AkramNadwi

কুরআন বোঝার গভীরতা কিভাবে তৈরি করবেন? ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/3609

بسم الله الرحمن الرحيم.

|| ভূমিকা :

গতকাল আমি “আমাদের উপর কুরআন অবতীর্ণ হওয়া” শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম, যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অধিকাংশ পাঠকই মেনে নিয়েছেন। তারা সেই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন, যা বোঝানোর জন্য এই নিবন্ধটি লেখা হয়েছিল। এতে উল্লিখিত পয়েন্টগুলো থেকে উপকৃত হয়েছেন, এবং নিবন্ধটি ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে। এটি একটি আশাব্যঞ্জক বিষয় যে, মানুষের কুরআন বোঝার আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আল্লাহ তাআলার প্রতি কোটি কোটি কৃতজ্ঞতা, যিনি কেবল তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে আমাকে কুরআনের শিক্ষার্থীদের সেবা করার সৌভাগ্য দান করেছেন।

এই নিবন্ধটি পড়ে সম্মানিত ভাই জনাব ইরফান নাসর ফারুকি নদভী উৎসাহিত হয়েছেন এবং প্রশ্ন করেছেন:
আমরা কীভাবে কুরআন বোঝার গভীরতা তৈরি করবো এবং এর থেকে আরও ব্যাপকভাবে উপকৃত হবো ? আজকের দিনটি আল-আকসা মসজিদ সফরের বরকতময় দিন, আর আমি এই পংক্তিগুলো লিখছি একটি বিমানযাত্রায়। আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি যে তিনি আমাকে সাহায্য করুন এবং আমাকে প্রবৃত্তি ও শয়তানের কুমন্ত্রণার থেকে রক্ষা করুন।

|| উত্তর :

আপনার প্রশ্ন অত্যন্ত মূল্যবান এবং প্রতিটি মুসলিমের এই প্রশ্নটি করা উচিত। কারণ আল্লাহর কিতাবে সময় ব্যয় করার চেয়ে উত্তম কোনো কাজ নেই। এটি সাহসী ও দৃঢ়সংকল্পবান মানুষদের কাজ, এবং এর জন্য অত্যধিক চেষ্টা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন।

এই প্রশ্নের উত্তরে সংক্ষেপে বলি, কুরআন বোঝার গভীরতা অর্জনের জন্য তিনটি মৌলিক ধাপ রয়েছে:

১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট,
২. বর্তমান সময়ের সাথে কুরআনের সম্পর্ক,
৩. গভীর চিন্তাভাবনা (উচ্চতর পর্যায়ের তাদাব্বুর)।

তবে এর আগে একটি ভূমিকার দিকে নজর দিন:

ভূমিকা:

এই ভূমিকা আগের নিবন্ধের মূল বিষয়ের ওপর জোর দেয়। এর কারণ হলো বর্তমানে পশ্চিমা সমাজে দ্রুত এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কুরআনকে একটি সাহিত্যকর্ম হিসেবে অধ্যয়ন করা হয়। এই প্রবণতা নতুন নয়। উপমহাদেশ ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন চিন্তাবিদও এই প্রবণতার শিকার হয়েছেন। তবে বর্তমানে এটি একটি আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। এই প্রবণতা থাকার অবস্থায় কুরআনের সঠিক তাদাব্বুর (গভীর চিন্তা) অসম্ভব। (যে সন্দেহ সৃষ্টি করে, সে কাফির হয়ে যায়)।

আমি তাদের প্রতি দুঃখিত যারা এই বিষয়টি বুঝতে পারেননি এবং ভুলভাবে ধারণা করেছেন যে এই নিবন্ধটি কোনো কবিতার বিরোধিতার জন্য লেখা হয়েছে। বরং কিছু বিভ্রান্ত ব্যক্তি ধরে নিয়েছেন যে আমি ওই সরল ও সহজবোধ্য কবিতার অর্থ বুঝিনি। যদি আমাকে আমার বক্তব্য ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে বলতে পারতাম:
“তুমি বলেছো অন্যদের কাছে, শুনেছো অন্যদের থেকে।
আমাদের কিছু বললে না, আমাদের থেকে কিছু শোনোনি।”

দুঃখজনকভাবে, আজকের দিনে বাহ্যিক বিষয়ের প্রতি এতটাই আগ্রহ বেড়েছে যে আসল কথা ছেড়ে বাইরের দিকে সীমাবদ্ধ থাকা হয়েছে। প্রায়শই সাধারণ মানুষ এমনকি শিক্ষিতরাও প্রকৃত বিপদের গুরুত্ব অনুধাবন করেন তখন, যখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

যদি আমরা বুঝতে পারতাম যে তাদাব্বুরের নামে আল্লাহর কিতাবের কী পরিমাণ বিকৃতি ও অবমাননা হচ্ছে!

মনে রাখবেন, কুরআন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর পর আর কারও উপর এটি অবতীর্ণ হয়নি এবং হবেও না। এর অর্থ এই নয় যে, কুরআন আমাদের বই নয় বা কুরআন আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। বরং এর সরল অর্থ হলো, এই কিতাব অধ্যয়ন করুন একটি নির্দেশিকা ও শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। এটিকে পড়ে আপনি নবী হতে পারবেন না। তবে আল্লাহর কিতাবের দাবি হলো, এটি পড়ে আপনি সেই মানুষে রূপান্তরিত হন, যাঁর উপর এই কিতাব নাজিল হয়েছে।

এই কিতাবের উদ্দেশ্য হলো, আপনি সেভাবে আল্লাহর ইবাদত করেন, যেভাবে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেছেন। অর্থাৎ, এই কিতাবের জ্ঞান, বোঝাপড়া এবং প্রয়োগে আপনার একমাত্র আদর্শ নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নত হওয়া উচিত।

|| ঐতিহাসিক পর্ব :

যখন এটি নিশ্চিত হয়ে গেল যে কুরআন বোঝার জন্য মূল এবং একমাত্র রেফারেন্স হলেন নবী করিম ﷺ, তখন এই রেফারেন্সটি বোঝার জন্য আপনাকে তিনটি কাজ করতে হবে:

১. কুরআনের সমসাময়িক ভাষার গভীর অধ্যয়ন:
আপনি মুয়াল্লাকাতে আশার (মুয়াল্লাকাতের দশটি কবিতা), জাহেলি যুগের কবিদের দাওয়ীন (কাব্য সংকলন), এবং জাহেলি যুগের বক্তাদের ভাষণের গভীর অধ্যয়ন করুন। মুফরাদাত (শব্দার্থ), বাক্যের গঠন ও সংগঠন সম্পর্কে পরিচিত হোন, এবং উপমা ও রূপকের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুন। এই বিষয়ে সাহায্যের জন্য আপনি রাগিব ইস্পাহানির মুফরাদাতুল কুরআন, জমাখশরির কাশশাফ, এবং মাওলানা হামিদউদ্দীন ফরাহির মুফরাদাত, আসালিবুল কুরআন, এবং জুমহুরাতুল বালাগাহ থেকে উপকৃত হতে পারেন।

২. নবী করিম ﷺ-এর জীবনী এবং তাফসিরি বর্ণনার অধ্যয়ন:
এর জন্য সহায়ক গ্রন্থগুলো হল:

সম্পূর্ণ সহীহ বুখারি (শুধু কিতাবুত তাফসির-এর উপর নির্ভর করবেন না, কারণ এটি পুরো কিতাবুল্লাহর ব্যাখ্যা)।

ইমাম তাবারির তাফসির।

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মুকাদ্দিমা ফি উসুলিত তাফসির।

মাওলানা ফরাহির ইহকামুল উসুল বি আহকামির রাসূল।

৩. কুরআনের তাফসির বির রায়-এর বিভিন্ন নমুনা:
এর জন্য ইমাম ফাখরুদ্দীন রাজির আত-তাফসিরুল কবীর উপকারী হতে পারে। পাশাপাশি, মাওলানা ফরাহির মুকাদ্দিমা ফি তাফসির নেযামুল কুরআন এবং দালাইলুন নেযাম অধ্যয়ন করুন, যা থেকে জানা যাবে কোন তাফসির বিল রায় প্রশংসনীয় এবং কোনটি নিন্দনীয়।

|| সমকালীন ধাপ :

ঐতিহাসিক ধাপের পর আপনাকে এই বিষয়টি বোঝার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে যে এই বইটি কীভাবে আপনার সমকালীন বই? কীভাবে এটি আপনার সঙ্গে কথা বলে? আপনার সময় ও স্থানে অবস্থান করে কীভাবে আপনি এটি থেকে পথনির্দেশনা পেতে পারেন? এটি আপনার যুগের সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে প্রদান করে? এই ধাপের জন্য উপযোগী কিছু বই হলো: মুহাম্মাদ আসাদ-এর আল-ইসলাম আলা মাফতারাকুত-তুরুক, মুহাম্মদ মুবারক-এর আল-ফিকরুল ইসলামি, মাওলানা ফারাহি-এর তাফসিরে নিযামুল কুরআন (শুরুতে ছোট সূরা থেকে শুরু করুন), মাওলানা মওদুদী-এর তাফহীমুল কুরআন, মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী-এর তাদাব্বুরে কুরআন, এবং সাইয়েদ কুতুব শহীদ-এর ফি জিলালিল কুরআন।

|| উচ্চতর চিন্তন :

এই দুটি ধাপ শেষ করার পর কুরআন মাজিদের আপনার নিজের একটি কপি নিন এবং সঙ্গে একটি নোটবই রাখুন। কোনো একটি সূরা, উদাহরণস্বরূপ সূরা আত-তাহরিম, মনোযোগ সহকারে পড়ুন। পড়া শেষ হলে নোটবইয়ে লিখুন যে এই সূরার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও চিত্রগুলো কী? এর কোনো কেন্দ্রীয় বিষয় আছে কি যা এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে? এই সূরার সাথে সূরা আত-তালাকের সম্পর্ক কী? সাধারণত কুরআনের সূরাগুলো জোড়ায় থাকে; দুটি সূরা একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং একইসঙ্গে একে অপরের পরিপূরক। সূরা আত-তালাক এবং সূরা আত-তাহরিমের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য খুঁজুন এবং সেই সংযোগ আবিষ্কার করুন যা তাদের একে অপরের জোড়া বানিয়েছে।
একবার এভাবে সূরাটি পড়া হয়ে গেলে আবার দেখুন। এবার অংশগুলোতে মনোযোগ দিন। কোনো নির্দেশনা পড়ার সময় ভাবুন, কেন এটি উল্লেখ করা হয়েছে? এটি পালন করলে কী লাভ হবে? এটি পালন না করলে কী ক্ষতি হবে? এরপর ভাবুন, এমন আরও কোন বিষয় হতে পারে যা মানুষের জন্য উপকারী কিন্তু কুরআনে তা উল্লেখ করা হয়নি, এবং কেন তা উল্লেখ করা হয়নি?
যখন আপনি একাধিকবার একটি সূরা অধ্যয়ন করবেন, তখন সেটিকে মাওলানা ফারাহি-এর মন্তব্যের আলোকে পড়ুন। সেসব বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিন যেগুলোর প্রতি আপনার মনোযোগ যায়নি। এরপর দেখুন, এমন কোনো বিষয় কি আছে যা আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে কিন্তু মাওলানা ফারাহি এ সম্পর্কে কিছু লিখেননি।
আপনার মনে যে প্রশ্নগুলো উঠছে কিন্তু যেগুলোর উত্তর আপনার জানা নেই, সেগুলোও নোট করুন।
সঙ্গে আল্লাহর দিকে মনোযোগ দিন, তাঁর কাছে পথনির্দেশনা প্রার্থনা করুন। তখন এমন সব অর্থ আপনার সামনে উন্মোচিত হবে যা আপনার কল্পনারও ঊর্ধ্বে। সেগুলোর তুলনায় দুনিয়ার সব আনন্দ তুচ্ছ মনে হবে এবং আল্লাহর সাথে আপনার সান্নিধ্যে এক অসাধারণ বৃদ্ধি হবে।
সংক্ষেপে, কুরআন মাজিদকে আপনার পুরো জীবন উৎসর্গ করুন। এবং ঐশী গ্রন্থ এরই যোগ্য যে জীবন তার ওপর উৎসর্গ করা হোক:
কুরআনে হও গভীর অনুসন্ধানকারী ব্যাক্তি, ওহে মুসলিম পুরুষ,
আল্লাহ করুক তোমাকে অভিনব চরিত্র দান।

———–

> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নাদভী, অক্সফোর্ড।
> অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *