https://t.me/DrAkramNadwi/2014
بسم الله الرحمن الرحيم.
——————–
কোনো একটি জ্ঞানচর্চা, চিন্তাভাবনা বা সাহিত্যিক সৃষ্টির প্রকৃত মান নির্ধারণে জ্ঞানী ও চিন্তাশীলদের মাঝে যে পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য ও প্রচলিত, তা হলো গঠন মূলক সমালোচনা এটি একটি ইতিবাচক পন্থা, যার মাধ্যমে শুধরে দেওয়া ও সংশোধনের পাশাপাশি জ্ঞানের কাফেলা নতুন নতুন গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
সমালোচনা, তা অনুকূল হোক বা প্রতিকূল—উভয় ধরণের রচনার জন্যই সমান উপকারী। কিন্তু মাদরাসা থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা এই সম্মানজনক শিল্প থেকে বঞ্চিত। আমাদের আলেমগণ সমালোচনার বদলে প্রত্যাখ্যানে (তরদীদ) বেশি আগ্রহী। তারা যা কিছু সমালোচনার নামে লেখেন, সেগুলোও মূলত প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই পড়ে।
প্রত্যাখ্যানের উপকারিতা খুবই সীমিত। এর মাধ্যমে না তো কোনো সংশোধন হয়, না কোনো জ্ঞান বা শিল্পকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়।
দুঃখজনক হলো, আমাদের আলেমগণ যেসব জিনিস ‘প্রত্যাখ্যান’ নাম দিয়ে তুলে ধরছেন, সেগুলো প্রকৃত প্রত্যাখ্যানের মানদণ্ডেও উত্তীর্ণ নয়। বরং সেগুলোতে রাগ ও বিদ্বেষ প্রকাশ পায়, অপমানজনক শব্দ ব্যবহৃত হয়, এমনকি গালমন্দ, দলাদলি, ব্যঙ্গবিদ্রুপও পাওয়া যায়। এ ধরনের কথাবার্তা শুধুই শত্রুতা বাড়ায়, বিভাজন সৃষ্টি করে। এসবকে বরং মানহানি, কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা বা অপবাদ বলাই বেশি উপযুক্ত হবে।
ইসলামের ইতিহাসে মানসম্পন্ন ও গবেষণাধর্মী প্রত্যাখ্যানের কিছু উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে পক্ষপাতহীনতা ছিল এবং গালাগালি, অবজ্ঞা ও বিদ্রুপ থেকে পুরোপুরি পরিহার করা হয়েছিল। যেমন:
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীর “কিতাব আল-হুজ্জা আলা আহল আল-মাদিনা”
ইমাম শাফঈ’র “কিতাব আল-উম”-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত “আল-রাদ্দ আলা মুহাম্মদ ইবনে হাসান”
ইমাম ইবনে আবি শায়বাহর “আল-মুসান্নাফ”-এর অংশ “আল-রাদ্দ আলা আবি হানিফা” সমসাময়িক কালে এ বিষয়ে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কাজ হলো মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভীর লেখা “রদ্দে কাদিয়ানিয়্যাত,” যা সত্যিই উচ্চমানের।
যেসব লেখা প্রত্যাখ্যানের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়, তার মধ্যে ইমাম গাজালীর “তাহাফুতুল ফালাসিফা” রয়েছে, আর তার চেয়েও দুর্বল হচ্ছে আল্লামা ইবনে রুশদের “তাহাফুতুত তাহাফুত”।
এই দুটির বিপরীতে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার “আল-রদ্দ আলা আল-মান্তিকিয়্যিন” (যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে প্রত্যাখ্যান) হলো বিশ্বস্তরে প্রথম সারির একটি প্রত্যাখ্যানমূলক গ্রন্থ। এমনকি ইমাম ইবনে তাইমিয়া শিয়া, খ্রিস্টান, দার্শনিক ও কালামবিদদের বিরুদ্ধে যে সকল প্রত্যাখ্যানমূলক গ্রন্থ লিখেছেন, সেগুলোও সবই মানসম্পন্ন।
এখন প্রশ্ন হলো, একটি মানসম্পন্ন প্রত্যাখ্যানের শর্তগুলো কী ? নিচে সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো। আপনি যদি এগুলো মেনে চলেন, তাহলে আপনার প্রত্যাখ্যান সফল হবে। সাধারণ পাঠকরাও আপনার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অনুরক্ত হবে, যে চিন্তার প্রত্যাখ্যান করছেন তা প্রভাব হারাবে, এমনকি বিরোধী পক্ষও আপনার বক্তব্যকে সম্মানজনক বলে গণ্য করবে।
১. আপনার প্রত্যাখ্যানমূলক লেখার ভূমিকায়, মূল অধ্যায় বা উপসংহারে এমন কিছু লিখবেন না যাতে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত আক্রমণ হয়। এমন কিছু বিষয়েও মন্তব্য করবেন না, যার সঙ্গে মূল আলোচনার কোনো সম্পর্ক নেই। তার উপস্থাপন ও প্রমাণগুলোকে হেয় করবেন না, এবং রাগ প্রকাশ করবেন না।
২. আপনি যে লেখাটির প্রত্যাখ্যান করছেন তা শান্তভাবে পড়ুন। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝুন, তার যুক্তিগুলো পর্যালোচনা করুন। এরপর সম্পূর্ণ সততা ও ন্যায়বোধ নিয়ে তার দুর্বল মতামত ও দুর্বল প্রমাণগুলো একত্র করুন, এবং শক্তিশালী যুক্তির আলোকে শান্তভাবে সেগুলোর জবাব দিন। খেয়াল রাখবেন—আপনার জবাব পরিষ্কার ও সুসংহত হতে হবে।
৩. যে গ্রন্থটি আপনি প্রত্যাখ্যান করছেন, যদি তার ভালো দিকগুলো বেশি থাকে—তাহলে ন্যায়বিচার বজায় রেখে বলবেন যে, “এই বইয়ের ৭০% বা তার বেশি বা কম অংশ সঠিক।” এতে করে আপনার জবাব কেবলমাত্র আপত্তিকর বিষয়গুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং আপনি অন্যায়ের শিকার হবেন না।
৪. এই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে মাথায় রাখবেন যে, প্রত্যাখ্যানের সময় মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, কেউ যদি আপনার বক্তব্যের জবাব দিয়ে আপনার মিথ্যা উন্মোচন করে দেয়, তবে মানুষের আস্থা আপনার থেকে সরে যাবে, এমনকি আপনার সঠিক কথাগুলোকেও মানুষ গুরুত্ব দিবে না।
আপনারা মাদ্রাসার ছাত্র, পাঠদানের সময় হয়তো আপনারা আপনাদের শিক্ষকদের অন্যদের খণ্ডন করতে দেখেন, কিংবা খণ্ডনের বিষয়ে তাঁদের লেখালেখি পড়েন। যদি তাঁদের বক্তৃতা বা লেখাগুলো মানদণ্ডে উত্তীর্ণ না হয়, তাহলে তাদের অন্ধ অনুসরণ করবেন না; বরং সাহসের সঙ্গে যুক্তিসহ তাদের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করুন।
আমরা প্রাচ্যবিদদের খণ্ডন করি, পাশ্চাত্য দার্শনিকদের পেছনে লাগি, এবং আধুনিকতাবাদী লেখকদের জবাব লিখি। সাধারণ পাঠক যখন তাদের বইগুলো পড়ে, তখন সে প্রভাবিত হয়ে পড়ে, আর আমাদের খণ্ডনগুলো তার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়, কারণ আমাদের মান তাদের তুলনায় অনেক নিচে থাকে।
ইসলামের শত্রুদের ছেড়ে দিন, আমরা যখন আমাদের মুসলিম ভাইদের খণ্ডন করি, তখন না ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের কথা মনে রাখি, না মানবিক সম্মানের বিষয়টি বিবেচনায় আনি। কাউকে দেওবন্দি বলে রাগ প্রকাশ করি, কাউকে বেরলভি , ‘গায়ের মুকাল্লিদ’ বা ‘আহলেহাদীস’ আখ্যা দিই, কাউকে ‘তালফীক’-এর অভিযোগ দিই, কাউকে ‘ইজতিহাদ’-এর নামে ব্যঙ্গ করি। আমরা ভুলে যাই যে, এ ধরনের অশালীন ও অশোভন আচরণে হয়তো অল্প সময়ের জন্য নিজেদের গণ্ডির মধ্যে আনন্দ পাওয়া যায়, কিন্তু এতে অন্যের যুক্তিবদ্ধ চিন্তাকে ছড়ানো থেকে রোধ করা যায় না।
সারকথা এই যে, গম্ভীর লেখার উত্তর হওয়া উচিত জ্ঞানগর্ভ ও গবেষণামূলক। যদি আমরা সেটা করতে না পারি, তাহলে চুপ থাকাই শ্রেয়; অন্যথায়, আমরা আমাদের মর্যাদা হারাবো, নিজেদের চিন্তাধারাকে রক্ষা করতে অক্ষম হবো, সেই চিন্তার সংকোচনের কারণ হয়ে উঠবো, আর বিরোধী চিন্তার পরিধি আরও প্রসারিত হতে থাকবে। মনে রাখবেন, জ্ঞানের জবাব জ্ঞান দিয়ে হয়, এবং প্রমাণের খণ্ডন প্রমাণের মাধ্যমেই সম্ভব। জ্ঞানের জবাব যদি মূর্খতা দিয়ে, আর যুক্তির জবাব যদি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ দিয়ে দেওয়া হয়— তাহলে সেটা পরাজয় ও ব্যর্থতার স্বীকৃতি।
——————–
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ