AkramNadwi

প্রতিসাম্য (Symmetry) ও পরিপূরকতা (Complementarity): মানুষ ও বিশ্ব গঠনে ঐক্য ও ভিন্নতার দ্বান্দ্বিকতা।

https://t.me/DrAkramNadwi/6221

بسم الله الرحمن الرحيم.

——————–

বিশ্বের গভীরে, জীবনের কাঠামোতে এবং মানুষের মনের গহনে দুটি মহান নীতির প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এ দুটি ছাড়া কিছুই টিকে থাকতে পারে না, এ দুটি ছাড়া অস্তিত্বের কোনো সুসংগত রূপ থাকতে পারে না: প্রতিসাম্য এবং পরিপূরকতা। এ দুটি নীতি পরস্পরের সঙ্গে জড়িত, যার মাধ্যমে সকল সত্তা ভারসাম্যপূর্ণ হয়, বিপরীতগুলো আলিঙ্গন করে এবং ভিন্নতার গর্ভ থেকে সবচেয়ে মধুর সমন্বয়ের জন্ম হয়।

প্রতিসাম্য হলো পরিপূর্ণতার একটি রূপ, যা অনুপাত ও সমন্বয় প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে অংশগুলো একটি সুরেলা ঐক্যে প্রতিফলিত হয়, যা সমগ্রকে আকৃতি ও অর্থে সুসংগত করে। এটিই প্রজাপতির ডানা দুটিকে পরস্পরের প্রতিচ্ছবি করে তোলে, ইসলামি নকশায় অপরূপ সৌন্দর্য প্রদান করে যা কখনো ক্লান্ত করে না, এবং এটিই আমরা প্রতিসম দেহে এবং মুখমণ্ডলে দেখি, যেগুলো যত বেশি প্রতিসাম্যের কাছাকাছি হয়, দর্শকের চোখে তত বেশি সুন্দর মনে হয়।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রতিসাম্য হলো স্থিরতা ও শৃঙ্খলা বোঝার ভিত্তি। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাবলি রূপান্তরের মধ্য দিয়েও কাঠামোর বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করে, যা অভ্যন্তরীণ গভীর একটি শৃঙ্খলার ইঙ্গিত দেয়। আর শিল্পকলায়, প্রতিসাম্য নকশা যে কোনো স্থাপনা বা চিত্রকর্মকে দেয় ভারসাম্য ও প্রশান্তির অনুভব—যেখানে চোখে লাগে না কোনো বিচ্যুতি, আর হৃদয়ে জাগে না অস্থিরতা।

এই ধারণা নৈতিক ও সামাজিক পরিসরেও প্রসারিত—যেখানে প্রতিসাম্য প্রতিফলিত হয় ন্যায়ের মানদণ্ড, সমতার ধারণা, “পারস্পরিক আচরণ” নীতিমালা, এবং অধিকার ও কর্তব্য, স্বাধীনতা ও দায়িত্বের মাঝে ভারসাম্য রক্ষায়। এই অর্থে, প্রতিসাম্য হলো সম্পর্কগুলোর উপর গড়ে ওঠা ন্যায়কাঠামো, যা সত্তাগুলোকে ভারসাম্যে রাখে—যাতে এক অংশ অপর অংশকে ঢেকে না ফেলে।

আর পরিপূরকতা হলো এই কাঠামোর প্রাণ, এমন এক জীবন যা জন্ম নেয় ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মিলনে। এটি প্রতিসাম্য বিপরীত নয়; বরং এর অন্য দিক, এমন এক সঙ্গী যা ছাড়া প্রতিসাম্য অসম্পূর্ণ। যখন প্রতিসাম্য গুরুত্ব দেয় মিল ও সাদৃশ্যকে, তখন পরিপূরকতা মনোযোগ দেয় পার্থক্য ও বৈচিত্র্যের প্রতি—এবং সেসব ভিন্নতা কীভাবে একত্রিত হয়ে গঠন করে আরও গভীর ও সমৃদ্ধ একতা।

কোয়ান্টাম ফিজিক্সে এই অর্থ আমরা দেখতে পাই, যখন কণাগুলো একবার দেখা দেয় তরঙ্গরূপে, আবার কখনো কণারূপে—দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে। দর্শনে, এই পরিপূরকতা প্রতিফলিত হয়েছে “ইন ও ইয়াং” (الين واليانغ) -এর প্রতীকীতে—যেখানে বিপরীত সত্তাগুলো সহাবস্থান করে, লড়াইয়ের জন্য নয়, বরং একে অপরকে পূর্ণ করে তোলার জন্য, এবং বিশ্বজগতের ভারসাম্য রক্ষার জন্য।

মানবিক সম্পর্কগুলিতে পরিপূরকতার সবচেয়ে উজ্জ্বল রূপ আমরা দেখতে পাই—যখন যুক্তি মিলে হৃদয়ের সঙ্গে, শক্তি মিলে কোমলতার সঙ্গে, আর জ্ঞান মিলে প্রজ্ঞার সঙ্গে। সফলতা জন্ম নেয় না শুধু দক্ষতার সাদৃশ্য থেকে, বরং বৈচিত্র্য ও পরস্পর পূরণশীলতার মধ্য দিয়ে। যে সম্পর্ক পরিপূরকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তা হয় গভীর ও পরিপক্ব—যেখানে পার্থক্যকে শ্রদ্ধা করা হয় এবং তা হয়ে ওঠে শক্তির উৎস, প্রতিযোগিতার নয়।

আবু দাউদ, তিরমিজি ও দারিমির বর্ণিত এক হাদিসে আমরা এই অর্থের প্রতিফলন দেখতে পাই—উমর ও আবু বকর (রাযি.)-এর কাহিনিতে, যখন নবী (সা.) সাহাবিদের সদকা দিতে আহ্বান জানান। উমর আনেন তার অর্ধেক সম্পদ, আর আবু বকর আনেন সবটুকু। দু’জনই উত্তম কাজ করেন, আর উভয়ের সদকা-ই স্বতন্ত্রভাবে পরিপূর্ণ ও সুন্দর—একটির কারণে অন্যটির মর্যাদা কমে না, এবং একে অপরকে ছাপিয়ে যায় না। এটি সমমিতার মানবিক রূপ—যেখানে ভালো কাজগুলো এক পাল্লায় আসে, কিন্তু একে অপরের তুলনায় কম বা বেশি হয় না।

কিন্তু যদি আমরা নবী (সা.)-এর উদ্দেশ্যের দিকে তাকাই, দেখতে পাই তিনি এমন কিছু চাচ্ছিলেন যা একজন বা দুজনের সদকায় পূর্ণ হয় না—বরং প্রয়োজন ছিল সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার। এখানেই পরিপূরকতা প্রকাশিত—যেখানে বিভিন্ন সদকা একত্র হয়ে সহায়তা করে একটি বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনে। প্রতিটি দান অবদান রাখে লক্ষ্যে পৌঁছাতে—কিন্তু একটিও অপরটির বিকল্প নয়।

সমাজ কাঠামোয়, প্রতিসাম্য ন্যায়ের ভিত্তি: অধিকারে সমতা, সুযোগে সমতা, এবং আইনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা। কিন্তু পরিপূরকতা এমন এক শক্তি যা দায়িত্ববণ্টনের ভিন্নতা থেকে গঠিত হয়: কর্মী ও পরিচালক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, শাসক ও প্রজার মাঝে। প্রত্যেকেই এমন একটি ভূমিকা পালন করে যা ছাড়া জীবন পূর্ণ হয় না। এইভাবে, ন্যায় ও দায়িত্বের, অধিকারসমতা ও ভূমিকার পরিপূরকতার মধ্যকার যোগসূত্রে জন্ম নেয় একটি সংহত সমাজ—যা অভিন্ন নয়, কিন্তু সুরেলা; যা একইরকম নয়, কিন্তু সমন্বিত।

ধর্মেও এই দুই নীতির প্রকাশ সুস্পষ্ট। প্রতিসাম্য প্রতিফলিত হয় নৈতিক মূলনীতি ও ধর্মগুলোর অভিন্নতার মাঝে, আর ইলাহী গুণাবলীর ভারসাম্যে—যেমন দয়া ও ন্যায়, শক্তি ও প্রজ্ঞা। পরিপূরকতা দেখা যায় আল্লাহ ও বান্দার সম্পর্কে—যেখানে দাসত্বের জবাবে আসে করুণা ও দেখভাল। আর আত্মা ও দেহের সম্পর্কেও—যেখানে উভয় মিলেই গড়ে ওঠে মানুষের পরিপূর্ণ অভিযাত্রা।

পরিবারে, যা সমাজের প্রাথমিক কোষ, আমরা প্রতিসাম্য দেখি মৌলিক অধিকারগুলোতে: নারী-পুরুষ, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন সবার জন্য। কিন্তু পাশাপাশি আমরা দেখি পরিপূরকতাও—দায়িত্ববণ্টনে, ভূমিকার বৈচিত্র্যে—যা পরিবারের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করে। প্রতিটি সদস্যের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভা, আর যদি তা ব্যবহৃত হয় বোঝাপড়া ও পরিপূরকতার কাঠামোয়, তবে গড়ে ওঠে এক সুদৃঢ় ঘর—যা মতবিরোধ বা দুর্বলতার ঝড়ে ভেঙে পড়ে না।

প্রতিসাম্য হলো কাঠামো, যার উপর দাঁড়িয়ে থাকে শৃঙ্খলা, আর পরিপূরকতা হলো প্রাণ, যা এনে দেয় সেই কাঠামোয় জীবন। এ দুয়ের মিলনেই গঠিত হয় পূর্ণ সত্য। সৌন্দর্য জন্ম নেয় শুধু মিল থেকে নয়, বরং পার্থক্য যখন আলিঙ্গিত ও পরিচালিত হয়, তখন তার সৃষ্ট সুরেলতা থেকেই। আমাদের পৃথিবীকে প্রয়োজন অনুরূপতা নয়, বরং বোঝাপড়া; প্রয়োজন মিল নয়, বরং পরিপূরকতা।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *