AkramNadwi

একটি আয়াত, যা হৃদয়ের গভীরে নাড়া দেয়

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ 💠

আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত আমার স্নায়ুকে জড়িয়ে ধরে, আমার ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়ে, আমার অন্তরে প্রবাহিত হয় ঠিক যেমন শুকনো পাতার মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেঁপে ওঠে এবং আমার কঠিন হৃদয় নরম হয়ে যায়। যখনই আমি এই আয়াত পড়ি, কিংবা তা আমার কানে আসে, বা মনে উদয় হয়— তখনই আমার হৃদয় ছিটকে পড়ে, আমার অস্তিত্ব কেঁপে ওঠে। যেন আসমান থেকে এক আহ্বান আমার ভিতরে বাজে, যখনই আমি আল্লাহ যে অবস্থানে আমাকে স্থাপন করেছেন, তা থেকে পালানোর ইচ্ছা করি।

“فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ”

“সে মনে করল, আমি তার উপর ক্ষমতা লাভ করতে পারব না।”

(সূরা আল-আম্বিয়া: ৮৭)

কি ভয়ংকর এর প্রভাব!

একজন সম্মানিত নবী, মনোনীত রাসূল মনে করলেন যে, তাঁর জাতি তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেবে না, তারা তাদের গাফেলতায় ডুবে থাকবে, অহংকারে মত্ত থাকবে। তিনি ভাবলেন, তারা কখনোই ঈমান আনবে না, যতই তিনি উপদেশ দিন না কেন। তাই সময় নষ্ট না করে বিদায় নেয়াই শ্রেয়, আর অন্য কোনো জায়গায় দাওয়াতের পথ খোঁজা উত্তম।

তিনি তাঁদের ছেড়ে গেলেন, রাগ করে ত্যাগ করলেন, আর মনে করলেন— এখন যাওয়ার সময়। তিনি ভুলে গেলেন, আল্লাহর কোনো কিছুর জন্য অক্ষম নন, আর যিনি আল্লাহর অনুমতি ছাড়া বের হন, তিনি একাকী বের হন— বিপদের সম্মুখীন হতে। এমনকি তিনি যদি আল্লাহর মনোনীত নবী হন, তবুও।

তিনি ভুলে গেলেন, আল্লাহ চাইলে তাঁকে আরও বড় পরীক্ষা ও বিপদে ফেলতে পারেন।

আর সেটাই ঘটল। ইউনুস (আ.)-কে এক ভয়ংকর বিপদে ফেলা হলো। তিনি তিমির পেটে গিয়ে পড়লেন, আর তখনই তিনি উপলব্ধি করলেন বাস্তবতা।

তিনি পড়লেন তিনটি অন্ধকারে:

যেখানে নেই কোনো দৃষ্টি, নেই কোনো শব্দ, না ছিল কোনো সঙ্গী কিংবা আপনজন, ছিল না কোনো পথ এবং না ছিল কোনো আশ্রয়।

নেই কোনো পথ, নেই কোনো পলায়ন।

তিনি তখন সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য ত্যাগ করে তাঁর প্রতিপালকের দরবারে নিজেকে সঁপে দিলেন, ভেঙে পড়লেন, বিনীত হলেন, ফিরে এলেন তাঁর প্রভুর দিকে।

আর তখন তিনি উচ্চারণ করলেন এক অমর বাক্য—

“لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ”

“আপনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, আপনি পবিত্র, আমি ছিলাম সীমালঙ্ঘনকারীদের একজন।”

যখনই কোনো পরিস্থিতি আমার মুখোমুখি হয় যা আমি মেনে নিতে পারি না, যখনই আমি ভাবি কোনো দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাই, বা এমন কোনো অবস্থান ছেড়ে দেই যেখানে আমার বুকে কষ্ট লাগে—

এই আয়াত আমার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়।

এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয়— যেটিকে আমি সংকীর্ণ ভাবছি, তা হয়তো আসলে প্রশস্ত;

যেখান থেকে আমি পালাতে চাই, তা হয়তো এমন এক জায়গা, যেখান থেকে বেরিয়ে পড়লে আমি আরও বড় পরীক্ষায় পড়ে যাব যদি না তা আমার প্রভুর অনুমতিসহ হয়।

এটি আমাকে শেখায়— ধৈর্য ধরে থাকা অনেক উত্তম, সেই পলায়নের চেয়ে যা আল্লাহর অনুমোদিত নয়।

তারপর আমি নিজের সঙ্গে কথা বলি, নিজেকে ধমক দিই…

তুমি তো বলো, “সতর্কতা বিশ্বাসের বিপরীত নয়”?

হ্যাঁ, সতর্কতা হচ্ছে প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা হচ্ছে সুন্নাহ।

কিন্তু সতর্কতা আর পলায়নের মাঝে একটুকু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে।

এই পার্থক্যটি শুধু সেই হৃদয় বোঝে— যে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত।

সে জানে— প্রতিটি অবস্থানই এক একটি পরীক্ষা, প্রতিটি মুহূর্তই এক একটি দায়িত্ব।

আর তুমি যেখানে আছো, সেখানে যদি আল্লাহ তোমাকে স্থাপন করে থাকেন, তবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা — এটাই প্রকৃত বিশ্বাস, বরং এটাই হচ্ছে দৃঢ় ঈমান।

সব আরামদায়ক পথই বরকতপূর্ণ নয়।

যে অবস্থানে কষ্ট হয়, সেখান থেকে সবাইকে বিদায় নেওয়ার অনুমতি নেই।

হতে পারে এমন এক সংকীর্ণ বসার স্থান— যেখানে আকাশের দরজা খুলে যায়।

হতে পারে এমন কোনো দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট— যা হৃদয়ে আলো জাগিয়ে তোলে।

হতে পারে এমন এক ধৈর্য— যার ওপর গড়ে ওঠে চিরস্থায়ী জান্নাতের প্রাসাদ।

হে প্রভু…

আমাকে শিক্ষা দাও— কিভাবে সহ্য করবো যেটা তুমি আমার ওপর নির্ধারণ করেছো।

আমাকে দান করো— যেখানে তুমি চাও, সেখানে থাকার প্রতি সন্তুষ্টি।

আমাকে অনুপ্রেরণা দাও— ইউনুস (আ.)-এর সেই প্রজ্ঞার, যখন তিনি ছিলেন মাছের পেটে।

আর আমাকে এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত কোরো না— যারা তোমার সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে…

তাদের মতো করে যেন আমি এমন কোনো স্থান থেকে পলায়ন না করি— যেখান থেকে পালিয়ে আমি পড়ে যাই আরও ভয়াবহ এক পরীক্ষায়।

হে প্রভু! তুমি যেটুকু কল্যাণ আমার জন্য নাজিল করো, আমি তারই মুখাপেক্ষী।

——————

ক্যাটাগরি : তাজকিয়াহ / কোরআন

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *