AkramNadwi

হিফজুল কুরআনের পরের শিক্ষা ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5788

بسم الله الرحمن الرحيم.

|| প্রশ্ন:

মাওলানা শফিউর রহমান নদভী, যিনি মাসকট (ওমান)-এ অবস্থান করছেন, প্রশ্ন করে লিখেছেন:
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ও বারাকাতুহু। আমি শফিউর রহমান, মাসকট (ওমান)। অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে এই বার্তা পাঠাচ্ছি। আপনার ব্যস্ততা অত্যন্ত বেশি থাকে। যখনই সময় পাবেন, দয়া করে উত্তর দেবেন। আমার ছেলে কুরআন হিফজ করছে এবং সম্ভবত রমজানুল মোবারকে তা সম্পূর্ণ হবে। রমজান পর্যন্ত তার বয়স হবে ১৬ বছর। আমাদের আপনার কাছে জানতে হবে যে, তার পরবর্তী শিক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়। আপনার নির্দেশনার প্রয়োজন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আপনাকে সুস্বাস্থ্য, কল্যাণ এবং দীর্ঘায়ু দান করুন। আমিন।

|| উত্তর:

অত্যন্ত খুশির বিষয় যে আপনার সন্তান কুরআন হিফজ সম্পন্ন করতে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা তাকে আরও জ্ঞানের ধন দান করুন এবং তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে উন্নতি দান করুন।

কুরআন শরীফের শব্দ মুখস্থ করা অত্যন্ত বরকতময় কাজ। কিন্তু এটি আসলে পুরোপুরি ‘হিফজ’ নয়। কুরআন, হাদিস এবং আরবি ভাষায় ‘হিফজ’ বলতে যা বোঝানো হয়, তা আজকের প্রচলিত অর্থে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ‘হিফজ’-এর মর্যাদা কমিয়ে দেয়া। আমি আমার আরবি এবং ইংরেজি প্রবন্ধে ‘হিফজ’-এর প্রকৃত অর্থ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি। সুযোগ পেলে এ বিষয়ে উর্দুতেও কিছু লেখার চেষ্টা করব। এই মুহূর্তে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।

আপনার সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না করে পার্থিব শিক্ষার দিকেও সমান গুরুত্ব দিন। পার্থিব শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এই দুনিয়াতে জীবিকার গুরুত্ব উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কিছু লোক আবেগপ্রবণ স্লোগান দিয়ে আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে যে, সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করুন যেন তারা ভবিষ্যতে ধর্মের খেদমত করতে পারে। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, জীবিকার সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে মাদ্রাসার ছাত্ররা উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় খেদমত করতে পারে না। বরং অনেক আলেমকে দেখা গেছে ট্যাক্সি চালানো বা অন্যান্য পার্থিব কাজ করতে। ফলে তারা ধীরে ধীরে ধর্মীয় শিক্ষা ভুলে যায়।

আপনি যে দেশে বসবাস করেন, সেই দেশের ব্যবস্থাপনার অধীনে আপনার সন্তানের পার্থিব শিক্ষার ব্যবস্থা করুন। এর মাধ্যমে সে একটি গ্রহণযোগ্য চাকরি পাবে এবং জীবিকার বিষয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারবে।

অবশ্যই দুনিয়া হলো শুধু ভক্ষণ-পানীয়ের জায়গা নয়, বরং আখিরাতের প্রস্তুতির স্থান। তাই আপনার সন্তানের ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়েও যত্নবান হন। বর্তমানে ভারতীয় মাদ্রাসাগুলোতে যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হয়, তা খুবই নিম্নমানের।

ধর্মের নামে মূলত মাজহাবের শিক্ষা দেওয়া হয়। কারণ মাজহাবের কোনো সীমানা নেই, তাই শুরু থেকেই মাজহাবভিত্তিক মতবাদ মনের মধ্যে সুসংহত করা হয়। এর ফলে মনে করা হয়, মুসলমান একক উম্মত নয় বরং বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী দল। ধর্মের ভিত্তি আল্লাহর দাসত্ব এবং আখিরাতে সফলতার প্রস্তুতির ওপর। কিন্তু মাজহাবের ভিত্তি বাহ্যিক পরিচয়ের ওপর। তাই মাদ্রাসা থেকে বের হওয়া ছাত্ররা পুরো মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে লুঙ্গি, পাজামা এবং টুপি পরিধানের দিকে। প্রতিটি মাজহাবের পোশাক ভিন্ন। সেই পোশাক দেখে ধারণা করা হয়, ব্যক্তি কোন মাজহাবের অনুসারী।

ধর্মের ভিত্তি হলো দলিল। দলিল বলতে বোঝানো হয় কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস। অথচ অধিকাংশ মাদ্রাসায় দলিল শেখানো হয় না। বরং আকাবিরদের (বড়দের) অনুসরণ করার মানসিকতা তৈরি করা হয়। আর এই আকাবিররা খাইরুল কুরুনের (সাহাবা ও তাবেয়ীন) যুগের নয় বরং জাহিলিয়াতের যুগের। প্রতিটি মাজহাবের আকাবির আলাদা। তাই তাদের মধ্যে কোনো মিল নেই। যখন তাদের কাছে দলিল চাওয়া হয়, তখন তারা বলে, “আমাদের আকাবির আপনার চেয়ে বেশি জানতেন।” তারা বুঝতেই পারে না যে, আকাবিরের উদ্ধৃতি অজ্ঞতা এবং ভ্রষ্টতার প্রমাণ।

আপনি যখন আপনার সন্তানের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন, তখন তিনটি বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিন:
১. তাকে আরবি ভাষা পড়ানো, বুঝানো, বলানো এবং লেখানোর মানসম্পন্ন শিক্ষা দিন।

পুরোনো শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে এমনভাবে দূরে থাকুন, যেন একজন মানুষ কুষ্ঠরোগ থেকে দূরে থাকে। এ ব্যবস্থায় আরবি ভাষার স্বাদ কখনোই তৈরি হয় না। এখানে মৃত ভাষা শেখানো হয়। যারা এই পদ্ধতিতে পড়ে, তারা না কুরআনের মর্ম বুঝতে পারে, না হাদিসের, আর না আরবিতে কিছু লিখতে বা বলতে পারে।

২. তাকে সরাসরি কুরআন এবং হাদিসের শিক্ষা দিন।

আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের মর্যাদা হৃদয়ে সুসংহত করুন। তাকে বোঝান, কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীতে কারও কথা দলিল হতে পারে না। শেখান যে, আল্লাহর দরবারে তাকওয়াই গ্রহণযোগ্য হবে। ধর্মীয় সাজসজ্জার কোনো মূল্য সেখানে নেই। আল্লাহ তাআলা মাজহাব সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না। বরং তিনি ভালোবাসা, ভয় এবং নবীদের আনুগত্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন।

৩. তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিশ্চিত করুন।

অর্থাৎ সে যেন তার পরিবেশে বসবাস করেও ধর্মের যুক্তিগুলো বুঝতে পারে এবং আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণির সামনে তা ব্যাখ্যা করতে পারে। যত বেশি বুদ্ধিমত্তা দৃঢ় হবে, তত বেশি ফিতনা এবং সন্দেহ থেকে দূরে থাকা যাবে।

সারমর্ম হলো যে, আপনার সন্তানকে সঠিকভাবে ধার্মিক করুন এবং তাকে ধর্মের প্রচারক হিসেবে তৈরি করুন। তাকে تكفير (অপরাধী ঘোষণা করা), تفسيق (অপরাধী বলার), تضليل (ভ্রষ্টতা ঘোষণা করা) এবং তর্কবিতর্কের মতো বিপদ থেকে দূরে রাখুন। বিতর্ক মানুষের হৃদয়কে মৃত করে দেয় এবং এর মাধ্যমে শুধুই ঘৃণা জন্মায়। অথচ নবী এই দুনিয়ায় এসেছিলেন হৃদয়গুলোকে যুক্ত করতে। তাঁদের আহ্বান ছিল শুভাকাঙ্ক্ষায় প্রতিষ্ঠিত, প্রতিযোগিতা ও বিরোধে নয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নেক বানান এবং আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার তাওফিক দিন।

———-
# পরামর্শ / উপদেশ # শিক্ষা

লিখেছেন :
মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী – অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *