লেখক: ড. মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী,
অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।
—
১. সূরা ইখলাসের মহত্ত্ব
তারা বলল: সূরা ইখলাস কী?
আমি বললাম: এটি হলো সেই মহান সূরা যা আমাদেরকে আমাদের রব সম্পর্কে জানায় এবং আমাদেরকে তাঁর সাথে সংযুক্ত করে। এটি শব্দ এবং গঠনগতভাবে ছোট হলেও, অর্থ এবং তাৎপর্যে মহান। এই সূরায় আল্লাহর কোনো গুণ বাদ পড়েনি বা উপেক্ষা করা হয়নি, যা তাঁর বান্দাদের তাঁর কাছে আসতে এবং একমাত্র তাঁর উপাসনা করতে সাহায্য করে। আল্লাহর সমস্ত নাম, গুণাবলি, কার্যকলাপ, এবং ব্যাপারগুলো যা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে, তাঁর সমস্ত কিছু থেকে পৃথক এবং পরিপূর্ণতা এই সূরায় সংক্ষেপে একত্রিত করা হয়েছে। এতে বর্ণিত হয়েছে যে সৃষ্টিজগত কীভাবে তাঁর প্রতি নির্ভরশীল এবং তাঁকে অনুগতভাবে মেনে চলে।
এই সূরাটি অল্প কিছু শব্দে এই মহান ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করেছে, যা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু একই সাথে ব্যাপক, সুন্দর, অলৌকিক এবং সাবলীল।
২. এর অর্থের সারাংশ
তারা বলল: এর অর্থ সংক্ষেপে আমাদের ব্যাখ্যা করে বলুন।
আমি বললাম:
এই সুরা কুরআনের পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত আহবানের চূড়ান্ত সূরা, যা খাঁটি ইবাদত ও প্রার্থনার প্রতি আহ্বান জানায়। এই নিবেদিত প্রার্থনাই অনন্ত ও শাশ্বত ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু।
। এটি অন্যান্য সূরাগুলির সাথে যুক্ত যা অবিশ্বাস এবং শিরক থেকে হিজরত (প্রত্যাখ্যান) নিয়ে আলোচনা করে। এটি কাফির, মুশরিক, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মিথ্যাচার এবং ভুল বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠিন একটি ঘোষণা।
এই সূরা বিশেষ করে খ্রিস্টানদের জন্য কঠোর এবং যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে। এটি সূরা আল-ফাতিহার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যেখানে শুরুতে আল্লাহর তাওহীদ বর্ণিত হয়েছে এবং শেষে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিদআতের (ধর্মের বিকৃতি) অপসারণ করা হয়েছে। এই সূরাটি অত্যন্ত গভীর অর্থে পূর্ণ, যা গুনে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে এর সবচেয়ে প্রধান তিনটি অর্থ হলো:
—
৩. তিনটি মূল অর্থ :
প্রথম: আল্লাহর একত্ব।
“আল্লাহ” শব্দটি সমস্ত নাম, গুণাবলি, এবং কার্যকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করে যা কুরআনে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। জাহিলিয়াতের যুগে আরবরা কিছু গুণ সম্পর্কে জানত, কিন্তু অধিকাংশ গুণ সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ছিল। তারা ফেরেশতা এবং অন্যান্যদের আল্লাহর সাথে শিরক করেছিল, যেমন খ্রিস্টানরা এবং অন্যান্য পথভ্রষ্ট জাতি করেছে। তাদের শিরক দেখিয়ে দেয় যে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ইবাদত করেনি এবং তাদের বিশ্বাসের দাবী মিথ্যা। আল্লাহ সূরা আল-কাফিরুন অবতীর্ণ করে ঘোষণা দেন যে তারা মুমিনদের থেকে পৃথক এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন।
“আহাদ” শব্দটিও সেই সমস্ত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে যা এর সাথে সম্পৃক্ত। এটি বোঝায় যে আল্লাহ আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভাবক, এবং সবকিছুর চূড়ান্ত গন্তব্য। “তিনি প্রথম এবং শেষ, প্রকাশমান এবং অদৃশ্য, এবং তিনি সর্বজ্ঞ।” (সূরা আল-হাদীদ ৫৭:৩)। “আল্লাহরই আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবীর উত্তরাধিকার।” (সূরা আল-হাদীদ ৫৭:১০)। আল্লাহ তাঁর নাম, গুণাবলি এবং কার্যকলাপে একক। আকাশ এবং পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তাঁরই। আমাদের আত্মা, সম্পদ এবং হৃদয় তাঁরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং ধ্বংস করেন, যা ইচ্ছা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং রায় দেন। তাঁর শাসন কেবলমাত্র ক্ষমতা এবং জ্ঞানের মাধ্যমে চলে, এবং তাঁর আদেশের বিপরীতে কোনো কিছুই ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তিনিই জীবিত করেন এবং মৃত্যু দেন, এবং মৃত্যুর পর আবারও হাড়গুলো জীবিত করবেন।
—
দ্বিতীয়: আল্লাহর পরিপূর্ণতা।
এটি “আস-সামাদ” গুণের মাধ্যমে নির্দেশিত। এটি এই সূরার কেন্দ্র। আস-সামাদ মানে হলো সেই পূর্ণপ্রভু, যার কাছে সবাই তাদের প্রয়োজন নিয়ে ফিরে আসে এবং তিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন। তাঁর পরিপূর্ণতা দুই প্রকার:
1. অপূর্ণতা থেকে মুক্তি, কারণ তিনি সৃষ্টিজগত থেকে স্বাধীন এবং তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এই দিকটি কুরআনে তাসবিহ (আল্লাহর মহিমা ঘোষণা) এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
2. তাঁর করুণা এবং অনুগ্রহ তাঁর সৃষ্টির প্রতি। সৃষ্টিকুল সম্পূর্ণরূপে তাঁর উপর নির্ভরশীল, এবং তিনি তাদের মহান অনুগ্রহ প্রদান করেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, পথপ্রদর্শক, এবং ভয়ের বিপরীতে সুরক্ষা প্রদানকারী। এই দিকটি হামদ (প্রশংসা) দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে, কারণ তিনি তাঁর দান এবং অনুগ্রহের কারণে প্রশংসিত। সমস্ত মঙ্গল আল্লাহ থেকে আসে, মানুষের কাছ থেকে নয়। তাঁর নেক বান্দাদের জন্য তিনি যা প্রস্তুত করেছেন, সেই জান্নাত হলো সবচেয়ে সেরা, যার ছায়া এবং সঙ্গ রয়েছে। যে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, তার জন্য পূর্ণ বরকত থাকে। যদি আমরা কৃতজ্ঞ হই, আমাদের অবশ্যই কৃতজ্ঞ হতে হবে তার প্রতি যিনি আমাদের অনুগ্রহ প্রদান করেছেন, এবং তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতা করা হবে একটি মারাত্মক পাপ।