AkramNadwi

আইয়ুব আ.-এর জীবন থেকে আল্লাহর প্রতি আদব শিখো

بسم الله الرحمن الرحيم.

যখন একজন মানুষ আকাশের দিকে হাত তোলে, তখন সে কেবল একটি স্বাভাবিক কাজ করে না; বরং সে করছে এক বিশেষ দাসত্বের প্রকাশ। সে জানিয়ে দিচ্ছে তার অসহায়ত্ব ও বিনয়, জানিয়ে দিচ্ছে তার প্রভুর প্রতি তার নির্ভরতা—সেই প্রভুর প্রতি, যার হাতে রয়েছে সমস্ত কিছুর মালিকানা।

তবে এই মহান অবস্থান—অর্থাৎ দোয়ার অবস্থান—আজকের যুগে অনেক অজ্ঞতা ও ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে। এমনকি এমনও দেখা যায়, কেউ কেউ এমনভাবে আল্লাহকে ডাকছে যেন তারা তাঁকে চেনে না, কিংবা যেন তারা তাঁর মর্যাদা বোঝে না বা আদব রক্ষা করে না।

তুমি দেখবে, কেউ কেউ তাদের বিপদের কথা অত্যন্ত বাড়িয়ে বলছে, নিজের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিচ্ছে দীর্ঘভাবে, কষ্টের বিবরণ দিচ্ছে অতিরঞ্জিতভাবে—এমনভাবে যেন সে এমন কাউকে উদ্দেশ করে কথা বলছে, যিনি তার অবস্থা জানেন না, কিংবা যেন সে আল্লাহকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—তার ওপর কী নেমে এসেছে! এমনকি কেউ কেউ তো আল্লাহকে প্রস্তাব দিচ্ছে—কোন উপায়টি হলে তার কষ্ট মোচন হবে, তা-ও বলে দিচ্ছে! আবার কেউ কেউ তার দোয়া এমনভাবে সাজায়, যেন আল্লাহর কাছে তার প্রার্থনার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে চায়, নানা দলিল উপস্থাপন করে—যেন সে কোনো বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে যুক্তি পেশ করছে, যিনি না শুনলে বিশ্বাস করবেন না!

এটা হলো দোয়ার মূল রুহ বা অন্তর্নিহিত ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি সেই দাসত্ববোধের বিরুদ্ধ যা একজন বান্দার মধ্যে থাকা উচিত—অর্থাৎ বিনয়, খোদাভীতি, নিজের অক্ষমতা স্বীকার এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও প্রজ্ঞার সামনে শান্ত-নিমগ্ন থাকা। এই ভুল বোঝাবুঝি ও বিকৃত ধারণা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, বহু ইমাম ও খতিবদের আচরণও তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কুনুতের দোয়া আধাঘণ্টা বা তারও বেশি দীর্ঘ করে ফেলে, যেখানে কথার বাহুল্য থাকে, অপ্রয়োজনীয় জটিল শব্দে ভর্তি থাকে, এবং অতিরিক্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যায় ভরা থাকে—এমনভাবে যেন তারা ভাবছে, দীর্ঘ দোয়া বেশি কবুলযোগ্য, আর শব্দের কৃত্রিম অলঙ্কারই বেশি ফলদায়ক!

আমি দাওয়াত ও তাবলিগের সফরে অনেক ঈমানী দৃশ্য দেখেছি, যা হৃদয়কে আলোকিত করেছে এবং আমাকে إخلاص (নির্ভেজাল উদ্দেশ্য) ও تجرد (নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ) শিখিয়েছে। তবে যা আমাকে সত্যিকার কষ্ট দিয়েছে, তা হলো দোয়ার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জনের ব্যবহার এবং আল্লাহর মর্যাদা ও গাম্ভীর্য ভুলে যাওয়া।

নবীদের দোয়ার দিকে একটু মনোযোগ দিলে আমরা দোয়ার প্রকৃত অর্থ ও তার রুহ বা আত্মা বুঝতে পারি। তাদের দোয়ায় অতিরিক্ত ব্যাখ্যা নেই, অকারণ বর্ণনা নেই—তারা সংক্ষেপে বলেন, গভীর মনোযোগ দিয়ে বলেন, এবং সবচেয়ে গভীর ভাষায় নিজেদের অসহায়ত্ব ও বিনয় প্রকাশ করেন।

দেখো, নবী আইয়ুব (আ.)-এর দোয়া। তিনি বহু বিপদের শিকার হয়েছিলেন—সম্পদ হারিয়েছেন, সন্তান হারিয়েছেন, দেহে কঠিন রোগ এসেছে, কষ্ট দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু যখন তিনি তাঁর প্রভুর কাছে আরজি পেশ করেন, তখন তিনি কোনো অভিযোগ করেননি, বিস্তারিত বলেননি। বরং বলেছিলেন:

“مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ”

“আমার দুঃখ আমাকে স্পর্শ করেছে, আর তুমি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।”

সংক্ষিপ্ত একটি বাক্য, কিন্তু কত গভীর! এতে রয়েছে অসহায়ত্বের স্বীকৃতি, আশা, দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি আস্থা, তাঁর প্রতি মহব্বত, শ্রদ্ধা ও সম্মান—সবকিছুই। আর আল্লাহর জবাব কী ছিল?

“فَاسْتَجَبْنَا لَهُ”

“অতঃপর আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম।”

আইয়ুব (আ.)-এর দোয়ায় ছিল না কোনো অভিযোগ, যা হতাশা বা বিরক্তি বোঝায়। ছিল না কোনো প্রস্তাবনা, যা আপত্তি প্রকাশ করে। ছিল কেবল নিখাঁদ ভরসা, বিনয়পূর্ণ আরজি—আর এটাই হলো সেই দোয়ার প্রকৃতি, যা আমাদের এই যুগে আবার নতুন করে বুঝতে হবে।

আল্লাহ কাউকে দোয়ার দীর্ঘতায় সাড়া দেন না, কিংবা শব্দের জাঁকজমকে খুশি হন না। তিনি সেই দোয়া কবুল করেন, যেখানে থাকে আন্তরিকতা, বিনয়, এবং বান্দার হৃদয় থেকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা।

তাই আমাদের নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের মানুষদের শিখাতে হবে যে, দোয়া হলো গাম্ভীর্যের এক মহান আসন, কোনো প্রদর্শনের জায়গা নয়। এটি দয়ার দরজা, বক্তৃতার মঞ্চ নয়। ফিরে যাই নবীদের দোয়ার শিক্ষায়, যাতে আমরা বেশি করে কবুলের আশা করতে পারি, এবং সেই অপার রহমতের আরও কাছে পৌঁছাতে পারি—যার কোনো সীমা নেই।

—————–

ক্যাটাগরি : উপদেশ / শিক্ষা

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *