https://t.me/DrAkramNadwi/6182
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
——————–
সমরকন্দের একটি মহল্লা ‘রেগিস্তান’ নামে প্রসিদ্ধ। প্রাচীন যুগে এখানে তিনটি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, যেখানে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি ও ফিকহের এমন মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হতো, যার তুলনা সে যুগে আর কোথাও ছিল না। পূর্ব দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো আজও বিদ্যমান, যদিও বহুদিন থেকে সেখানে শিক্ষার ধারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটির প্রধান ফটকে দুটি ভয়ানক সিংহের ছবি আঁকা আছে, যাদের সামনে একটি হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। বলা হয়, সিংহগুলো ছাত্র, আর হরিণ হলো জ্ঞান—অর্থাৎ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা প্রবেশ করে, তাদের জ্ঞান শিকার করতে শেখানো হতো। হতে পারে ছবির বার্তা এইটাই ছিল। কিন্তু এখন সেই সিংহসদৃশ মানুষদের মাঝে জ্ঞান ও গবেষণার চর্চা নেই। মাদ্রাসার জৌলুশ ঠিকই আছে, কিন্তু না আছে সিংহ, না আছে হরিণ।
আজ উপমহাদেশে মাদ্রাসার অভাব নেই, কিন্তু সেখানে না ইতিহাস পড়ানো হয়, না সীরাত, না ভূগোল, না গণিত, না জ্যোতির্বিজ্ঞান, না সমাজবিজ্ঞান, না আধুনিক কোনো বিজ্ঞান। ‘নকলী’ ও ‘আকলী’ শাস্ত্রের নামে কিছু শুকনো বই পড়ানো হয়। সেই বইগুলোর জটিল বাক্য বোঝাকে কৃতিত্ব ভাবা হয়, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান ও বিদ্যার কোনো চর্চা হয় না। আপনি যদি এখানকার মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বলেন, আপনি শুধু ফাঁকা শূন্যতাই দেখতে পাবেন।
একটি প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা থেকে ফারেগ (স্নাতক) একজন ফিকহের শিক্ষক একবার আমাদের সম্মানিত উস্তায মাওলানা আবুল উরফান নাদভী (রহ.)-এর কাছে মাওয়ারাউন্নাহর অঞ্চলের কোনো শহরের অবস্থান জানতে চাইলেন। মাওলানা সাহেব বিস্তারিত বললেন যে, সেই শহরের চারপাশে কী কী এলাকা অবস্থিত। তখন সেই শিক্ষক বললেন, “মাওলানা, দয়া করে সেই জায়গাগুলো নির্দিষ্ট করে দিন।” মাওলানা দুঃখের সঙ্গে বললেন, “আপনাকে কী বোঝাই? আপনি তো সেই প্রাথমিক তথ্যই জানেন না, যার ওপর আমার কথাগুলো বোঝা নির্ভর করে।”
পাকিস্তানের এক প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা জাহিদুর রশিদী একবার আমাকে বলেছিলেন, “মাদ্রাসা থেকে যারা পড়ে বের হয়, তাদের এইটুকুও জানা নেই যে বদর ও উহুদের যুদ্ধ কোনটি আগে হয়েছিল আর কোনটি পরে। যখন সীরাতের এত সহজ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই, তখন তারা সীরাতের বিশদ জ্ঞান বা ‘ফিকহে সীরাত’ কিভাবে অর্জন করবে?”
অনেকবার আমার সুযোগ হয়েছে মাদ্রাসা পড়ুয়া ফারেগদের সঙ্গে কথা বলার—তারা উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক-শায়েরদের সম্পর্কেও কিছু জানে না। ইকবাল সম্পর্কে শুধু কিছু হালকা ধরনের কবিতা গুনগুন করে, কিন্তু গালিব ও জওক তাদের পাঠ্যসীমার বাইরের। স্যার সায়েদ, শিবলী, হালী, হাসরাত, ফানি, আসগর, জিগর এরা তাদের কাছে অপরিচিত। তারা তো মেহদী আফাদি, মজনু গোরখপুরী, রশীদ আহমদ সিদ্দীকীর নামও শোনেনি। যখন উর্দু সাহিত্যে এই অবস্থা, তখন আশা করা যে তারা মুস্তফা লুৎফী মন্ফালূতী, আর-রাফিই, আস-সাবাঈ, ত্বাহা হুসাইন, আহমদ আমীন, আলী তানতাওয়ী, শাওকী, হাফিজ ইবরাহিম প্রমুখকে চিনবে—এটা তো অসম্ভব কল্পনা।
উপমহাদেশে ভবনের নাম মাদ্রাসা—প্রত্যেক মুহতামিমের চিন্তা কেবল এই যে সে কতগুলো দালান বানাতে পারল, কতগুলো মিনার ও গম্বুজ নির্মাণ করল, মেহমানখানা কেমন হলো, মাদ্রাসার গাড়িগুলো দেখতে কেমন! যে টুপি-কুর্তা-পায়জামা পরে, সে ছাত্র, আর যে পাগড়ি বাঁধে, সে শায়খ বা মুফতি! দালান আছে, কিন্তু কোনো শিক্ষা নেই। টুপি-কুর্তা-পায়জামা আছে, কিন্তু না আছে সিংহ, না আছে হরিণ। কে বোঝাবে যে পাগড়ি বাঁধলেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আসে না।
ইসলামের ওপর যেসব আক্রমণ হচ্ছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হলো—যা বুদ্ধি ও চিন্তার দিক দিয়ে হচ্ছে। যদি আমরা আমাদের ছাত্রদের চিন্তা করতে না শিখাই, যদি তাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ না দিই—তাহলে আমরা নিজেরাও এই ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকতে পারব না, আর অন্যদেরও রক্ষা করতে পারব না। তারা শুধু ইট-পাথরের দালান তৈরি করবে এবং মিথ্যা বলে সেগুলোকে ‘মাদ্রাসা’ বলবে—যেখানে না থাকবে জ্ঞান, না থাকবে বিদ্যা।
এই মাদ্রাসাগুলোতে সময় কাটানো ছাত্রদের অবস্থা ঠিক সেই বাবার মতো হবে, যে নিজের ছেলের নাম রেখেছিল ‘সিংহ’—আর একদিন তাকেই নেকড়ে খেয়ে ফেলল।
——————–
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।