( https://t.me/DrAkramNadwi/2165 )
بسم الله الرحمن الرحيم
❝
————
|| আমার কাছে একটি প্রশ্ন এসেছে—“فأنساه الشيطان ذكر ربه” এর অর্থ কী? এবং এখানে ‘সে’ অর্থে ব্যবহৃত সর্বনাম (ضمير المفعول والمجرور) কি হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর দিকে ফিরে যাচ্ছে, নাকি বাদশাহের ساقي (সাকি)-এর দিকে?
|| আমি বলি, এবং সঠিক পথের দিকনির্দেশনা একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকেই আসে—
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“ইউসুফ তাদের মধ্যে যে মুক্তি পাবে মনে করল, তাকে বললঃ তোমার প্রভুর কাছে আমার কথা বল; কিন্তু শয়তান তাকে তার প্রভুর কাছে তার বিষয়ে বলার কথা ভুলিয়ে দিল। সুতরাং ইউসুফ কয়েক বছর কারাগারে রইল। (সূরা ইউসুফ: ৪২)
অর্থাৎ, হযরত ইউসুফ (আঃ) সেই ব্যক্তিকে বলেছিলেন, যে জানত যে সে মুক্তি পাবে (অর্থাৎ বাদশাহের সাকি), তার সেই দুই সহচরদের মধ্যে থেকে, যারা স্বপ্ন ব্যাখ্যা চেয়েছিল। তিনি তাকে বললেন, “আমার কথা তোমার প্রভুর (বাদশাহ) কাছে স্মরণ করাবে,” অর্থাৎ, তার সামনে আমার বিবরণ উপস্থাপন করবে, আমার ঘটনা বর্ণনা করবে এবং আমার ওপর যে অবিচার হয়েছে তা জানাবে। কিন্তু শয়তান তাকে ভুলিয়ে দিল…
|| এখানে “فأنساه الشيطان” -এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে দুটি মত :
তাফসিরবিদদের মধ্যে এর অর্থ নিয়ে দুটি মতামত রয়েছে:
| প্রথম মত:
মহান তাফসিরকারক আবু জাফর তাবারি এবং পূর্ববর্তী অনেক আলেমের মতে, এই বাক্যটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি সংবাদ—যেখানে বলা হয়েছে, শয়তানের কারণে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মধ্যে এক ধরনের গাফলতি সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি তখন তার প্রভুর স্মরণ ভুলে গেলেন, যে স্মরণ করলে তার মুক্তি ত্বরান্বিত হতো। কিন্তু এই কারণে তিনি সামান্য এক ভুল করলেন, ফলে তার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলো এবং তিনি শাস্তি পেলেন।
| দ্বিতীয় মত:
তাবারি মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন যে, শয়তান সেই সাকি-কে (বাদশাহের মদ পরিবেশক) ভুলিয়ে দিল, যে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কথা বাদশাহর সামনে উল্লেখ করার কথা বলেছিলেন। এটি অনেক মুফাসসিরের মতামতও বটে।
—
প্রথম মতের সমালোচনা :
এই প্রথম মতটি হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে দুটি বড় অভিযোগ আনে:
প্রথম অভিযোগ:
তিনি আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পরিবর্তে একজন মানুষ (সাকি)-এর সাহায্য চেয়েছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে সাহায্য চাওয়া নবীদের জন্য শোভনীয় নয়। ফলে এটি তাদের জন্য একটি ভুল হিসেবে গণ্য হবে। এই ভুলের কারণে হযরত ইউসুফ (আঃ) শাস্তির সম্মুখীন হলেন—এমনটি বলা হয়েছে।
কিন্তু এটি এক মারাত্মক অভিযোগ। কারণ, হযরত ইউসুফ (আঃ) ছিলেন ধৈর্য ও দৃঢ়তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সর্বোত্তম তাওয়াক্কুলকারীদের একজন, সর্বদা আল্লাহর স্মরণকারী। এই ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে মূলত তাঁর ধৈর্য, আত্মসংযম এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতার শিক্ষা দানের জন্য।
আসলে, তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরতা) অন্তরের একটি কর্ম, যা মানুষের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়ার বিপরীত নয়। বরং অন্যের মাধ্যমে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করা শরীয়তে বৈধ, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা কর্তব্যও বটে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যিনি সবচেয়ে বড় তাওয়াক্কুলকারী ছিলেন, তিনিও মুসলিম ও অমুসলিমদের সহায়তা গ্রহণ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ:
শয়তান নাকি হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে তাঁর প্রভুর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এটি একটি অগ্রহণযোগ্য কথা। কারণ, হযরত ইউসুফ (আঃ) সর্বদা আল্লাহর স্মরণে থাকতেন। নবীগণ কখনোই আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল থাকেন না।
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আমার বান্দাদের ওপর তোমার (শয়তানের) কোনো ক্ষমতা নেই, কিন্তু যারা তোমার অনুসরণ করে তারা পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা হিজর: ৪২)
অর্থাৎ, শয়তান আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যদি শয়তান কোনো সামান্য কুমন্ত্রণা দেয়ও, তখনই তাঁরা সচেতন হয়ে যান। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
“যারা আল্লাহকে ভয় করে, শয়তান তাদের ছুঁয়ে দিলে সাথে সাথে তারা সতর্ক হয় এবং তখনই তারা স্পষ্ট দেখতে পায়।” (সূরা আ‘রাফ: ২০১)
এছাড়া, কুরআনে যেকোনো নবীর ছোটখাটো ভুল উল্লেখ করার পরই আল্লাহ তাদের তওবা ও ক্ষমা লাভের কথা বলেছেন। কিন্তু এখানে কোথাও বলা হয়নি যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) এই বিষয়ে তওবা করেছেন বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
এতে প্রমাণিত হয় যে, “اذكرني عند ربك” (আমার কথা তোমার প্রভুর কাছে স্মরণ করিয়ে দাও) বলা কোনো ভুল ছিল না। বরং এটি একটি বৈধ অনুরোধ ছিল, যাতে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কোনো দোষ ছিল না।
দ্বিতীয় মতের প্রাধান্য
এই দ্বিতীয় মতটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং এটি হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মর্যাদার সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই মতের পক্ষে প্রমাণ:
১️⃣ এতে শয়তানের ভুলে যাওয়ানোর বিষয়টি সাকি-র দিকে ফিরে যায়, হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর দিকে নয়। বাস্তবেও সেটাই ঘটেছিল—সাকি বাদশাহর সামনে তাঁর কথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিল। পরে, যখন বাদশাহ একটি স্বপ্ন দেখলেন, তখন সাকি হঠাৎ করে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কথা মনে করলেন।
২️⃣ যদি “اذكرني عند ربك” (আমার কথা তোমার প্রভুর কাছে বলো) বলা হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কোনো ভুল হতো, তাহলে কুরআনে বলা হতো “وقد أنساه الشيطان”, যা একটি ‘হালিয়াহ’ বাক্য। কিন্তু তা বলা হয়নি।
৩️⃣ এটি আল্লাহর নির্ধারিত কারণ-ফলাফল পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাস্তবতাও এটাই ঘটেছে—বাদশাহর নির্দেশ ছাড়া তিনি কারাগার থেকে বের হতে পারেননি, এবং বাদশাহ তাঁকে মুক্তির নির্দেশ দেন তখনই, যখন সাকি তাঁর কথা বলেছিল।
৪️⃣ প্রথম মতটি মানলে বোঝা যায় যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) কয়েক বছর ধরে আল্লাহর স্মরণ ভুলে ছিলেন! এটি নবীদের জন্য একটি চরম অসম্মানজনক অভিযোগ।
৫️⃣ ভুলে যাওয়া কোনো পাপ নয়, যা আল্লাহ কাউকে শাস্তি দেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর তুমি জালিমদের সাথে বসো না।” (সূরা আন‘আম: ৬৮)
এখানে ‘ভুলে যাওয়া’-কে কোনো পাপ বলা হয়নি।
আমরা যে দ্বিতীয় মতটিকে প্রবল মনে করেছি, তার ওপর একটি ভাষাগত আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। আপত্তিটি হলো: যদি সাকি সর্বনামটির প্রত্যাবর্তনস্থল হতো, তাহলে বলা হতো: “فأنساه الشيطان ذكر يوسف عند ربه”। এই অর্থ গ্রহণ করলে বাক্যে দুটি সংক্ষিপ্তকরণ প্রয়োজন হয়।
উত্তর হলো—মাসদার (মৌলিক ক্রিয়ামূল) দুর্বল কর্মশক্তিসম্পন্ন, এবং তার এই দুর্বলতা লাঘব করতে পারে তার কর্মপদের সাথে সংযুক্তি। যখন মাসদারের একাধিক কর্মপদ থাকে (যেমন: কর্তা, কর্ম এবং অবস্থা), তখন একটিকে সংযুক্ত করে অপরটি বিলুপ্ত করা বৈধ হয়।
এই আয়াতে প্রথম সংক্ষিপ্তকরণ হলো কর্মপদের (মাফউল) বিলুপ্তি, অর্থাৎ “يوسف” শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি আরবিতে খুবই সাধারণ। যেমন, তুমি বললে: “ضربتُ زيدا” (আমি জায়েদকে আঘাত করেছি), এরপর তোমাকে বলা হলো: “الضرب ظلم” (আঘাত করা জুলুম), এখানে কর্তা ও কর্ম উভয়ই লোপ পেয়েছে।
দ্বিতীয় সংক্ষিপ্তকরণ হলো অবস্থাসূচক শব্দ “عند” (কাছে) এর বিলুপ্তি। মনে রাখা দরকার যে হরফে জার এবং কিছু বিশেষ অবস্থা-নির্দেশক শব্দকে মাসদারের সংযুক্ত পদ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তাই, যখন মাসদার এমন কোনো পদে সংযুক্ত হয়, যা তার সাথে মানানসই নয়, তখন সেই হরফে জার বা অবস্থা-নির্দেশক শব্দ বাদ দেওয়া হয় এবং মাসদারকে তার লুপ্ত কর্মপদের সাথে যুক্ত করা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “قل يا أيها الناس إني رسول الله إليكم جميعا” (সূরা আল-আ’রাফ: ১৫৮)। এখানে “رسول” শব্দটি সাধারণত “إلى” (প্রতি) দ্বারা তার কর্মপদে যুক্ত হয়। কিন্তু যখন এটি সংযুক্ত হয়, তখন “إلى” বাদ দিয়ে বলা হয় “رسولكم”, যার অর্থ: “আমি তোমাদের প্রতি প্রেরিত রাসূল”।
উভয় সংক্ষিপ্তকরণের উদাহরণ:
কেউ বলল: “نجحتُ في الامتحان” (আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি)। এরপর বলা হলো: “نجاحُ الامتحان إنجاز كبير”, যার প্রকৃত অর্থ: “نجاحُك في الامتحان إنجاز كبير” (তোমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এক বড় অর্জন)।
কেউ বলল: “وصلتُ إلى المسجد مبكرا لصلاة الجمعة” (আমি জুমার নামাজের জন্য মসজিদে তাড়াতাড়ি পৌঁছেছি)। এরপর বলা হলো: “وصول المسجد مبكرا فيه أجر كبير”, যার প্রকৃত অর্থ: “وصولك إلى المسجد مبكرا فيه أجر كبير” (তোমার মসজিদে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোতে বড় সওয়াব আছে)।
কুরআন মাজিদের একটি অনুরূপ উদাহরণ:
আল্লাহ তাআলা বলেন: “وقال الذين استضعفوا للذين استكبروا بل مكر الليل والنهار إذ تأمروننا …” (সূরা সাবা: ৩৩)। এর অর্থ: “بل مكركم في الليل والنهار” (বরং তোমাদের রাত্রি ও দিনের ষড়যন্ত্র)। এখানে হরফে জার ও সর্বনাম উভয়ই বাদ দেওয়া হয়েছে।
———————
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।