AkramNadwi

কিন্তু আমার চুল কি ‘واللیل إذا سجى’ নয়?

শিরোনাম : “কিন্তু আমার চুল কি ‘واللیل إذا سجى’ নয়?”
——————–

|| প্রশ্ন:

সম্প্রতি আমি “মানদণ্ড” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছি, যা আলহামদুলিল্লাহ, অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায়, ভারতের একজন সম্মানীয় ও শ্রদ্ধেয় আলেম আমাকে একটি চিঠি লেখেন, যার মূল বক্তব্য এ রকম—

সম্মানিত ডক্টর সাহেব, حفظكم الله!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ও বারকাতুহু।

আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। “معیار” (মানদণ্ড)শিরোনামে আপনার প্রবন্ধটি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে এক সত্য সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে—তা হলো, কোনো বিদ্যা, জ্ঞান বা ঐতিহ্যে معیار (মানদণ্ড) কেবল একটি হয়; তবে সেই معیار বা মানদণ্ডে উত্তীর্ণ ব্যক্তির সংখ্যা হাজারে হাজার, এমনকি লক্ষাধিকও হতে পারে।

তিনি আরও লেখেন:

আমার এক মুফতি বন্ধুও এই প্রবন্ধটি পড়েছেন। তিনি বললেন, প্রবন্ধের প্রতিটি কথা যথাযথ ও সত্য; তবে এই কথাও সঠিক যে, সাহাবায়ে কেরামই ছিলেন হকের معیار বা মানদণ্ড।

আমি তাঁকে বললাম—
উসুলে ফিকহে চারটি দলিল নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃত:
আল্লাহর কিতাব, রাসুলের সুন্নাহ, উম্মতের ইজমা এবং কিয়াস।
এই চারটি দলিলেই ইমামদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।

যদি সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মানদণ্ড হতেন, তবে তাদের কথাও এই শরয়ি দলিলের অন্তর্ভুক্ত হতো। সাহাবিদের বক্তব্য ও কর্ম হুজ্জত (প্রমাণ) হিসেবে গণ্য কি না—এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

এ কথা শুনে মুফতি সাহেব বললেন:
“তবে কি আমাদের পূর্বসূরি বড় বড় আলেমরা উসুলে ফিকহ জানতেন না? যদি তাঁরা সাহাবিদের মানদণ্ড বলেছেন, তবে অবশ্যই সেটিই সঠিক মত হবে। আপনি আমাদের কোনো এক বরেণ্য আকাবিরের (পূর্বসূরি আলেম) উক্তি পেশ করুন, তাহলেই আমরা আপনার কথার সত্যতা মেনে নেব।”

|| উত্তর:

মুফতি সাহেবের এই প্রশ্ন-ই স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণ করে যে, তাঁর কাছে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম ‘হক’-এর মানদণ্ড নন, বরং এই মর্যাদায় তিনি তাঁর নিজের কোনো ‘আকাবির’ বা পূর্বসূরিকে আসীন মনে করেন।

যদি সত্যিই সাহাবায়ে কেরামকে তিনি মানদণ্ড মনে করতেন, তাহলে তাঁর প্রশ্নের ভিত্তিই হতো এই নয় যে, আপনি আমাদের কোনো আকাবিরের কথা পেশ করুন—বরং হতো এই: আপনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের কথা বা অবস্থান পেশ করুন, যার ভিত্তিতে বিষয়টি নির্ধারিত হতে পারে।

তাঁর এই মনোভাবই বলে দিচ্ছে—তাঁদের কাছে সত্য-মিথ্যার পরিমাপক, হক-বাতিলের মানদণ্ড সাহাবায়ে কেরাম নন, বরং তাঁদের আকাবির ও মাশায়েখ।

নিশ্চয় বিশ্বাস রাখুন—এমন লোকদের সঙ্গে হওয়া বিতর্ক বা তর্ক কখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না, এবং পৌঁছানো সম্ভবও নয়। আপনি যত এগিয়ে যাবেন, ততই নতুন নতুন সন্দেহ, সংশয় ও প্রশ্নের দরজা খুলতে থাকবে।

কারণ, এই ব্যাপারটি কেবল জ্ঞানগত নয়, বরং মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিভক্তির সঙ্গেও জড়িত। উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলে এমন এক বিশেষ গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়েছে, যারা ঔপনিবেশিক যুগ, বিশেষত ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই আত্মপ্রকাশ করে। এদের পুরো ধর্মীয় কাঠামোই গড়ে উঠেছে বিতর্ক, ফতোয়া ও অন্যদের খণ্ডন-তাকফির (অবিশ্বাসী ঘোষণার) উপর।

তাঁদের চিন্তা ও দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু হলো—যেকোনো উপায়ে বিরোধী পক্ষকে মিথ্যাবাদী, বিভ্রান্ত কিংবা অগ্রাহ্যযোগ্য প্রমাণ করা।

তাঁদের কাছে জ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য সত্যের অনুসন্ধান নয়, বরং প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা ও বিতর্কে বিজয় অর্জন।

এরা সম্পূর্ণরূপে তর্কপ্রবণ এবং দ্বন্দ্বপ্রিয়। যদি তাদের কারও সঙ্গে বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের সুযোগ না থাকে, তাহলে তারা নিজেরাই কোনো কাল্পনিক পয়েন্ট তৈরি করে নেয়, যাতে করে কোনো না কোনোভাবে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।

তাদের কার্যসূচির মধ্যে কোনো প্রকৃত শুভকামনা বা সংশোধনের অভিপ্রায় থাকে না। বরং তাদের মিশন হলো—যেকোনো উপায়ে পরিবেশকে সন্দেহময়, অস্পষ্ট ও অস্থির করে রাখা।

এই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত এমনই অসংখ্য তর্কের একটি হলো: “সাহাবায়ে কেরামই হকের মানদণ্ড।”

তাঁদের এই দাবিকে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে যে, কেউ যদি সাহাবায়ে কেরামকে মানদণ্ড না মানে, তাহলে তাকে অবিলম্বে “তাওহিনে সাহাবা” (সাহাবা অবমাননা) এর দোষে অভিযুক্ত করে ফেলা হয়—যেন এই বিশ্বাস-ই ঈমানের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।

আপনি যদি এক হাজারবারও তাদের সামনে ঘোষণা করেন, পুরো সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন—
“আমরা সাহাবায়ে কেরামের ফজিলত পুরোপুরি স্বীকার করি। কোরআন মাজিদ ও হাদিসে নববীতে সাহাবাদের সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তা আমরা হৃদয়ের তখতিতে স্থান দিই। আমরা তাঁদের মর্যাদা, অবস্থান, সাহস, সত্যবাদিতা, আন্তরিকতা, ত্যাগ ও আমানতের গুণাবলি মানি। এমনকি গত চৌদ্দশো বছর ধরে ফকিহ, মুহাদ্দিস ও ওলিয়াগণ সাহাবাদের প্রশংসায় যে গুণাবলি ব্যক্ত করেছেন, তাও আমরা অকপটে মেনে নিই।”

তবুও এই গোষ্ঠী সন্তুষ্ট হবে না।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *