AkramNadwi

কুরআন সম্পর্কে আরও তিনটি প্রশ্ন

https://t.me/DrAkramNadwi/5532

بسم الله الرحمن الرحيم

::

:: ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী,
অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

নতুন দিল্লি থেকে মাওলানা আবু ফাহাদ নদভী সাহেব কুরআন সম্পর্কে আরও তিনটি প্রশ্ন করেছেন। সেগুলোর উত্তর এখানে প্রদান করা হল:

❓প্রশ্ন ৪:
কোরআনের পাঠ্য কি সাংবিধানিক ধারাগুলোর মতো নয় যেখানে প্রতিটি সমস্যা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়? যদিও কোরআনে হারাম ও হালাল স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোরআন থেকে উদ্ভাবন করতে হয়। আর উদ্ভাবনে ভুলের সম্ভাবনা থাকে। যখন এমন হয়, তখন মাজহাবের অনুসারীগণ কোরআন থেকে উদ্ভাবিত নিজেদের আকীদাকে ১০০% সঠিক এবং অন্যদের আকীদা ও বিষয়গুলোকে ১০০% ভুল কেন বলেন? তাও এতটা সাহস ও জোরগলায়!!

✅ উত্তর ৪: কোরআন কোনো আইন গ্রন্থ নয়, এটি মূলত একটি পথনির্দেশিকা। আইনগত লেখার উদ্দেশ্য শিক্ষাদান বা চরিত্র গঠন নয়; বরং এগুলোর লক্ষ্য হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিগুলো রক্ষা করা। সমাজে নীতির প্রচার এবং সমাজের সংশোধন আইন দ্বারা সম্ভব নয়। যখন কোনো সমাজ আইন নির্ভর হয়ে ওঠে, তখন সেই নীতির মূল উদ্দেশ্য ও আধ্যাত্মিকতা ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। ফলে মানুষের মধ্যে এমন মানসিকতা গড়ে ওঠে যে আইন জানার উদ্দেশ্য ভালো নাগরিক হওয়া নয়, বরং আইনের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া।

ইসলামের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। যখন কোরআন ও সুন্নাহকে একপাশে রাখা হলো এবং ফিকহকে কেন্দ্রীয় স্থান দেওয়া হলো, তখন কৌশলের বইগুলোকে (কিতাবুল হিয়াল) ব্যাপকভাবে প্রসারিত করা হলো। এতে এমনসব সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ করা হলো যা অত্যন্ত জটিল এবং ভয়াবহ। এর একটি উদাহরণ হলো আধুনিক ইসলামিক ফাইন্যান্স, যার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে কৌশলের মাধ্যমে সুদকে বৈধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ফিকহের অধিকাংশ খুঁটিনাটি বিষয় কুরআনে নেই। উদাহরণস্বরূপ, নামাজে কতগুলো ফরজ, কতগুলো ওয়াজিব, কতগুলো সুন্নাত বা মুস্তাহাব রয়েছে তা কুরআনে উল্লেখ নেই। এসব হলো মানুষের বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবন। যেমন অন্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে মতপার্থক্য হয়, ঠিক তেমনি এই উদ্ভাবিত বিষয়গুলোতে ইমাম ও ফকিহদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।

এ ধরনের উদ্ভাবিত বিষয়ে মতবিরোধ স্বাভাবিক। কোনো এক মুজতাহিদের মতামত অন্য মুজতাহিদের মতামতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। প্রাথমিক যুগে এটি স্পষ্ট ছিল। ফলে আলেমরা একে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতেন এবং তাদের থেকে উপকৃত হতেন।

পরবর্তীতে মাযহাবের প্রভাব শুরু হলো এবং এসব মাযহাব ধর্মের স্থানে জায়গা নিল। কুরআন ও সুন্নাহর পরিবর্তে মাযহাবের বইগুলোকে উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হলো। ইমামদের উদ্ভাবনগুলোকে পবিত্রতার মর্যাদা দেওয়া হলো, এবং মাযহাবের মতামতকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হলো যে এর ভিত্তিতে একে অপরকে বিভ্রান্ত ও কাফির বলা হলো। শুধু তাই নয়, সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে নতুন নতুন বিভক্তি সৃষ্টি হলো। প্রাথমিকভাবে আহলে সুন্নত, শিয়া, খারেজি, মুরজিয়া, এবং মুতাজিলা নামের বিভিন্ন দল ছিল। পরে আহলে সুন্নতের মধ্যে আশারি, মাতুরিদি এবং আহলে হাদিস নামে নতুন বিভাজন তৈরি হলো। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বিভাজন এতগুলো ভাগ তৈরি করেছে যে সেগুলোর সংখ্যা গণনা করা কঠিন। এবং পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ এসব বিভাজনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়েছে, যার ক্ষতি শুধুমাত্র ধর্ম ও উম্মতেরই হয়েছে।

❓ প্রশ্ন ৫:
কেন কোরআনে ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ, যেমন রোজা, নামাজ, হজ এবং যাকাত ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা নেই? কীভাবে নামাজ আদায় করতে হবে, কীভাবে হজ পালন করতে হবে এবং কত যাকাত দিতে হবে তা কোরআনে উল্লেখ করা হয়নি। অথচ কোরআনে কিছু বিষয় বারবার এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, কোরআনে এই মৌলিক স্তম্ভগুলোর ‘আদেশ’ এবং বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।

✅ উত্তর ৫:
কোরআন একটি সুস্পষ্ট গ্রন্থ, যার বিষয়বস্তু হিদায়াত ও শিক্ষার সমস্ত নীতিমালা ও মৌলিক বিষয়ের পরিপূর্ণতা। নামাজ, যাকাত, রোজা এবং হজ সম্পর্কে যতটুকু পূর্ণ বিবরণ কোরআনে রয়েছে, তার চেয়ে বেশি সম্ভব নয়।
কারণ আমরা ফিকহের বিবরণ ও বিন্যাসে অভ্যস্ত, তাই জীবন কেটে যায় এবং আমরা কোরআনের সাথে পরিচিত হই না, কোরআনের প্রকাশভঙ্গির জ্ঞানও অর্জন করি না, এবং কোরআন থেকে নামাজ ও যাকাত শেখার চিন্তাও করি না।
মুসলমানদের অবক্ষয়ের মূল কারণ হল আল্লাহর কিতাব থেকে উদাসীনতা। আপনি ভেবে দেখুন, কেন কোরআন নামাজকে কখনও জিকর, কখনও শুকরিয়া এবং কখনও তাকওয়া ও ইহসান বলে অভিহিত করেছে? কেন নামাজের মধ্যে খুশু, বিনয় এবং আনুগত্যকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে? কেন অজুর পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে এক জায়গায় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু নামাজ, যা এই দ্বীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এবং যার ছাড়া দ্বীন দ্বীন নয়, তার বর্ণনায় ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে?
এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে এই বিষয়টির উপর যে, প্রথমে আমাদের ফিকহের বিবরণ ও বিন্যাস থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে, তারপর আল্লাহর বর্ণিত বিস্তারিত ও বিন্যাসের সত্যতার উপর ভালোভাবে চিন্তা করতে হবে। আমি এখন কুরআনের তাফসীর লিখছি। এরপর, ইনশাআল্লাহ, “কোরআনের নামাজ”, “কোরআনের যাকাত” ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর বিস্তারিতভাবে লিখব। আল্লাহ আমাদের নেক আমলের তাওফিক দিন।

❓ প্রশ্ন ৬: একাধিক বিবাহ কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত এবং এটি সকল নবী-রাসূল, সাহাবা, তাবেয়িন এবং তাবে তাবেয়িনের সুন্নত ছিল। তবে অতীতের এই যুগটি এমন ছিল, যখন পৃথিবীর জনসংখ্যা অনেক কম ছিল এবং সেই সময়টি ছিল উপজাতীয় সমাজের। তখন পরিবার ও গোত্র যত বড় হতো, ততই তারা শক্তিশালী বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন যুগ বদলে গেছে, পৃথিবীর জনসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং শক্তির উৎস এখন আর জনসংখ্যার আধিক্যে নয়, বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এর স্থান নিয়েছে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে একপত্নীত্ব কি উত্তম নয়, বিশেষত কোরআনও কিছু ক্ষেত্রে একপত্নীত্বের সমর্থন করে? তবে কেন কিছু আলেম এখনো একাধিক বিবাহের প্রচার ও প্রসার করছেন?

✅ উত্তর ৬: এই প্রশ্নের উত্তর একটি প্রবন্ধ নয়, বরং একটি পুরো বইয়ের দাবি রাখে। তবে আপাতত সংক্ষেপে বলছি, আল্লাহ তাআলা সমগ্র জগতের প্রভু। সৃষ্টির ও রিজিকের বিষয় তার রুবুবিয়াতের অধীনে রয়েছে। আমরা আল্লাহর সৃষ্ট এবং তার পূর্ণ দাসত্ব করাই আমাদের গৌরব। যে যত বেশি এই দাসত্বে অগ্রসর হবে, সে ততই সম্মানিত হবে এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হবে। মানুষের জনসংখ্যা কত হবে, তারা কত রিজিক পাবে, জনসংখ্যার সর্বোচ্চ সীমা কবে হবে, এবং সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া কবে থামানো হবে—এগুলো সব আল্লাহর কাজ। এসব নিয়ে চিন্তা করা বা মতামত দেওয়া বুদ্ধিহীনতার প্রমাণ।

একাধিক বিবাহের মূল উপকারিতা হলো প্রজন্ম বৃদ্ধি করা, তবে এর একটি গৌণ উপকারিতাও রয়েছে, যা হলো পবিত্রতা ও শালীনতার রক্ষা। অনেক নারী রয়েছেন, যারা বিয়ে করতে পারছেন না, আবার অনেক পুরুষ রয়েছেন, যাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রবল। একাধিক বিবাহের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান হয়, অন্যথায় এর পরিণাম হলো সেই অশ্লীলতা এবং মানসিক রোগ, যা খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *