AkramNadwi

“হে বৎসগণ! তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না” এর ব্যাখ্যা

https://t.me/DrAkramNadwi/2267

بسم الله الرحمن الرحيم

———-

|| প্রশ্ন :

আমার কাছে আমেরিকায় বসবাসকারী বিশিষ্ট কুরআনের গবেষক অধ্যাপক নোমান আলী খানের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন এসেছে। তিনি জানতে চেয়েছেন নবী ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম)-এর উক্তি “হে বৎসগণ! তোমরা এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো”—এর ব্যাখ্যা কী? এবং এ বিষয়ে পূর্ববর্তী বিদ্বানগণের মতামত কী?

|| উত্তর:

ইমাম আবু জাফর তাবারি তাঁর তাফসিরে লিখেছেন:
আল্লাহ তাআলা বলেন: ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর পুত্রদের মিসরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য, তখন তিনি তাদের বললেন, “হে আমার সন্তানগণ! তোমরা মিসরে একটি মাত্র পথ দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো।” তিনি তাদের এই নির্দেশ দেন কারণ তারা ছিল সুদর্শন এবং সম্মানিত। তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে, তারা যদি একসঙ্গে একটি মাত্র পথ দিয়ে প্রবেশ করে, তাহলে নজরের (দৃষ্টিহীনতার) কবলে পড়তে পারে, কারণ তারা একই পিতার সন্তান। এজন্য তিনি তাদেরকে বিভিন্ন পথে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন।

সাহাবা ও তাবেয়ীদের মধ্য থেকে অনেকে এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

ইবন আব্বাস রা. বলেন: “ইয়াকুব আ. তাদের উপর নজরের (কু-দৃষ্টি) ভয় করছিলেন।”

মুহাম্মদ ইবন কা’ব বলেন: “তিনি তাদের উপর নজরের আশঙ্কা করছিলেন।”

কাতাদা বলেন: “আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সন্তানদের উপর নজরের ভয় করেছিলেন, কারণ তারা ছিল চেহারায় সুন্দর ও আকর্ষণীয়।”

দাহহাক বলেন: “তিনি তাদের উপর নজরের ভয় করছিলেন।”

ইবন ইসহাক বলেন: “তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে, তাদের সৌন্দর্য ও সম্মান দেখে মানুষের নজর পড়বে।”

ইমাম জামাখশারী তাঁর “আল-কাশশাফ” তাফসিরে বলেন:
ইয়াকুব আ. তাদের একই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন, কারণ তারা ছিল সুন্দর ও মর্যাদাবান। মিসরের লোকেরা তাদের পরিচিত ছিল, কারণ রাজা তাদের বিশেষভাবে সম্মান করতেন এবং সাধারণ লোকদের তুলনায় তাঁদের আলাদা মর্যাদা দিতেন। এজন্য তারা মানুষের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো এবং সবাই তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতো। তখন বলা হতো, “এরা রাজা’র অতিথি! দেখো, কত সুন্দর যুবক! তারা কতটা সম্মান ও মর্যাদার উপযুক্ত!” ফলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, তারা যদি একসঙ্গে প্রবেশ করে, তাহলে নজরের শিকার হতে পারে এবং তাদের ক্ষতি হতে পারে। এজন্যই প্রথমবার যখন তারা মিসরে গিয়েছিল, তখন তিনি তাদের এই পরামর্শ দেননি, কারণ তখন তারা অপরিচিত ছিল।

ইমাম মাওয়ার্দী তাঁর “আন-নুকত ওয়াল-উইউন” (النكت والعيون) তাফসিরে উল্লেখ করেছেন যে,
ইয়াকুব আ. তাদের এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করার পেছনে দুটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে:
১. তিনি নজরের ভয় করেছিলেন, কারণ তারা ছিল সুদর্শন। এটি ইবন আব্বাস ও মুজাহিদের অভিমত।
২. তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, রাজা যদি তাদের সংখ্যার কারণে সন্দেহ করে, তাহলে তিনি তাদের ক্ষতি করতে পারেন। এটি কিছু পরবর্তী যুগের আলেমদের মত।

তবে, এই ব্যাখ্যার কিছু সমস্যা রয়েছে:

১. প্রথমবার যখন তারা মিসরে প্রবেশ করেছিল, তখন কেন নজরের ভয় ছিল না?
২. যদি দ্বিতীয়বার তিনি তাদের উপর নজরের ভয় করেই থাকেন, তাহলে প্রথমবার কেন নজরের শিকার হয়নি? তারা তো সেদিনও আনন্দিত ও নিরাপদে ফিরে এসেছিল!
3. যদি তারা বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করেও রাজপ্রাসাদে গিয়ে একত্র হয়, তাহলে সেখানে কি নজরের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা নেই? এ থেকে বোঝা যায় যে, জামাখশারীর ব্যাখ্যা দুর্বল।
৪. রাস্তার মধ্যেই তো তাদের উপর নজর লাগতে পারত! কারণ তারা বিভিন্ন গ্রাম ও অঞ্চলের মধ্য দিয়ে মিসরে যাচ্ছিল এবং বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিল।
৫. তারা তো নবী পরিবারের সন্তান! তাহলে কেন তারা নজর থেকে বাঁচার জন্য কেবল ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশের ওপর নির্ভর করবে? নবীগণ তো আল্লাহর নিকট দোয়া করেন এবং তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তাহলে কেন শুধুমাত্র প্রবেশপথ বদলানোর প্রয়োজন পড়ল?
৬. আল্লাহ তাআলা কুরআনে স্পষ্ট বলেছেন: “তারা যখন তাদের পিতার নির্দেশ মতো প্রবেশ করল, তখন এটি তাদের কোনো উপকারে আসেনি।” (সুরাহ ইউসুফ: ৬৮)
এতে বলা হয়নি যে, তারা নজরের কবলে পড়েছিল। তাহলে ইয়াকুব আ. এর মনে অন্য কোনো কারণ ছিল, যা বাস্তবে পূরণ হয়নি।

যে ব্যাখ্যাটি অধিক গ্রহণযোগ্য:

আমার মতে, ইয়াকুব আ. যখন জানতে পারলেন যে, মিসরে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে, বিশেষ করে যখন দুর্ভিক্ষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন তার মনে হলো, “হতে পারে, ইউসুফ আ. মিসরে রয়েছেন, কারণ বিভিন্ন জাতির লোকজন সেখানে যাচ্ছে।” তাই তিনি তাঁর পুত্রদের বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে বললেন, যাতে তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করতে পারে এবং হয়তো ইউসুফ আ. এর কোনো খোঁজ পেয়ে যেতে পারে।

এই ব্যাখ্যা ইবরাহিম নাখাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর অভিমতের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, “ইয়াকুব আ. চাচ্ছিলেন, তাঁর ছেলেরা শহরে ছড়িয়ে পড়ুক, যাতে তারা ইউসুফকে দেখতে পারে বা তাঁর কোনো খোঁজ পায়।”

ইবন আবি হাতিম ইবরাহিম নাখাঈ থেকে বর্ণনা করেন যে,
“(তোমরা বিভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করো) এর অর্থ হলো, ইয়াকুব আ. জানতেন, তাঁর ছেলেরা হয়তো কোনো দরজায় ইউসুফের সাক্ষাৎ পাবে।”

এটি আল্লাহ তাআলার উক্তি “إِلَّا حَاجَةً فِي نَفْسِ يَعْقُوبَ قَضَاهَا” অর্থাৎ “এটি ছিল ইয়াকুবের অন্তরের এক চাওয়া”—এর ব্যাখ্যার সঙ্গে মিলিত হয়। তাঁর ইচ্ছা ছিল, তাঁর সন্তানরা হয়তো ইউসুফকে খুঁজে পাবে। তবে, এটি বাস্তবে কার্যকর হয়নি। কারণ ইউসুফ আ. তখন মিসরের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে কেবল নির্দিষ্ট সময়েই সাক্ষাৎ করা সম্ভব ছিল।

এটাই আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ, তিনিই সর্বাধিক জানেন।

——————

# তাফসির

মূল: ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *