AkramNadwi

হে নাফস, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকো

আমি নিজের সঙ্গে কথা বলছিলাম—যখন দেখলাম আমার নফস (আত্মা) উন্মুক্ত, উদভ্রান্ত, বুঝতে পারছে না কোন পথে পা ফেলবে; চারপাশে তাকাচ্ছে, কিন্তু কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না; সামনে শুধু মরীচিকা, আর পেছনে ধোঁয়া। তখন আমি বললাম: হে নফস! নিজেকে ব্যস্ত রাখো, ব্যস্ত রাখো তোমার ফাঁকা সময় তোমায় ব্যস্ত করে ফেলার আগেই; তার একাকিত্ব তোমায় গ্রাস করার আগেই; তোমায় এমন খাদে টেনে নেওয়ার আগেই, যেখান থেকে আর মুক্তি নেই। তুমি কখনো শূন্যতার শিকার হয়ো না, কল্পনা আর আতঙ্কের থাবায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ো না। কারণ, নফসকে যদি স্বভাবের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সে বিভ্রান্তির পথে হারিয়ে যাবে, সন্দেহ আর বিষণ্নতার অন্ধকারে ডুবে যাবে।

সে (নফস) আমাকে বলল—তাতে বিরক্তির চিহ্ন ছিল, মুখে অচেনা এক অনাগ্রহের ছাপ:

“এই ব্যস্ততা তো এক প্রকার বন্ধন, এক ধরনের শৃঙ্খল। আমি নিজেকে বাঁধতে চাই না, আমি শেকল পরতে চাই না। আমি এমন কিছু করতে চাই না যা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, এমন কোনো পথে হাঁটতে চাই না যা আমার ভালো লাগে না। আমি চাই নিজের মতো করে বাঁচতে, যা ইচ্ছা তাই করতে, কোনো সীমা ছাড়াই—না কোনো আদেশ, না কোনো নিষেধ; না কোনো নজরদার, না কোনো নিয়ন্ত্রণ।”

আমি তার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলাম—এক গভীর দুঃখমাখা দৃষ্টিতে, এমন একজনের দৃষ্টিতে, যে জানে এমন কথার পরিণাম কী, জানে এই পথের শেষ কোথায় গিয়ে ঠেকে, অথচ সে যার সামনে কথা বলছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তারপর বললাম:

“তুমি যা চাচ্ছো—নিজের ইচ্ছামতো বাঁচা, প্রবৃত্তির খেয়ালে চলা, লাগামছাড়া ভোগের পেছনে ছোটা—এটাই আসল ব্যাধি, এখানেই আত্মা ধ্বংস হয়। এটা এমন এক পতন, যেটা দেখতে উঠে যাওয়ার মতো মনে হয়। এটা হচ্ছে এক ধরণের গোপন দাসত্ব, যেটা মুক্তির মোড়কে আসে। কিন্তু হে নফস, বাস্তবে এটা দাসত্বই—লাঞ্ছনা আর নিঃস্বতা। এটা এমন এক নিয়ন্ত্রণের কাছে আত্মসমর্পণ, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার শেকল দৃশ্যমান শৃঙ্খলের চেয়েও ভয়াবহ।”

সে বিস্মিত হয়ে বলল, তার কণ্ঠস্বর একটু কমে গেছে, চোখের দীপ্তি ম্লান হয়ে এসেছে:

“কীভাবে এটা দাসত্ব হবে? আমি তো নিজেই চাইছি, আমি তো নিজের পছন্দে কাজ করছি! তাহলে এটাকে দাসত্ব বলছো কেন?”

আমি বললাম:

“তুমি যদি অতিরিক্ত খাবার ভালোবাসো, পানীয়র প্রতি প্রবল আসক্ত হও, আর অন্ধভাবে শারীরিক ভোগের পেছনে ছোটো—বুদ্ধির কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া, বিবেকের কোনো বাধা ছাড়া—তাহলে তুমি তোমার জীবনকে এসব প্রবৃত্তির হাতে তুলে দিচ্ছো। যদি পেয়ে যাও, খুশি হও; না পেলে, কষ্ট পাও আর হতাশ হও। তখন তুমি আসলে তোমার ভালোবাসার দাসী, তোমার ইচ্ছার বন্দিনী; তুমি তখন আর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারো না, তোমার সিদ্ধান্ত হয়ে পড়ে একটা ক্ষণস্থায়ী আকাঙ্ক্ষার হাতে, একটা ধোঁকাবাজ আনন্দের হাতে।

আর যদি এসব পাওয়ার অধিকার না থাকেও, তাহলে তুমি অসন্তুষ্ট থাকবে, কষ্ট পাবে, অভাবের জন্য কাঁদবে, আফসোসে কপাল চাপড়াবে। এটাই তো পরনির্ভরতা। এটাই—আল্লাহর কসম—হল দাসত্বের আসল রূপ, তুমি যেটাকে ভুল করে বলছো স্বাধীনতা, তুমি যেটাকে দাবি করছো কর্তৃত্ব।”

সে এবার কিছুটা নরম স্বরে, ধীরে ধীরে বলল—একটা সত্যিকারের চিন্তার সুর ভেসে উঠল তার কণ্ঠে:

“তাহলে আসল স্বাধীনতা কী? যদি আমার ইচ্ছেমতো চলা স্বাধীনতা না হয়, তাহলে কোথায় তা? কিভাবে আমি আমার আসল অধিকার অর্জন করব?”

আমি এবার কোমল স্বরে বললাম, চোখে আশার আলো ঝলমল করছিল:

“হে নফস! আসল স্বাধীনতা হলো—তুমি নিজের উপর কর্তৃত্ব রাখবে, এমন না যে নিজের প্রবৃত্তি তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তুমি নিজের প্রবৃত্তির উপর বুদ্ধিকে কর্তৃত্ব দেবে, না যে বুদ্ধিকে প্রবৃত্তির অধীনে রাখবে। তুমি তোমার অন্তর্দৃষ্টিকে পথপ্রদর্শক করবে, যাতে সে তোমায় কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়—না যে তুমি এক অজানা কামনা, অভ্যাস বা মোহের দাসী হয়ে যাবে।

স্বাধীনতা মানে লাগামহীনতা নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতা মানে সবকিছুতে ছাড় দেওয়া নয়, বরং সচেতন ইচ্ছা। তুমি তোমার বুদ্ধি দিয়ে দেখবে, কী তোমার জন্য উপকারী, কী তোমায় সুখ এনে দেবে দুনিয়ায়, আর কী তোমার পরকালকে নিরাপদ রাখবে। এটা উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধে অবিচল থাকা—বাধ্যবাধকতা নয়। এটা মহৎ আদর্শে প্রশিক্ষণ—না যে তা থেকে সরে আসা। এটা হলো ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গঠন—ধ্বংস বা পতন নয়।

তুমি যদি জ্ঞানচর্চার পথে চলো, চিন্তা-ভাবনায় মন দাও, ঈমানের আলোয় পথ চলো, ইসলামের শিক্ষায় আলোকিত হও—তবে তুমি আসলে স্বাধীনতার পথে হাঁটছো, দাসত্বের পথে নয়; তুমি আলোয় যাচ্ছো, অন্ধকারে নয়।”

সে বলল:

“তাহলে কি সব প্রবৃত্তিই খারাপ? কিছু তো ভালোও আছে? কিছু কিছু তো উপভোগ্য?”

আমি করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম—কারণ, তার চোখে তখন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ছায়া:

“না, সব প্রবৃত্তি খারাপ তা বলছি না। এগুলো তো মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, মানুষ এগুলো ছাড়া থাকতে পারে না। এগুলো মানুষের টিকে থাকার জন্য দরকারি। তবে—হে নফস!—এগুলো তখনই তোমার জন্য উপকারী, যখন এগুলো তোমার বুদ্ধির অধীনে থাকবে, তোমার সচেতন ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যখন তোমার প্রবৃত্তি তোমার বুদ্ধির অনুগত হবে, তখন তুমি স্বাধীন, ক্ষমতার অধিকারী , নেতৃত্বদানকারী।

কিন্তু যখন বিপরীতটা হয়—প্রবৃত্তি তোমার বুদ্ধিকে শাসন করে, কামনা তোমার ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে—তখন তুমি আর স্বাধীন নও। তখন তুমি চরম বিশৃঙ্খলায় পড়ে যাও। তখন তুমি, যদিও মনে করো তুমি বুদ্ধিমতী, আসলে পাগল হয়ে গেছো; তুমি শৃঙ্খলমুক্ত বলে ভাবলেও, আসলে তুমি শেকল পরেছো।”

সে এবার সত্যিকারের মনোযোগ দিল, আমার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবল—মনে হলো, এখন আর ঠাট্টা করে নয়, বরং গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে বলল:

“তাহলে তুমি যে আমাকে ব্যস্ত থাকতে বলছো—এর সবকিছুর সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? এটাই কি তাহলে সমাধান? নাকি এও একটা শৃঙ্খল?”

আমি তখন কথাগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে বললাম:

“যদি তুমি নিজেকে এমন কাজে ব্যস্ত রাখো, যা দুনিয়া ও আখেরাতে তোমার উপকারে আসে; যদি তুমি বুদ্ধিমত্তার চোখে দেখে বুঝো কোনটা তোমার জন্য ভালো; যদি তুমি তোমার সময়কে পূর্ণ করো উপকারী জ্ঞান, সঠিক চিন্তা ও ফলদায়ক কাজে; যদি তুমি মনোযোগ দাও গঠনের পথে, ধ্বংস নয়—উন্নতির দিকে, পতনের নয়—তাহলে তুমি নিজেই তৈরি করছো এক সচেতন ও স্বাধীন আত্মা। তুমি গড়ছো তোমার ব্যক্তিত্ব, তুমি জাগিয়ে তুলছো তোমার অন্তরের তাৎপর্য।”

তুমি যত মহান কাজ ও মহৎ লক্ষ্য নিয়ে নিজেকে বেশি ব্যস্ত রাখবে, তত বেশি দূরে থাকবে মিথ্যা প্রবৃত্তি আর নষ্টকর কামনা-বাসনা থেকে। আর এতে করে তুমি উন্নত হবে, মুক্ত হবে, এবং সত্যিকার অর্থেই নিজের ওপর কর্তৃত্বশীল হবে—কোনো প্রবৃত্তির দাসী বা কোনো মুহূর্তের আবেগের বন্দিনী নয়।

কারণ, যদি আত্মাকে এমন কিছু দিয়ে ব্যস্ত না রাখা হয় যা তাকে উচ্চতায় নিয়ে যায়, তাহলে সে পড়ে যাবে এমন অবক্ষয়ে, যা তাকে ধ্বংস করে। তুমি যদি পরিশ্রম করে নিজের ব্যক্তিত্ব গঠন না করো, তাহলে শূন্যতা এসে তা ধ্বংস করে দেবে। তুমি যদি তোমার সময়কে এমন কিছু দিয়ে পূর্ণ না করো যা তোমার মর্যাদা বাড়ায়, তাহলে বিভ্রান্তি তোমাকে গ্রাস করবে, এবং তুমি হারিয়ে যাবে।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড ইউকে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *