AkramNadwi

“ইখতেলাফ বা ভিন্নমত পোষণ করা সহজ”

https://t.me/DrAkramNadwi/1353

——————–

بسم الله الرحمن الرحيم.

প্রত্যেক মত ও চিন্তায় এমন একটি দিক থাকে, যা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, অথবা যেটি আপনি ভালোভাবে বোঝেননি, কিংবা যেটিকে আপনি অযৌক্তিক মনে করেন। এরপর শুধুমাত্র ঐ একটি দিকের ভিত্তিতে আপনি সেই মত বা চিন্তার বিরোধিতা করেন এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী দিকগুলোকে উপেক্ষা করে দেন এবং মোটেই তা নিয়ে চিন্তা করেন না। ফলে এই দাঁড়ায় যে, কোনো মত বা চিন্তার বিরোধিতা করা খুবই সহজ ব্যাপার। এ কারণেই মতবিরোধে যেমন একজন বিজ্ঞ ও দূরদর্শী ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন, তেমনি অজ্ঞ ও স্বল্পজ্ঞানী লোকজনও এতে অগ্রণী হয়ে ওঠে।
এই জন্য কেবল ভিন্নমত প্রকাশ করাই কোনো ব্যক্তির জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান হওয়ার প্রমাণ নয়, এবং এটিই সঠিকতার চিহ্নও নয়। বরং অধিকাংশ ভিন্নমতই হয়ে থাকে তাড়াহুড়ো, আত্মম্ভরিতা এবং অহংকারের ফল।

অপরদিকে, কোনো মত বা চিন্তার সঙ্গে একমত হতে হলে অপরপক্ষের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা বা পড়া আবশ্যক। এরপর তার সব দিক বিবেচনায় নিতে হয় এবং প্রতিটি দিককে ওই মতপ্রকাশকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হয়। এটি একটি দীর্ঘ, সংযত ও ধৈর্য-সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় বিনয় প্রয়োজন হয়, তাড়াহুড়ো থেকে বিরত থাকতে হয়, এবং সেই সম্ভাবনার প্রতি সম্মান দেখাতে হয় যে, বিপক্ষের কথাটিই হয়তো সঠিক, এবং সমাজ ও মানুষের জন্য তার প্রভাব হয়তো অধিক কল্যাণকর।

আমরা নিচে কিছু মত ও ধারণা উদাহরণ হিসেবে পেশ করছি:

পরামর্শমূলক শাসনব্যবস্থা (শূরা) সর্বোত্তম সামাজিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি।

গণতন্ত্র শূরা-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার সফল বাস্তবায়নে সহায়ক।

বিভিন্ন প্রবণতাসম্পন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাই সবচেয়ে কার্যকর নীতি।

নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যায্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সমতা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পথ; তবে সমতার পরিধি সেইসব বিষয়ের মধ্যেই সীমিত, যেগুলো নারী-পুরুষের মাঝে অভিন্ন।

প্রত্যেক মানুষ মৌলিক অধিকার পাওয়ার উপযুক্ত এবং এই অধিকারগুলোকে রাজনীতির অধীন করা উচিত নয়; যেমন, প্রত্যেকের জন্য খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মৌলিক অধিকার।

নিপীড়িত হওয়ার পরেও পৃথিবীর প্রতিটি স্থানে সংখ্যালঘুদের জন্য সুযোগ বিদ্যমান, এবং যারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, তারা অগ্রগতির ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠদের থেকেও এগিয়ে যায়।

মাদরাসার পদ্ধতি ও পাঠ্যক্রমে সংস্কার প্রয়োজন; এ সংস্কার কোনো নেতিবাচক বিষয় নয়, বরং এর মাধ্যমে মাদরাসার উপযোগিতা বৃদ্ধি পায়।

মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, কারণ এখন মাদরাসাগুলোর মধ্যে সেই বিস্তৃততা আর নেই, যা কোনো এক সময়ে তাদের বৈশিষ্ট্য ছিল।

অন্যকে কাফের বা ফাসিক বলা ভুল কাজ; এটা কোনো ঐশী দায়িত্ব নয়, এবং এই দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এর কোনো মূল্যও নেই।

প্রতিটি যুগেই ইজতিহাদ (আলোচনা-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত) অপরিহার্য, কারণ প্রতিটি যুগে নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেয়, অথবা পুরোনো সমস্যাগুলো নতুন প্রেক্ষাপটে সামনে আসে, আর যথাযথ জ্ঞান ও বাস্তব সমাধান ছাড়া না ব্যক্তি এগোতে পারে, না জাতি উন্নতি করতে পারে।

উপরের প্রতিটি মত বা চিন্তার বিপক্ষেও বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়েছে এবং এমন লোকেরও অভাব নেই, যারা বিরোধিতায় কঠোরতা ও উগ্রতা অবলম্বন করে।

যদি আপনি এই বিরোধিতার কারণ ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন, অধিকাংশ মানুষ ভিন্নমতকে কোনো দায়িত্ব মনে করে না, না তারা এতে সততা বজায় রাখে, না তারা নিজেদেরকে পরকালীন জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত রাখে। তাদের কাছে এটা জরুরি নয় যে, তাদের বিরোধিতা জ্ঞান ও গবেষণার ভিত্তিতে গঠিত হোক; বরং তারা কোনো মত বা চিন্তাকে মূল্যহীন প্রতিপন্ন করতে, তা থেকে নিষ্কৃতি পেতে এবং অন্যদেরকে তা থেকে বিমুখ করতে বিরোধিতাকে সবচেয়ে সহজ পন্থা হিসেবে গ্রহণ করে।

কিছু মানুষ উপরোক্ত মতগুলোর বিরোধিতা করে এই কারণে যে, সেগুলো তাদের প্রথাগত রীতিনীতির পরিপন্থী, কিংবা তাদের পূর্বপুরুষদের পথের বিপরীত, অথবা তাদের কাছে এতে আধুনিকতার গন্ধ রয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে তাদের তৎক্ষণাৎ এবং তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই যথেষ্ট প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় যে, এই সব মতামত ভিত্তিহীন।

আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন: – আপনি কি এই মত ও চিন্তাগুলো ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছেন? – আপনি কি এ সম্পর্কিত প্রামাণিক লিখিত বক্তব্য পড়েছেন? – আপনি কি এই মতগুলোর পক্ষে প্রদত্ত যুক্তিগুলো বুঝেছেন? – আপনি কি এই মতপ্রকাশকারীদের সামনে আপনার সংশয় বা আপত্তি তুলে ধরেছেন?

তাহলে আপনি বিস্ময়ে দেখবেন, এই প্রশ্নগুলোর প্রায় সব কটিরই তাদের উত্তর হবে ‘না’।

এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ কত সহজে অন্যের বিরোধিতা করে বসে। অথচ তারা যদি একটু সময় দিত, এবং সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করত, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একমত হওয়া সম্ভব হতো, কিংবা অন্তত বিরোধিতার তীব্রতা কমে যেত।

এটি বোঝা জরুরি যে, বিরোধিতা একটি দায়িত্ব। আমাদের বিরোধিতার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকতে পারে। আমাদের বিরোধিতার ফলে আমাদের জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। আর কিয়ামতের দিনে আমাদেরকে এই বিরোধিতা ও ভিন্নমতের জবাবদিহি করতে হতে পারে।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *