https://t.me/DrAkramNadwi/6102
بسم الله الرحمن الرحيم
❝
——————–
প্রশ্ন:
কুরআন গবেষণায় আগ্রহী কিছু গবেষক আমাকে প্রশ্ন করেছেন, সুরা ফজরের শুরুতে যে শপথ করা হয়েছে, সেখানে কী বোঝানো হয়েছে? তারা বিভিন্ন তাফসিরগ্রন্থ ও আলেমদের মতামত পর্যালোচনা করেছেন, কিন্তু এতে তাদের বিভ্রান্তি, জটিলতা ও দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। বিষয়টি এতটাই গুলিয়ে গেছে যে তা আরও বাড়ার সুযোগ নেই।
উত্তর:
আমি বলেছি—আপনি যেমন উল্লেখ করেছেন, আপনি আলেমদের বক্তব্য ও তাফসিরকারদের মতামত পর্যালোচনা করেছেন, তাই আমি সেগুলো আর পুনরাবৃত্তি করছিনা। বরং আমি আপনার সামনে যেটা আমার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে, সেই ব্যাখ্যাটি উপস্থাপন করছি, এবং ব্যাখ্যার স্পষ্টতার জন্য আমি এটিকে চারটি অংশে ভাগ করেছি—
প্রথম অংশ:
وَالْفَجْرِ، وَلَيَالٍ عَشْرٍ، وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ، وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ (১-৪)
দ্বিতীয় অংশ:
هَلْ فِي ذَلِكَ قَسَمٌ لِذِي حِجْرٍ (৫)
তৃতীয় অংশ:
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ…… فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ (৬-১৩)
চতুর্থ অংশ:
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ (১৪)
প্রথম অংশে শপথ এবং যেটির শপথ করা হয়েছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। চতুর্থ অংশে “إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ” — এটিই হচ্ছে শপথের উদ্দেশ্য বা যার জন্য শপথ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে শপথের গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তৃতীয় অংশটি দ্বিতীয় অংশের ব্যাখ্যা।
কুরআনে শপথের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাক্ষ্য প্রদান—এই অর্থেই আমি বহুবার গুরুত্বারোপ করেছি এবং এতে আমি ইমাম হামিদউদ্দীন ফারাহী (রহ.)-এর মতামত অনুসরণ করেছি, যিনি তাঁর অনন্য গ্রন্থ “إمعان في أقسام القرآن”-এ এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ কুরআন এখানে ফজর, দশ রাত, জোড় ও বিজোড়, এবং রাত্রির যাত্রা—এইসব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এই কথার উপর যে তোমার প্রভু অবশ্যই রক্ষণে নিযুক্ত আছেন।
আর “المرصاد” মানে এমন স্থান, যেখানে পর্যবেক্ষণ বা প্রহরা বসানো হয়—অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করেন এবং কেউ তাঁর নজরদারির বাইরে যেতে পারে না।
তাহলে শপথ ও যার জন্য শপথ তা কীভাবে যুক্ত হয়েছে? এটি এমন একটি সম্পর্ক, যা কেবল তারা-ই অনুধাবন করতে পারে যারা আয়াতগুলো গভীরভাবে চিন্তা করে। আর এই চিন্তার দিকে আহ্বান জানিয়েছেন এই বলে—”هَلْ فِي ذَلِكَ قَسَمٌ لِذِي حِجْرٍ”।
যখনই কোনো বক্তব্যে চিন্তা ও উপলব্ধির আহ্বান থাকে, তখন আল্লাহ তাতে মনোযোগ আকর্ষণ করেন। যেমন, সুরা ওয়াকিয়ায় শপথের প্রসঙ্গে বলেন—”وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ” (৭৬)।
এই প্রসঙ্গে আল্লামা ফারাহী বলেন—
“এই শেষ বাক্যটি অনেকটা কুরআনে দালিলিক বক্তব্যের পর যেমন বলা হয়—
‘إن في ذلك لآيات لقوم يعقلون’
(সূরা নাহল ১২),
‘إن في ذلك لآيات لأولي النهى’
(সূরা ত্বহা ৫৪, ১২৮),
‘إن في ذلك لعبرة لأولي الأبصار’
(সূরা আলে ইমরান ১৩)
—একইভাবে এখানে শপথসমূহের পর বলা হয়েছে, যে এগুলো অন্তদৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য নিদর্শন।” (تعليقات 2/452-453)
এখানে তিনি মানুষকে শপথসমূহ নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেন, তারপর এমন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন যা এই শপথকে বোঝায়—
“أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ…… فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ”
এই অংশে আল্লাহ এমন সব জাতির কথা উল্লেখ করেছেন, যারা দুনিয়ায় সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং ব্যাপকভাবে দুর্নীতি করেছিল। ফলে আল্লাহ তাদের উপর কঠিন শাস্তি প্রয়োগ করেন।
এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে বোঝা যায়, শপথ যেটির জন্য করা হয়েছে, তা হলো আল্লাহর সেই দিনগুলো, যেদিন তিনি জালিমদের ওপর শাস্তির চাবুক বর্ষণ করেছিলেন—এগুলো এমন এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যা আরবরা জানতো, তাই একটুখানি ইঙ্গিতেই তারা তা বুঝে নিত।
এখন এই শপথগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক—
“والفجر”:
এটি হলো লূতের জাতির উপর আযাবের সময়। অন্যত্র বলা হয়েছে—
“قالوا يا لوط إنا رسل ربك لن يصلوا إليك فأسر بأهلك بقطع من الليل…… إن موعدهم الصبح، أليس الصبح بقريب”
[ তারা (মালাইকা) বললঃ হে লূত! আমরাতো আপনার রবের প্রেরিত বার্তাবাহক, তারা কখনও আপনার নিকট পৌঁছতে পারবেনা, অতএব আপনি রাতের কোন এক ভাগে নিজের পরিবারবর্গকে নিয়ে চলে যান, আপনাদের কেহ যেন পিছনের দিকে ফিরেও না চায়; কিন্তু হ্যাঁ, আপনার স্ত্রী যাবেনা, তার উপরও ঐ আপদ আসবে যা অন্যান্যদের প্রতি আসবে, তাদের (শাস্তির) অঙ্গীকার কৃত সময় হচ্ছে প্রাতঃকাল, প্রভাত কি নিকটবর্তী নয়? ]
(সূরা হুদ ৮১)
“وليال عشر”:
এটি আদ জাতির সাত রাতের ধ্বংস এবং সামুদ জাতির জন্য নির্ধারিত তিন রাতের প্রতীক্ষার কথা বোঝায়—মোট দশ রাত। অন্যত্র এসেছে—
“وأما عاد فأهلكوا بريح صرصر عاتية، سخرها عليهم سبع ليال وثمانية أيام حسوما…”
[ আর ‘আদকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া দিয়ে। যা তিনি তাদের উপর প্রবাহিত করেছিলেন সাত রাত ও আট দিন বিরামহীনভাবে; তুমি যদি তখন উক্ত সম্প্রদায়কে দেখতে তাহলে দেখতে পেতে যে, তারা সেখানে লুটিয়ে পড়ে আছে বিক্ষিপ্ত অসার খেজুর কান্ডের ন্যায়। ]
(সূরা হাক্কাহ ৬-৮)
আর সামুদ সম্পর্কে—
“فقال تمتعوا في داركم ثلاثة أيام… فأصبحوا في ديارهم جاثمين. كَاَنۡ لَّمۡ یَغۡنَوۡا فِیۡهَا ؕ اَلَاۤ اِنَّ ثَمُوۡدَا۠ كَفَرُوۡا رَبَّهُمۡ ؕ اَلَا بُعۡدًا لِّثَمُوۡدَ”
[ অতঃপর তারা তাকে হত্যা করল। তাই সে বলল, ‘তোমরা তিন দিন নিজ নিজ গৃহে আনন্দে কাটাও। এ এমন এক ওয়াদা, যা মিথ্যা হবার নয়’। অতঃপর যখন আমার আদেশ এল, তখন সালিহ ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে রহমত দ্বারা নাজাত দিলাম এবং (নাজাত দিলাম) সেই দিনের লাঞ্ছনা থেকে। নিশ্চয় তোমার রব, তিনি শক্তিশালী, পরাক্রমশালী। আর যারা যুলম করেছিল, বিকট আওয়াজ তাদেরকে পাকড়াও করল, ফলে তারা নিজদের গৃহে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকল।
(সূরা হুদ ৬৫-৬৮)
“والشفع والوتر”:
এখানে বোঝানো হয়েছে সেই দিনগুলোকে, যেগুলো জোড় অথবা বিজোড় ছিল। যেমন, আদ জাতির শাস্তির ঘটনায় সাত রাত ও আট দিন উল্লেখ আছে—একটি জোড়, অন্যটি বিজোড়।
আর মূসাকে যখন ফেরআউনের দিকে পাঠানো হয়েছিল, তখন তিনি নয়টি নিদর্শন নিয়ে যান, এরপর ফেরআউন ধ্বংস হয়—এটি দশম নিদর্শন।
“والليل إذا يسر”:
এটি সেই রাত্রি, যার পরপরই ফিরআউনের উপর আজাব এসেছে। আল্লাহ তাআলা অন্য স্থানে বলেন:
“আর আমি মূসাকে ওহী করলাম যে, ‘তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাত্রিতে বেরিয়ে পড়ো, নিশ্চয়ই তোমাদের পেছনে ধাওয়া করা হবে…’ তারপর আমি মূসা ও তাঁর সঙ্গীদের সবাইকে উদ্ধার করলাম এবং অন্যদের (ফিরআউন ও তার বাহিনীকে) ডুবিয়ে দিলাম।” (সূরা আশ-শু‘আরাঃ ৫২–৬৫)
আর আয়াতে “يسر” (রাত্রির চলা বা অতিক্রম) বলার মধ্যে ইঙ্গিত আছে এই কথার প্রতি যে, বিপদ ও কষ্ট মুমিনদের ওপর স্থায়ী হয় না। মূসা (আ.) রাতের বেলায় বেরিয়ে পড়েছিলেন, রাত অতিবাহিত হলো, এবং পরের দিনই বনি ইসরাঈল দেখতে পেল ফিরআউনের ডুবে যাওয়া।
এই সব দিনের উল্লেখ তৃতীয় অংশে আবার এসেছে, শুধু লূতের কওমের আজাবের কথা ছাড়া। এর কারণ সম্ভবত এই যে, প্রসঙ্গ ছিল অত্যাচারী জাতিগুলোর শক্তি ও তাদের কঠোর শাস্তি বর্ণনা করা, আর লূতের কওম এধরনের শক্তি বা পরাক্রমে পরিচিত ছিল না। আল্লাহই ভালো জানেন কোনটা ঠিক।
—————
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।