AkramNadwi

ইসলাম এবং জাতপাতের প্রথা ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5588

بسم اللّه الرحمن الرحيم

লেখক: ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড।
️ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা: মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ

প্রশ্ন: দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামার শিক্ষক মাওলানা সালমান বজনূরী নদভী (আল্লাহ তার ছায়া দীর্ঘ করুন) তার এক বন্ধুর নিম্নলিখিত বার্তা পাঠিয়েছেন:

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
“ইলমী জগতের মর্যাদা এবং জ্ঞানের ধারক-ভান্ডারের প্রতীক , মহামান্য শিক্ষক! আপনার লেখনী এবং বক্তৃতার সূত্রে, আপনার ছাত্র মুহাম্মদ ইয়াহইয়া খান নদভী, ফৈজাবাদ, উত্তর প্রদেশ থেকে; আশা করি আপনি সুস্থ আছেন। আল্লাহ তাআলা আপনার বরকতের মাধ্যমে আমাকে তার কালামের সাথে সত্যিকারের সম্পর্ক এবং সঠিক উপলব্ধি দান করুন… আমীন।”

প্রশ্ন: ভারতের মুসলিম সমাজে সাধারণত এই মনোভাব রয়েছে যে ছেলে এবং মেয়ের বিবাহ নসব বা একই বংশ এবং গোষ্ঠীর মধ্যেই হতে হয়। অন্য বংশে বিবাহ করার বিষয়ে চিন্তাই করা যায় না। ধর্মীয় সততা ও ধার্মিকতার চেয়ে জাত-গোষ্ঠীকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এই প্রেক্ষাপটে জানতে চাওয়া হয়েছে যে, ইসলামে বিবাহের ক্ষেত্রে বংশে কুফু (সমতা) এর কী বিধান রয়েছে? জাত এবং গোষ্ঠীর একরূপতা রক্ষার জন্য প্রস্তাবিত পক্ষের ধার্মিকতা এবং শরিয়ত মেনে চলাকেও প্রত্যাখ্যান করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুনাহ হবে কি না, এবং পরকালে এর জন্য জবাবদিহি হবে কি না? বিশেষত, অন্য ধর্মের অনেক ছেলে এবং মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করছে, তারা কীভাবে মুসলিম সমাজে তাদের কুফু (সমতা) প্রমাণ করবে? কিতাব ও সুন্নাহর আলোকে গবেষণাপূর্ণ ও প্রমাণসমৃদ্ধ উত্তর প্রদান করে উপকৃত করবেন। (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন, আপনার মধ্যে বরকত ও অনুগ্রহ দান করুন এবং আপনার দ্বারা উম্মতের উপকার সাধন করুন।)

উত্তর: আল্লাহর নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) এবং তাদের উত্তরাধিকারীরা দুইটি মৌলিক গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন:

প্রথম গুণ: চিন্তার সাহসিকতা – অর্থাৎ তাদের চিন্তা-ভাবনা ব্যক্তিগত ইচ্ছা, জাতির অভ্যাস ও সংস্কৃতি, এবং তাদের যুগের রীতি-নীতির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত। তারা আল্লাহ তাআলা সৃষ্ট ফিতরাত বা প্রকৃতির আলোকে চিন্তা করেন, যা সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের বিচার মানুষের প্রবণতা ও ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না। এই সম্মানিত ব্যক্তিরা প্রকৃতি, বুদ্ধিমত্তা এবং ওহীকে চিন্তার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় গুণ: নৈতিক সাহসিকতা – সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্ধারণের পর তারা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা ব্যবস্থার পরোয়া না করে তা মেনে চলেন এবং তা প্রচার করেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে জাত-পাতের রোগ এমনভাবে শিরা-উপশিরায় মিশে আছে, যেমন প্রথম যুগের আরবদের শরীরে মদের প্রভাব ছিল। জাত-পাতের এই বিভেদ হাজার হাজার বছর ধরে বংশগত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষকে সম্মান বা অবমাননার মানদণ্ডই তার জাত। ইসলাম গ্রহণের পরও এখানকার জাতিগুলো এখনো এই রোগে একইভাবে আক্রান্ত। আলেম ও মাশায়েখদের প্রত্যাশা ছিল তারা এই রোগের অবসান করবেন, কিন্তু তা হয়নি। তারা নিজেদের ফিকহি বই থেকে এই রোগকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা খুঁজে বের করেছেন এবং ধর্মীয় আড়ালে তা আরও মজবুত করে তুলেছেন।

বলা হয়েছে যে বিয়েতে ইসলাম কুফু এর উপর গুরুত্ব দিয়েছে। এই ভিত্তিতে মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে, মুসলমান ধোপা, মুসলমান নাপিত, মুসলমান তাঁতি, কসাই, ধানিয়া প্রভৃতি নিম্ন বংশের অন্তর্ভুক্ত, আর সৈয়দ, মুঘল, শেখ ও পাঠান উচ্চ বংশের। এই বংশগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন স্তর আছে। জন্মগতভাবে এ জাত্যভিমান এবং বিয়েতে এর গুরুত্ব থাকা উচিত বলে সমাজে প্রচলন করা হয়েছে।

কুফুর বিষয়টি একসময় কেবল সামাজিক ছিল, উত্তরাধিকারগত ছিল না। এজন্য সাহাবা (রাযি.) এবং তাবে’ই গণ বিভিন্ন বংশের মধ্যে বিবাহ করেছেন। যেমন, হজরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) মদিনার ফকিহদের মধ্যে ছিলেন। তার পিতা কুরাইশি ছিলেন এবং তার মাতা ছিলেন ইরানি। একইভাবে হজরত আলী জাইনুল আবিদিনের ক্ষেত্রেও এমন ছিল। আমাদের পূর্ববর্তী বড়দের মধ্যে নিজেদের বংশ থেকে বের হয়ে অন্য বংশের মধ্যে বিবাহ করার এত বেশি উদাহরণ রয়েছে যে, তা গণনা করা সম্ভব নয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে এটি একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হলে এর এত তীব্রতা থাকত না। ধরুন, একজন শিক্ষক মাওলানা হলেন এবং মেয়ে কম শিক্ষিত, তবুও সেই শিক্ষক মাওলানা এই মেয়েটির জন্য যথেষ্ট নয় যদি তিনি জোলাহা (তাঁতি) বংশের হন, কারণ মেয়ে যদি শায়খ বা পাঠান বংশের হয়, তবে তাদেরকে সমান হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

এক মুফতি সাহেব তার মেয়ের জন্য একজন উপযুক্ত পাত্র খুঁজছিলেন, যিনি ভালো আলেম হলেও নাপিত বংশের ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন যেন আমি তার সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু যখন তিনি শুনলেন যে, সেই ছেলে নাপিত, তখন তিনি সরাসরি বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন।

বড় বড় আলেমদের মধ্যে এই রোগ শুধু বিয়ে পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; বরং ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক কাজেও তারা বংশের ভিত্তিতে পার্থক্য করেন। উপমহাদেশের এক বিখ্যাত বুযুর্গ তাসাউফের ক্ষেত্রে এক নিম্ন বংশের মুরীদকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও খিলাফত দেননি, কারণ মানুষ তাকে গ্রহণ করতে সংকোচ করবে বলে ভাবেন।

কারো যুক্তি হতে পারে যে নবী করিম (সাঃ) সম্মানিত পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন, তাই মুসলমানদের নেতাদেরও সম্মানিত হওয়া উচিত। কিন্তু এই যুক্তি ভিত্তিহীন। নবীগণ সব ধরনের সৃষ্টিগত ত্রুটি থেকে মুক্ত হন, অথচ অনেক ইমাম ও আলেম ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, যেমন আবদুর রহমান ইবন হুরমুজ আল-আরাজ, ইমাম ইব্রাহীম নাখাই, কাতাদা ইবনে দিআমা প্রমুখ।

হযরত উমরের শাসনকালের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাযি.) মক্কার গভর্নর নাফি ইবনে হারিসের সাথে কথা বলেছিলেন। নাফি তার প্রতিনিধি হিসেবে ইবনে আবজাকে নিযুক্ত করেছিলেন, যিনি ছিলেন এক দাস। হযরত উমর আশ্চর্য হলে নাফি তাকে জানান যে, ইবনে আবজা কুরআন এবং ফরায়েজে বিশারদ। এই সিদ্ধান্তে উমর সন্তুষ্ট হন। এবং বলেন, “তোমাদের নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ এই কিতাবের মাধ্যমে কিছু মানুষকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং কিছু মানুষকে নিচু করেন।”

যদি ওই বুযুর্গ হযরত উমরের উদাহরণ মেনে, নিম্নবংশের সেই মুরীদকে খিলাফত প্রদান করতেন, তবে তা একটি মহৎ প্রচেষ্টা হত।

আমাদের সমাজে ক্ষুদ্র বিষয়গুলোকে হক ও বাতিলের সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হয়, আর মৌলিক সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা করা হয়। বংশ ভিত্তিক পার্থক্যের কারণে ইসলাম কলঙ্কিত হচ্ছে, এবং বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে বাধা পাচ্ছেন। পশ্চিমা দেশেও নতুন মুসলিমদের সাথে বিয়েতে জাতপাতের সমস্যা থাকে।

হেদায়া বইয়ের বাণী
এমনকি আমাদের সমাজে কুফুর ধারণা ভিত্তিক জাতপাতের ঘৃণিত রোগকে লালন করা হচ্ছে, যদিও হেদায়া বইতে বলা হয়েছে যে অনারবির মধ্যে কুফুর বা সমতার কোনো মূল্য নেই। কেন এটি গোপন রাখা হয়? যদি মানুষে মানুষের সমতার উপর আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশনা গুরুত্ব পেতো, তবে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো।

❝ শেষ কথা: নবী ও তাদের অনুসারীদের দুই গুণ—বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস এবং নৈতিক সাহস। আমরা যতক্ষণ না এই দুই ধরনের সাহস কাজে লাগাচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের সংস্কার সম্ভব নয়। সংস্কার না হলে আমরা অন্যদের ইসলামে প্রবেশের পথে এবং যারা মুসলিম, তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণের পথে বাধা হয়ে থাকবো।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *