AkramNadwi

আমার প্রশ্ন হারিয়ে গেছে ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5734

بسم الله الرحمن الرحيم

আমাদের একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান বন্ধু আছেন, একজন বিদ্বান ও কর্মনিষ্ঠ আলেম, তুলনাহীন ফকীহ, মাআরিফ ও হকায়িক (গভীর জ্ঞান ও সত্য) ব্যাখ্যায় ইবনে মানসুর, ইবনে আরবি ও সরমাদের উত্তরসূরি, এবং মাসলাক আহলে দেওবন্দের পক্ষে রক্ষণে সাধারণ ও বিশেষ মানুষের মধ্যে সর্বজনবিদিত ও নির্ভরযোগ্য। বিভ্রান্ত দল ও ভ্রান্ত ফেরকা ও বিভ্রান্ত গোষ্ঠীগুলোর চিহ্নিতকরণ ও খণ্ডনে এক তীক্ষ্ণ তরবারির ন্যায় শক্তিমান।

আমাদের আরেকজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান বন্ধু হলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ সালিম সাহেব। তিনি ইংরেজি ও উর্দুর একজন প্রতিভাবান লেখক এবং সমালোচক, গবেষণা ও বিশ্লেষণের ময়দানের একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার। আমরা সবসময় তার থেকে কিছু না কিছু শিখে থাকি এবং তার চিন্তার সততা ও মননের বিশুদ্ধতায় মুগ্ধ হই। তিনি একদিন প্রশ্ন করেছিলেন: “কুতুব, আবদাল, আউতাদ ইত্যাদি পরিভাষাগুলো কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে প্রচলিত ছিল?”

মুফতী সাহেব স্বভাবসিদ্ধভাবে সেই প্রশ্নের ওপর এক দীর্ঘ-প্রসারিত লেখা লিখে ফেললেন, যার মধ্যে প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না, তবে অনেক কিছু ছিল। অধ্যাপক সাহেব প্রতিবাদস্বরূপ লিখলেন: “আমার প্রশ্ন হারিয়ে গেছে”। আমরা ভাবলাম, হয়তো মুফতী সাহেব একটু লজ্জিত হবেন এবং অধ্যাপক সাহেবকে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবেন। কিন্তু মুফতী সাহেবের প্রতি কুরবান যাই! তিনি সেই ঐতিহাসিক বাক্য লিখলেন, যা কেবল কাশফ ও ইলহামের অধিকারীদের অংশ। নিজের উক্ত অপ্রাসঙ্গিক লেখার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে লিখলেন: “এই লেখার মধ্যেই খুঁজে নিন, পেয়ে যাবেন”। এটা পড়ে অধ্যাপক সাহেব এবং তার সাথে আরও অনেকে হারিয়ে গেলেন। আগে শুধু প্রশ্নই হারিয়েছিল, এখন প্রশ্নকারীও হারিয়ে গেলেন।

মুফতী সাহেবের উত্তরের চেয়ে তার যুক্তি প্রদানের পদ্ধতিতে আমরা বেশি প্রভাবিত। যুক্তির যে অবস্থা তিনি করেছেন, তাতে আমরা গভীর আনন্দিত। ইবনে তাইমিয়াহ গ্রিক যুক্তিবিদ্যার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আর মুফতী সাহেব ইবনে তাইমিয়াহ থেকে দুই কদম এগিয়ে গেছেন। তিনি সম্পূর্ণ যুক্তিবিদ্যাকে কোনো কাফন-দাফন ছাড়াই মাটির নিচে চাপা দিয়ে দিয়েছেন। মুফতী সাহেব যখন কোনো দলিল দেন, তখন আমরা এর মধ্যে ‘হাদ্দে আওসাত’ (মাঝের অংশ) খুঁজতে থাকি। কারণ মাদ্রাসায় আমাদের শেখানো হয়েছিল যে, ‘হাদ্দে আসগার’ (ছোট প্রস্তাবনা) এবং ‘হাদ্দে আকবর’ (বড় প্রস্তাবনা)-এর মধ্যকার সাধারণ শব্দ (হাদ্দে আওসাত) বাদ দিয়ে ফলাফল বের করা হয়। কিন্তু মুফতী সাহেবের যুক্তিতে আমরা সেই ‘হাদ্দে আওসাত’ খুঁজে পাই না।

এই কারণে আমরা তাকে বারবার প্রশ্ন করি। তার উত্তরে আমরা নিশ্চিতভাবেই অনেক দূরবর্তী বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি, কিন্তু ‘হাদ্দে আওসাত’ খুঁজে পাই না। যখন হতাশা অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন আমরা তার যুক্তিকে দলিল হিসেবে মানতে অস্বীকার করার অপরাধ করি। আর এই অপরাধ আমাদের জন্য সবসময় ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। আমাদের এমন অনেক বেদনাদায়ক পর্যায় অতিক্রম করতে হয়, যা সাধারণ পাঠক বুঝতে পারবেন না।

বারবার পরীক্ষার পর, যখন মুফতী সাহেবের দলিলগুলোতে আমরা ‘হাদ্দে আওসাত’ (মাঝের অংশ) খুঁজে পেতে নিরাশ হলাম, তখন আমরা ভাবলাম যে ‘ছুগরা’ (ছোট প্রস্তাবনা) এবং ‘কুবরা’ (বড় প্রস্তাবনা) নিজেরাই খুঁজে বের করি এবং সেগুলো নতুন করে সাজাই, হয়তো কোথাও থেকে ‘হাদ্দে আওসাত’ বেরিয়ে আসবে। আমাদের এই চেষ্টা আমাদেরকে “এ বসা আরজু কে খাক শুদা” (হায়, কত আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল) নামক গভীর এক বিপদে ফেলে দিল। আমরা মুফতী সাহেবের যুক্তির মধ্যে বারবার ‘ছুগরা’ দেখতে পেলাম, কিন্তু ‘কুবরা’ কখনো দেখতে পেলাম না। এটা তো স্পষ্ট যে, যখন ‘কুবরা’ থাকবে না, তখন ‘হাদ্দে আওসাত’ কোথা থেকে আসবে!

মুফতী সাহেব বলেছেন যে দেওবন্দি মাসলাক (পথ) সবচেয়ে উত্তম। আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম: মুফতী সাহেব, এর দ্বিতীয় অংশটি (দলিলের অন্য প্রস্তাবনা) বলুন, যেন আমরা সহজে ফলাফল বের করতে পারি। তিনি বললেন: দেওবন্দি মাসলাক সবচেয়ে উত্তম কারণ এটি দেওবন্দিদের পথ। আমরা বললাম: মুফতী সাহেব, এটি দ্বিতীয় প্রস্তাবনা নয়, বরং এটি প্রথম প্রস্তাবনার পুনরাবৃত্তি। তিনি এর জবাবে বললেন: আপনারা দারসে-নিজামী (প্রচলিত ইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থা) পড়ুয়াদের ঘৃণা করেন।

আমরা তো পরাজয়ের পর পরাজয় মেনে নিতে অভ্যস্ত। লজ্জার পর লজ্জা সহ্য করার অভ্যাসও আমাদের আছে। তাই আমরা বললাম: শাইখ ইউনুস দারসে-নিজামী থেকে স্নাতক ছিলেন এবং আমি তার উপর দুটি বই লিখেছি এবং অনেক প্রবন্ধ লিখেছি। তাহলে আমাদের উপর দারসে-নিজামীর শত্রু হওয়ার অভিযোগ কিভাবে আসতে পারে? তিনি বললেন: যদি আপনি শাইখ ইউনুসকে মান্য করেন, তাহলে তার একমাত্র কারণ এই যে তিনি আপনার মতোই চিন্তা করতেন। এর আগে আমরা কোনো পাল্টা কথা সাজাতে পারি, মুফতী সাহেবের মনে আরেকটি নতুন পয়েন্ট এল এবং তিনি বললেন: শাইখ ইউনুস ফিকহ…

জানতেন না। তিনি আমাদের এক শিক্ষক থেকে ফিকহের সাধারণ সাধারণ মাসআলা জিজ্ঞাসা করতেন।

আমাদের ইচ্ছা করল লিখে দেই যে, আপনার শিক্ষকের সাথে শাইখ ইউনুসের তুলনা এ রকম, যেন কেউ নূরুল ইজাহ (একটি ফিকহি বই)-এর লেখকের সাথে ইমাম বুখারির তুলনা করে। কিন্তু আমরা এই কথা বলার সাহস পেলাম না। কারণ আমরা একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিলাম যে, এর জবাবও দাঁতভাঙা হবে।

মূল প্রসঙ্গে ফিরে, আমরা মুফতী সাহেবকে বললাম: সাহাবায়ে কেরামের সময়ে কুতুব, গৌস, আবদাল, আউতাদ ইত্যাদি পরিভাষা ছিল না। তাহলে এগুলো সুফিদের মধ্যে এল কোথা থেকে? তিনি বললেন: সাহাবারা শরীয়তের জ্ঞানের ধারক ছিলেন এবং সুফিরা তাকউইনি (জাগতিক) জ্ঞানের ধারক। আমরা বলতে চেয়েছিলাম: তাকউইনি বিষয়গুলোতে ক্ষমতা প্রয়োগ করার বিশ্বাস কি শিরক নয়? কিন্তু আমরা ভয়ে চুপ হয়ে গেলাম, যদি মুফতী সাহেব আমাদের ওলিদের শত্রু বলে ঘোষণা করে দেন।

আমরা আমাদের ধারণায় তীরন্দাজের তূণীর থেকে এমন একটি তীর ছুঁড়লাম যা কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারে না। আমরা বললাম: আপনি মুখে সাহাবাদের ‘মিযানে হক’ (সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড) বলেন, কিন্তু বাস্তবে আপনি সুফিদের ‘মিযানে হক’ মানেন। মুফতী সাহেব তৎক্ষণাৎ আমাদের কথা ধরে ফেললেন এবং বললেন: আপনি কথার সঙ্গে কথা কোথায় মিলাচ্ছেন? সাহাবারা হক ও বাতিলের মানদণ্ড ছিলেন, আর এখানে তো শুধুই হকের কথা হচ্ছে। এই বিষয়ে সাহাবাদের টেনে আনা সম্পূর্ণ ভুল।

আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা হয়তো বলবেন: মুফতী সাহেবের কাছে বারবার পরাজিত হওয়ার পরও আপনি তার সঙ্গে বিতর্ক করেন কেন? এর কারণ হলো, আমাদের মুফতী সাহেবের প্রতি এক গভীর প্রেম রয়েছে। আমরা তার দর্শন করা ও তার সঙ্গে কথা বলার আনন্দ ছাড়া জীবনের কোনো স্বাদই উপভোগ করতে পারি না। তিনি যতই আমাদের উপর জুলুম করেন, যতই আমাদেরকে নির্যাতনের শিকার বানান, যতই কঠোর আচরণ করেন, আমরা তাকে ছাড়া থাকতে পারি না।

তিনি যতটা নির্দয়, ততটাই প্রিয়।
এমন কেউ ছিল না, আর কেউ কখনো হবেও না।

———
লিখেছেন :
মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী – অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *