিয়া মাদ্রাসার পরিচালক।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *