AkramNadwi

ইসলাম দু প্রকার ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/3948

بسم الله الرحمن الرحيم

লেখক: ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী,
অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

:: ইসলামী উৎস, ইসলামের ইতিহাস এবং আলেমদের লেখা ও বক্তৃতায় যখন ইসলাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তখন এটি সবসময় একই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সাধারণ মানুষ, যারা এই সত্যটি জানেন না, তারা বিভ্রান্তির শিকার হন এবং এর ফলে বহু ভুল ধারণার উদ্ভব হয়। যেখানে এক ধরনের বিবৃতি দেওয়া হয়, সেখানে অন্য ধরনের বৈশিষ্ট্য খোঁজা শুরু করেন, এবং যেখানে দ্বিতীয় ধরনের বিষয় উল্লেখ করা হয়, সেখানে প্রথম ধরনের বিধানের প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর বলা যায় যে, মূলত ইসলাম দু প্রকার :

প্রথম প্রকার :
প্রথম প্রকারটি হলো প্রকৃত ইসলাম, এটি সেই ইসলাম যা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে প্রত্যাশা করেন। এ সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে: “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে প্রকৃত ধর্ম হলো ইসলাম”। প্রকৃত ইসলাম এবং ঈমান একে অপরের পরিপূরক। ঈমান জ্ঞান এবং বুদ্ধি থেকে উদ্ভূত হয়, তারপর তা অন্তরে প্রবেশ করে। এর ফলে অন্তর আল্লাহর সামনে নত হয়। এই অন্তরের নত হওয়াকেই ইসলাম বলা হয়। যখন অন্তর মুসলিম হয়ে যায়, তখন এটি দেহের সকল অঙ্গকে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের নির্দেশ দেয়। এই ইসলাম থেকেই পাঁচটি স্তম্ভের উৎপত্তি হয়: মুখে শাহাদাত উচ্চারণ, নামাজ কায়েম, জাকাত প্রদান, রোজা রাখা, এবং হজ্ব পালন। কিন্তু যদি ঈমান না থাকে, তবে এই পাঁচটি স্তম্ভ পালন করাকে প্রকৃত ইসলাম হিসেবে গণ্য করা হবে না।

প্রকৃত ইসলামের উপর জান্নাত এবং আল্লাহর সান্নিধ্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যার মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরটি নবীদের। এই ইসলামই সেই শিক্ষা যা হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর সন্তানদের দিয়ে গেছেন।

ইসলামের এই ধরনটি শুধুমাত্র আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যেই থাকে, কারণ তিনিই মানুষের বুদ্ধি এবং অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে জানেন। এর পরিমাপের ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়নি। কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব বিচার হবে, কোনো দল বা মতবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা তখন কোনো কাজে আসবে না। যারা এই ইসলামের উপর সম্পূর্ণরূপে পূর্ণতা অর্জন করবে, তাদের মধ্যে কিছু হানাফী, কিছু মালিকী, কিছু আহলে হাদীস, কিছু সালাফী, কিছু বেরলভী এবং কিছু অন্যান্য মতবাদের অনুসারী হতে পারে। তবে এসব মতবাদের বড় একটি অংশ প্রকৃত ইসলামের পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না। অর্থাৎ প্রকৃত ইসলাম কোনো মতবাদ বা দলের উপর নির্ভরশীল নয়।

দ্বিতীয় প্রকার :
দ্বিতীয় প্রকারটি হলো বাহ্যিক ইসলাম। এই পৃথিবীতে মুসলিম ও অমুসলিম একসাথে বসবাস করে। মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন অমুসলিমদের সাথে সম্পর্কের চেয়ে ভিন্ন। আমরা কীভাবে বুঝবো কে মুসলিম এবং কে নয়? প্রকৃত ইসলামকে মানদণ্ড বানানো যায় না, কারণ তা অন্তর ও বুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত, এবং এর প্রকৃত অবস্থা কেবল আল্লাহই জানেন। তাই বাহ্যিক বিষয়গুলোকেই ইসলাম বোঝার জন্য চিহ্ন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মূলত এই পৃথিবীতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন নেই যে যাকে আমরা দুনিয়াতে মুসলিম হিসেবে গণ্য করছি, সে আল্লাহর কাছে সত্যিকারের মুসলিমও হবে। অনেক মানুষ বাহ্যিকভাবে মুসলিম হলেও মুনাফিক হতে পারে।

এই বাহ্যিক চিহ্নগুলো সময় ও স্থানের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে কিছু চিহ্ন স্থায়ী, যেমন—নামাজ, আজান, কালিমা পাঠ করা, হালাল খাদ্য গ্রহণ, পুরুষদের জন্য খতনা, এবং নবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি।

এসব বাহ্যিক চিহ্নগুলোর প্রত্যেকটি পরীক্ষা করা প্রয়োজনীয় নয়। বরং যদি কারো মধ্যে এমন কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় যা ইঙ্গিত দেয় যে সে মুসলিম, তবে আমরা তার সাথে মুসলিম হিসেবে সম্পর্ক গড়বো। যেমন বর্তমান সময়ে অনেক মুসলিম নামাজ পড়েন না, কিন্তু অন্যান্য চিহ্ন দেখে আমরা তাদের মুসলিম বলে গণ্য করি; তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই এবং তাদের জবাই করা প্রাণী খাই। যদিও নামাজ ইসলামের সবচেয়ে বড় চিহ্নগুলোর একটি, এমনকি কিছু হাদিসে নামাজ না পড়াকে কুফরের সাথে তুলনা করা হয়েছে।

নামাজের উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে প্রত্যেক চিহ্ন পরীক্ষা করা জরুরি নয়। বরং কোনো কিছু চিহ্ন থাকলেই যথেষ্ট, তা সামান্য হলেও। যখন এই কিছু চিহ্ন কারো মধ্যে পাওয়া যায়, তখন তার সাথে মুসলিম হিসেবে সম্পর্ক রাখা হবে—তার জানাজা পড়া হবে, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা হবে, এবং তার সম্পর্কে খারাপ কথা বলা বা কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা হবে। অর্থাৎ, সে মুসলিমদের সব অধিকারই পাবে।

এই বাহ্যিক চিহ্নগুলো প্রকৃত ইসলামের মতো মতবাদ বা দলের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়। মুসলিম যে কোনো দল বা মতবাদের অনুসারী হোক না কেন, তার প্রতি আমাদের সম্মান বজায় রাখা আবশ্যক। মতবাদ ও দল শুধুমাত্র প্রশাসনিক বিষয়ে প্রযোজ্য।

প্রকৃত ইসলামের সার্টিফিকেট কারো কাছে নেই:
নবীদের মাধ্যমে আল্লাহ কিছু মানুষকে জান্নাতি হিসেবে জানাতেন। নবীদের পর আল্লাহ এই জ্ঞান আর কাউকে দেননি। এখন কেউ কারো সম্পর্কে বলতে পারে না যে সে জান্নাতি বা আল্লাহর কাছে প্রিয়। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি যে আমরা তাকে এভাবে মনে করি; তবে প্রকৃত জ্ঞান কেবল আল্লাহরই আছে।

নিজেকে নিয়ে নিফাকের ভয়:
প্রকৃত ইসলামের মান এতটাই উচ্চ যে আল্লাহর যত কাছাকাছি কেউ পৌঁছায়, তত বেশি সে নিজের ব্যাপারে সন্দেহে ভোগে, যেন সে মুনাফিক না হয়ে যায়। এমন ভয় খলিফায়ে রাশেদিন, রাসূলের পবিত্র স্ত্রীগণ এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণদেরও ছিল। ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর সহীহ গ্রন্থের কিতাবুল ঈমানে হজরত হাসান বাসরী (রহ.)-এর এই উক্তি উল্লেখ করেছেন: “নিফাক থেকে একমাত্র মুমিনই ভয় পায়, আর নিফাক থেকে একমাত্র মুনাফিকই নির্ভীক থাকে।” অর্থাৎ, নিফাক থেকে শুধু মুমিনই ভীত থাকে, আর এর প্রতি উদাসীনতা কেবল মুনাফিকের মধ্যেই থাকে।
ঈমানদাররা অন্যদের সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের ত্রুটি খোঁজে, এবং সবসময় ভয়ে থাকে যে তাদের রব তাদের উপর রাগান্বিত আছেন কিনা।

অন্যদের সম্পর্কে সদয় ধারণা:
যদি কোনো মুসলিমের মধ্যে ইসলামের কিছু বাহ্যিক চিহ্ন দেখা যায়, তবে আমাদের কুরআন এবং হাদিসে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার প্রতি সদয় ধারণা রাখতে। মনে করা যেতে পারে যে তার হৃদয় আমাদের চেয়ে বেশি পবিত্র, এবং সে আল্লাহর কাছেও আমাদের চেয়ে বেশি প্রিয়। এই সদয় ধারণা কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ বা দলের অনুসারীর প্রতি সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সব মুসলিমের জন্য, সে যে মতবাদ বা দলেরই হোক না কেন।

মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান:
যখন কারো মৃত্যু ঘটে, তখন সে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়, আর আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের ভিত্তিতে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্ক শেষ হয়েছে; তাই তাকে নিয়ে কোনো তদন্তের প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের জন্য কর্তব্য হলো মৃতের প্রতি সম্মান দেখানো, তার গুণাবলি উল্লেখ করা, তার জন্য মাগফিরাত ও রহমতের দোয়া করা এবং এমন কোনো কিছু না বলা যাতে তার পরিবারের সদস্যরা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কষ্ট পায়।

সম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত:
মৃত্যুর পর দুনিয়াবি পরিচয়গুলোকে উপেক্ষা করে একজন মুসলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একজন মানুষের সম্মানবোধের প্রতীক। আর আল্লাহ সম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষদের ভালোবাসেন। এটা দেখে খুবই দুঃখ হয় যে আমরা এই সাধারণ সম্মানবোধও দেখাতে পারি না এবং মৃতের বিশ্বাস বা অন্যান্য বিষয়ে কথা বলে নিজেদের অসততার প্রমাণ দেই, এবং এভাবে আমরা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে চলে যাই।
সম্মানবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবীয় ও ইসলামিক মূল্যবোধ। আমাদের উচিত তা ভালোভাবে শেখা এবং চর্চা করা। মৃতদের সম্পর্কে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে উপমহাদেশের কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তিত্ব অনুসরণযোগ্য: স্যার সৈয়দ আহমদ খান, খাজা আলতাফ হোসেন হালী, আল্লামা সৈয়দ আবদুল হাই হাসানি, আল্লামা সৈয়দ সুলাইমান নদভী, এবং মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)। এঁরা মৃত সমসাময়িকদের সম্পর্কে যা লিখেছেন, তাতে সর্বদা তাদের গুণাবলি প্রকাশের চেষ্টা করেছেন এবং এমন কোনো কথা বলেননি যাতে মৃতদের বা তাদের সংশ্লিষ্টদের কোনো কষ্ট হয়।
আল্লাহ আমাদের সত্যিকার অর্থে সম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ এবং মুসলিম বানান। আমিন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *