https://t.me/DrAkramNadwi/2934
بسم اللّه الرحمن الرحيم
❝
:: নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর বক্তব্যের একটি অংশ কুরআন কারিমে উল্লেখ করা হয়েছে:
“مَّا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا”
(সূরা নূহ, আয়াত: ১৩)।
এই আয়াতের তাফসির নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এই প্রবন্ধে বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে তাদের মধ্যে তুলনা এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হবে।
|| ভূমিকা:
তাফসিরের একটি স্বীকৃত নীতি হলো, যখন কুরআন কারিমে এমন কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় যার একাধিক অর্থ থাকতে পারে, তখন সেই অর্থই অগ্রাধিকার পাবে যা সর্বাধিক প্রচলিত। অপ্রচলিত অর্থ কেবল তখনই গ্রহণ করা হবে যখন প্রচলিত অর্থ গ্রহণে কোনো বাধা থাকে।
এখানে একটি শব্দ “رجاء” ব্যবহৃত হয়েছে। رجاء সাধারণত আশা করার অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং এটিই সর্বাধিক প্রচলিত অর্থ। যদি এই প্রচলিত অর্থ অনুযায়ী কোনো ব্যাখ্যা সম্ভব হয় এবং তাতে কোনো বাধা না থাকে,
তবে এটি অগ্রাধিকার পাবে। “لله” শব্দটি “ترجون” এর সাথেও সম্পর্কযুক্ত হতে পারে এবং “وقار” এর সাথেও। তবে “ترجون” এর সাথে এর সম্পর্ক আরবী ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকতর স্পষ্ট এবং নিকটতর। “وقار” এর সাথে সম্পর্কিত ধরা হলে এটি مصدر (ক্রিয়ার মূল) এর সঙ্গে যুক্ত হবে। مصدر দুর্বল ক্রিয়াকাজ সম্পন্ন করে, তাই এর উপর ভিত্তি করে কোনো কিছু অগ্রাধিকার দেওয়া যায় না। তবে ظرف (স্থান-কাল নির্দেশক) এবং جار ومجرور (পূর্ব-প্রসঙ্গ বা পূর্বশব্দ) অগ্রাধিকার পেতে পারে। কিন্তু এটি শৈলীর দিক থেকে সর্বোত্তম নয়। সুতরাং, এমন ব্যাখ্যাই অধিকতর উপযুক্ত হবে, যেখানে এই অনাকাঙ্ক্ষিত শৈলীর ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
|| বিভিন্ন ব্যাখ্যার দিকসমূহ:
এই আয়াতের মূল শব্দ হলো “وقار”। এই শব্দের অর্থ নির্ধারণের জন্যই আয়াতের তাফসিরে মতভেদ হয়েছে।
আর “وقار” শব্দটি مجرد (মূল) এর مصدر (ক্রিয়ার মূল) হতে পারে, যার অর্থ হবে “মহানতা”। এটি تفعيل (তাফঈল) এর مصدر-ও হতে পারে, যার অর্থ হবে “সম্মান প্রদান”। এ ছাড়া, এর তৃতীয় আরেকটি অর্থও গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা নিম্নে তিনটি অর্থের বিশ্লেষণ করব এবং তৃতীয় অর্থ দিয়ে আলোচনা শুরু করব।
:: প্রথম অর্থ:
সবচেয়ে দুর্বল মতামত হলো, যারা “মহানতা” এবং “সম্মান প্রদানের” পরিবর্তে “وقار” শব্দ থেকে কিছু ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করেছেন। যেমন:
“ما لكم لا ترجون لله عاقبة”
(তোমরা কেন আল্লাহর জন্য কোনো পরিণামের আশা করছ না?)
বা
“ما لكم لا ترجون لله طاعة”
(তোমরা কেন আল্লাহর জন্য আনুগত্যের আশা করছ না?)।
এই দুটি অর্থের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এর নিকটবর্তী একটি ব্যাখ্যা হলো, মাওলানা মওদূদীর অনুবাদ:
“তোমাদের কী হলো যে, আল্লাহর জন্য তোমরা কোনো সম্মানের প্রত্যাশা করছ না?”
মাওলানা মওদূদী এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন:
“অর্থ হলো, দুনিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসক ও নেতা-নেত্রীদের ব্যাপারে তোমরা মনে কর যে, তাদের সম্মানের পরিপন্থী কোনো আচরণ করা বিপজ্জনক। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর ব্যাপারে তোমরা এই ধারণা পোষণ কর না যে, তিনিও একজন সম্মানিত সত্তা।”
মাওলানা মওদূদী এখানে “وقار” শব্দটি উর্দু ভাষার “সম্মান” অর্থে ব্যবহার করেছেন। তবে এর পক্ষে কোনো দলিল নেই।
:: দ্বিতীয় অর্থ:
দ্বিতীয় মত হলো, “وقار” শব্দটিকে “مجرد” (মূল) ধারা থেকে নিয়ে “মহানতা” অর্থে গ্রহণ করা। এই মত অনুযায়ী আয়াতের অর্থ হবে: “তোমরা কেন আল্লাহর মহানতা আশা করছ না?”। এখানে আশা সবসময় ভবিষ্যতের জন্য হয়ে থাকে, অর্থাৎ কোনো বিষয় তখন বিদ্যমান থাকে না যখন এটি বলা হয়; বরং ভবিষ্যতে এর ঘটার প্রত্যাশা করা হয়। তবে এখানে প্রশ্ন ওঠে, আল্লাহ তো মহান, তাহলে তাঁর মহানতা আশা করার অর্থ কী হবে?
এই অসঙ্গতি থেকে বাঁচার জন্য এই মতের প্রবক্তারা “ترجون” শব্দের প্রচলিত অর্থ গ্রহণ না করে এমন একটি অর্থ গ্রহণ করেছেন, যা এই অসঙ্গতি দূর করতে পারে। যেমন, কিছু আলেম ব্যাখ্যা করেছেন:
“ما لكم لا ترون لله عظمة”
(তোমরা কেন আল্লাহর মহানতা দেখছ না?)
অথবা
“ما لكم لا تعلمون لله عظمة”
(তোমরা কেন আল্লাহর মহানতা বোঝছ না?)।
এটি মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহীর একটি মত। কিছু ভারতীয় আলেম এটিকে উর্দুতে এভাবে অনুবাদ করেছেন:
“তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর মহানতায় বিশ্বাস করছ না?”
অথবা
“তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস স্থাপন করছ না?”
ইমাম তাবারি “رجاء” শব্দটিকে “ভয়” অর্থে গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:
“আমাদের মতে, এই ব্যাপারে সবচেয়ে সঠিক মত হলো তাদের কথা, যারা বলেছেন: এর অর্থ হলো—তোমরা কেন আল্লাহর মহানতাকে ভয় করছ না? কারণ, যদি প্রত্যাখ্যান যুক্ত থাকে, তাহলে আরবরা কখনো কখনো ‘رجاء’ শব্দকে ‘ভয়’ অর্থেও ব্যবহার করে থাকে।”
ইমাম তাবারির এই মতের অনুসরণে পরবর্তী কিছু মুফাসসিরও “رجاء” শব্দটিকে “ভয়” অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন।
যারা “وقار” শব্দটিকে “মহানতা” অর্থে গ্রহণ করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অনুবাদটি করেছেন মাওলানা আমিন আহসান ইসলামি। তিনি বলেছেন:
“তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর মহানতার প্রকাশের প্রত্যাশা করছ না?”
মাওলানা ইসলামি “رجاء” শব্দটিকে তার প্রকৃত অর্থে গ্রহণ করেছেন, শুধু “ظہور” (প্রকাশ) শব্দটি যোগ করেছেন। তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
“এটি জাতির একগুঁয়েমি নিয়ে বিস্ময়ের প্রকাশ। আমি যে তোমাদের বারবার আন্তরিকভাবে ক্ষমার আহ্বান জানাচ্ছি, তাতে তোমাদের কী হলো যে তোমরা কান বন্ধ করে আছো এবং আমার কথাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছ? তোমরা কি মনে কর যে, এভাবে তোমরা তোমাদের ইচ্ছামতো মগ্ন থাকবে, আর যিনি তোমাদের এইসব দিয়েছেন, তাঁর জ্যোতি তোমাদের দুষ্টতার পরও প্রকাশ পাবে না? অর্থ হলো, যদি তোমরা এমনটা ভেবে থাক, তবে এর মানে হলো তোমাদের কাছে তাঁর মহিমা ও গৌরবের কোনো ধারণা নেই।”
এই মতের উপর আপত্তি হলো যে, হয়তো “رجاء” কে অপরিচিত অর্থে নেওয়া হয়েছে, অথবা অর্থকে সঠিক করতে এর মধ্যে “ظہور”শব্দটি যোগ করা হয়েছে। আরও, এই অর্থ গ্রহণকারীরা “لله” -কে “وقار” -এর সম্পূরক অর্থে বিবেচনা করেছেন, যা আরবী ভাষার দৃষ্টিকোণে ততটা শক্তিশালী ব্যাখ্যা নয়।
:: তৃতীয় অর্থ:
তৃতীয় মত হলো, “وقار” শব্দটি “تفعيل” -এর مصدر (মূল ক্রিয়া) এবং এর অর্থ “সম্মান প্রদান”। এখানে “لله” শব্দটি “ترجون”-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী যথার্থ, যার অর্থ হবে:
“তোমরা কেন আশা করছ না যে আল্লাহ তোমাদের সম্মানিত করবেন?”
|| প্রাধান্য:
আমাদের দৃষ্টিতে এই তৃতীয় অর্থই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। এর পক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তি দেওয়া যায়:
১. এর মধ্যে “رجاء” (রজাআ) আশা অর্থেই থাকবে, যা এর পরিচিত অর্থ। তবে অন্য মতের অনুসারীরা “رجاء”-কে দৃষ্টি, জ্ঞান, ভয় বা বিশ্বাস ইত্যাদির মতো অপরিচিত অর্থে নিয়েছেন।
২. এই ব্যাখ্যায় কোনো শব্দকে কল্পনা করে যোগ করতে হবে না, যেমন মাওলানা আমিন আহসান ইসলামি “ظہور” শব্দটি কল্পনা করে যোগ করেছেন।
৩. এটি আরবী ভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি উপযুক্ত, যেমনটি আরবি ভাষার পণ্ডিত ইমাম আল-জামাখশারির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হবে।
৪. এই অর্থ সূরার প্রসঙ্গের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করা হবে। এছাড়া, এটি কুরআনের অন্যান্য উদাহরণের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন মাওলানা ফারাহি উল্লেখ করেছেন।
৫. এই আয়াতের যে অর্থ এখানে প্রাধান্য পেয়েছে, তা পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্য থেকে কয়েকজন উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করেছেন আল্লামা জামাখশারি তাঁর “কশশাফ” গ্রন্থে।
তিনি বলেন: “لا ترجون لله وقارا” অর্থ: “তোমরা আল্লাহর প্রতি মহত্ত্ব আশা করো না” অর্থাৎ, “তোমরা এমন অবস্থায় কেন নেই যে, যেখানে তোমরা আশা করবে আল্লাহ তোমাদের সম্মানিত করবেন প্রতিদান প্রাপ্তির ঘরে।” এখানে “لله” শব্দটি “الموقر” (সম্মানিত) এর ব্যাখ্যা। যদি এটি দেরিতে উল্লেখিত হতো, তবে এটি “الوقار” (মহত্ত্ব) এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতো।
৬. এই অর্থ মাওলানা ফারাহির আরেকটি ব্যাখ্যাকেও সমর্থন করে। তিনি বলেন:
“এই ব্যাখ্যাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে “তাযমীন” নীতির উপর ভিত্তি করে, যার অর্থ হলো—’তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর প্রতি আশাবাদী নও এবং তাঁকে সম্মান করছ না?’ যদি তোমরা এটি করতে, তবে অবশ্যই তাঁর সাক্ষাৎ ও প্রতিদানের প্রতি ঈমান আনতে। … মনে রাখবে, পুরস্কারের প্রতি আশা ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রাখে।” (تعليقات ২/৩৮৮)
|| রাজাহ মতামতের আরও বিশদ ব্যাখ্যা:
উপরে রাজহ মতামত এই শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে: “অর্থাৎ, তোমরা কেন আশা করো না যে আল্লাহ তোমাদের সম্মান দেবেন/তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন?” এবং এই সম্মান আল্লাহ দুনিয়াতে যেমন দেন, তেমনি আখিরাতেও। যেমন, সূরা নূহ-এর আয়াতের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে যে, যদি নূহ (আলাইহিস সালাম)-এর জাতির লোকেরা তাওবা করত, তাহলে কীভাবে তাদের উপর নিয়ামতের ভান্ডার উন্মুক্ত হয়ে যেত।
এর সমর্থন পাওয়া যায় সেই সমস্ত আয়াত থেকে যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সাথে অঙ্গীকার করেছেন এবং এটি স্পষ্ট করেছেন যে, তারা যদি নিজেদের অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তবে আল্লাহও তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। যেমন:
“اوفوا بعهدي أوف بعهدكم”
(তোমরা আমার অঙ্গীকার পূর্ণ কর, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব)
“فاذكروني أذكركم”
(তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব)।
এবং এই অর্থে বহু আয়াত বিভিন্ন স্থানে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে মাওলানা খুরশিদ আনোয়ার নাদভি সাহেব এই ব্যাখ্যা করেছেন: “তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূরণের আশা কর না?” এটি অবশ্যই আক্ষরিক অনুবাদ নয়; তবে সম্ভবত কুরআনের মূল বার্তাটি যথাযথভাবে প্রকাশ করার জন্য এটি সবচেয়ে উপযুক্ত। প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ প্রকাশের মাধ্যমে অনুবাদ করার উদাহরণ সালাফদের মধ্যে খুব সাধারণ ছিল।
ইমাম ইবন তাইমিয়াহ তাঁর মুকাদ্দিমা ফি উসূল আত-তাফসির এবং অন্যান্য গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। একটি স্থানে তিনি বলেন:
“সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ কোনো বিষয়ের অনুবাদ তার প্রয়োজনীয় অর্থ কিংবা সমতুল্য অর্থ দিয়ে করেছেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি বিষয়টির প্রকৃত অর্থ উল্লেখ করেছেন।”
এর একটি উদাহরণ হলো:
“فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُونَ”
(আল-ওয়াকিয়াহ: ৬৫)।
এর অর্থ কিছু লোক “تندمون” (তোমরা অনুতপ্ত হবে) বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এটি প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে অনুবাদ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ হলো, “তোমরা তোমাদের আনন্দ উপভোগ বন্ধ করে দেবে”। এবং যখন এই উপভোগ বন্ধ হয়ে যাবে, তখন তার বিপরীত অনুভূতি (অনুতাপ) স্থান দখল করবে।
—————–
# তাফসির
মূল:
ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
অনুবাদ ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।