https://t.me/DrAkramNadwi/2093
بسم الله الرحمن الرحيم
❝
——–
“বুছাইনা বলেছিল যে, সে আগামীকাল চলে যাবে,
তবে ধিক সেই আগামীকাল, কারণ এটি আমাকে কাঁদিয়ে দিয়েছে।”
এখন রমজানের শেষ দিনগুলো চলছে। আর মাত্র কয়েকদিন পর আল্লাহর এই পবিত্র অতিথি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে। এরপর এর পুনরায় আগমন হবে এক বছর পর। কতই না কষ্টদায়ক এবং বেদনাদায়ক সেই বিদায়, যে বিদায় এমন একজন আপনজনের, যার কোনো তুলনা নেই—এমন এক সঙ্গী, যার মতো আর কেউ নেই, যে সত্যিকার অর্থেই হৃদয়ের সাথি।
এক মাস ধরে প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গী,
রাত-দিনের দুঃখ-সুখের পরম বন্ধু,
সারাক্ষণ হৃদয়ের গোপন কথার নীরব শ্রোতা।
“হায়! এক পলকের মধ্যেই প্রিয়জনের সঙ্গ শেষ হয়ে গেল,
আমি তো এখনো ফুলের সৌন্দর্য উপভোগই করতে পারিনি, অথচ বসন্ত বিদায় নিল!”
এই অতুলনীয় সৌন্দর্যের মাস বিদায় নিচ্ছে, যার উপস্থিতিতে হৃদয় যেন একটি সজীব বাগানের মতো হয়ে উঠেছিল। যার কারণে চারপাশ আনন্দে ভরে উঠেছিল। কিন্তু এখন, এই মাস বিদায় নিলে সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে যাবে এবং জীবন যেন শূন্যতায় ভরে উঠবে।
প্রশ্ন হলো—এই জীবনদাতা অতিথির আগমনে, যার ডাক শুনে মৃতপ্রায় হৃদয়ও পুনর্জীবিত হয়ে ওঠে, আমরা কী অর্জন করলাম?
আমরা কি এই বরকতময় অতিথির উচ্চতর অবস্থানে নিজেদের তুলে নিতে পেরেছি? নাকি আমাদের নিচু মানসিকতা ও দুর্বল সংকল্পের কারণে আমরা এর মর্যাদাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি?
এই প্রশ্ন নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। যাতে আমরা বুঝতে পারি, আমরা কী পেয়েছি এবং কী হারিয়েছি। সাধারণত, আমরা রমজানের প্রকৃত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করি না, এবং এর আধ্যাত্মিকতা থেকে উপকৃত হওয়ারও চেষ্টা করি না। বরং, আমরা কিছু বাহ্যিক বিষয়কে রমজানের মূল উদ্দেশ্য বলে ধরে নিই—যেমন সেহরি খাওয়া, ইফতার করা এবং তারাবিহ পড়া।
আমরা এই বিষয়গুলোকে শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক রীতি হিসেবে গ্রহণ করি, এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য ও বঞ্চনার মূল কারণ। কারণ, যখন ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতীকগুলো কেবল একটি সাংস্কৃতিক চর্চা বা রীতিতে পরিণত হয়, তখন সেগুলোর আত্মিকতা নষ্ট হয়ে যায়, এবং সেগুলো শুধুমাত্র একটি প্রাণহীন কাঠামোতে পরিণত হয়।
আল্লাহর কিতাবে রমজানের রোজার উদ্দেশ্য ‘তাকওয়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাকওয়ার তিনটি মূল অংশ আছে:
১) আল্লাহভীতি: যেন আমাদের কোনো ভুলের কারণে সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট না হন। কেননা, আল্লাহর অসন্তুষ্টি দুনিয়া ও আখিরাতের ধ্বংসের সমতুল্য।
দুনিয়ার জীবন অতি সংক্ষিপ্ত ও সীমিত, তাই এখানে ক্ষতির গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম।
কিন্তু আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী। তাই সেখানে ক্ষতির অর্থ হচ্ছে জাহান্নামের আগুনে পোড়া।
আর এই শাস্তির কল্পনাই অসম্ভব! কেননা এটাই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
২) মুরাকাবা (সতর্ক দৃষ্টি): যেন আমরা নিশ্চিত থাকি যে, আমাদের কোনো কথা বা কাজ আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে নেই। বরং, তিনি আমাদের অন্তরের অবস্থাও জানেন। আমরা মানুষের কাছ থেকে অনেক কিছু লুকাতে পারি, কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে কিছুই লুকানো সম্ভব নয়। আমরা যদি অন্ধকারে, নির্জনে, মরুভূমির নিঃসঙ্গতায় কিংবা সাগরের গভীরে পাপ করি, তবুও কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টির অন্তরালে থাকবে না।
৩) আনুগত্য, অর্থাৎ এই ভয় এবং মুরাকাবার প্রভাব হলো যে, বন্দা আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত থাকে এবং পাপ ও অপরাধ থেকে বিরত থাকে। যদি আল্লাহর আনুগত্যে মনোযোগী হওয়া এবং পাপ থেকে বিরত থাকার কোনো চেষ্টাই না থাকে, তবে আমরা তাকওয়া এবং রমজানের বরকত থেকে বঞ্চিত। কতগুলো লোক আছেন যারা রমজানে গীবত, মিথ্যা বলার এবং অন্যান্য পাপ কর্মে লিপ্ত থাকেন।
তাকওয়ার ভিত্তি হলো আল্লাহর ন্যায় ও রাব্বানী হিকমাতের প্রতি বিশ্বাস, এবং ন্যায় ও হিকমাতের প্রকৃত প্রকাশ হলো আখিরাত। ন্যায় ও হিকমাত সম্পর্কে বিশ্বাস না রাখা মানে ইচ্ছাশক্তির অনুসরণ করা। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, তাকওয়ার সম্পর্ক আখিরাতের সঙ্গে, এবং রোজাদারের ও তার প্রভুর মধ্যে একটি গোপন সংযোগ থাকে। যেহেতু এই সংযোগ আলৌকিক এবং অবস্তব্য, সাধারণত আমরা এর সম্পর্কে সচেতন থাকি না।
নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রমজান মাসের রোজা, রমজান মাসের রাতের নামাজ এবং শবেক্বদরের ইবাদতের যে পুরস্কার বলেছেন, তা হলো পাপের ক্ষমা, কিন্তু তিনি কোনো দুনিয়াবি পুরস্কারের কথা বলেননি।
আমরা রমজানকে তার প্রকৃত মর্যাদা থেকে নামিয়ে এনেছি, এবং এতে দুনিয়াবি লাভ খোঁজার চেষ্টা করছি। এই দ্বীনের কোনো শিক্ষা যদি আমরা দুনিয়াবি মুনাফা এবং লাভ হিসেবে ব্যাখ্যা করি, তাহলে এই লাভ অন্যভাবে অর্জিত হতে পারে, বরং অনেক সময় এর চেয়েও বেশি লাভ পাওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক মানুষ রোজার শারীরিক উপকারিতার ওপর গুরুত্ব দেন, যদিও এটা সঠিক হতে পারে যে, রোজা না রাখার কারণে একজনের শারীরিক স্বাস্থ্য রোজাদারের চেয়ে ভালো হতে পারে, এবং তার আয়ু রোজাদারের চেয়ে দীর্ঘ হতে পারে। বরং একজন অমুসলিম এমন স্বাস্থ্যগত নিয়মগুলো
আবিষ্কার করতে পারে, যেগুলোর উপকারিতা রোজার চেয়ে বেশি।
আমরা এই দ্বীনের প্রতিটি নির্দেশনার অগ্রাহ্যতা প্রকাশ করে, তা শুধুমাত্র দুনিয়াবি লাভ ও ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছি। এই লাভ এবং ক্ষতির মধ্যে এমন কিছু নেই, যার জ্ঞান অর্জন বা প্রাপ্তি শুধুমাত্র ধর্মের ওপর নির্ভরশীল, এদের মধ্যে কোনো কিছুই ধর্ম ছাড়া পাওয়া যেতে পারে। যখন আখিরাতের বিষয়টি বাদ পড়ে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন ধর্মের গুরুত্ব শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং আচার-আচরণে পরিণত হয়।
ধর্মের আসল ভিত্তি হলো আখিরাতের উপর বিশ্বাস, এবং প্রতিটি কথা ও কাজে আখিরাতের প্রতিশ্রুতি এবং শাস্তির প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। কুরআনুল কারীম কেবল আখিরাতের পুরস্কার ও শাস্তি উল্লেখ করেনি, বরং তাদের বিস্তারিত বর্ণনা কুরআনে বহুবার এসেছে, এবং তাদের এমনভাবে চিত্রিত করা হয়েছে যেন আমরা তাদের নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের বুদ্ধি সীমিত এবং আমরা অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকি, তাই আমরা দুনিয়াবি উপকারিতা এবং ক্ষতির জ্ঞানেই সন্তুষ্ট হয়ে থাকি এবং এই বিষয়গুলোকে আমাদের প্রতিটি কাজের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ফেলি। যদিও এই উপকারিতা এবং ক্ষতি খুবই পৃষ্ঠভূমি এবং সীমিত, মানুষের কোনো ভাল কাজের প্রতিদান এই দুনিয়াতে অসম্ভব, তেমনি তার পাপ ও অপরাধের শাস্তি এখানে অসম্ভব। এক তো এখানে সঠিক বিচার নেই, দ্বিতীয়ত, এখানে মানব জীবনের সীমিত সময় এবং শক্তির সাথে কোনো উপভোগ্য কিছু সঠিকভাবে পাওয়া সম্ভব নয়।
আপনি রমজানের বাকি দিনগুলিতে চিন্তা এবং মননশীলতার অভ্যাসকে উন্নত করুন, আপনার দৃষ্টি ক্ষণস্থায়ী এবং প্রলোভনজনক বস্তু থেকে বাঁচিয়ে রাখুন, কুরআনে বর্ণিত আখিরাতের প্রতিশ্রুতি এবং শাস্তির বিস্তারিত অধ্যয়ন করুন, এগুলোকে আপনার বুদ্ধি এবং চিন্তার খাদ্য বানান। আপনি গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনি স্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন যে, যে ব্যক্তি আখিরাতের অস্বীকার করে, সে আল্লাহর অস্বীকারকারী, এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর ন্যায় ও হিকমতের অস্বীকার করে, তার আখিরাতের উপর বিশ্বাস দুর্বল। যাদের আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস দুর্বল, তারা রাসূলদের অনুসরণ করতে পারে না, বরং আখিরাত থেকে অবহেলা করার মানে হলো ইচ্ছাশক্তির দাসত্ব, এবং ফলস্বরূপ নামাজ, রোজা, দান, হজ্জ এবং সমস্ত ইবাদত অর্থহীন হয়ে পড়ে, এবং আমরা এগুলোর মধ্যে কোনো দুনিয়াবি লাভ খুঁজে বের করি অথবা তাদের দুনিয়াবি মুনাফাতে সন্তুষ্ট হয়ে যাই।
হে আদমের সন্তানদের হৃদয় এবং আত্মার অধিকারী! এই চিরন্তন আওয়াজটি শুনুন এবং এর মাধ্যমে চিরস্থায়ী জীবন লাভ করুন: “প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর ‘অবশ্যই কিয়ামতের দিনে তাদের প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে দেয়া হবে। সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে-ই সফলতা পাবে। আর দুনিয়ার জীবন শুধু ধোঁকার সামগ্রী।” (সুরা আলে ইমরান – ১৮৫ )
——————–
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।