AkramNadwi

সুরা ইউসুফে السقاية ও الصواع শব্দের অর্থ

https://t.me/DrAkramNadwi/2326

بسم الله الرحمن الرحيم

————————–

আমেরিকায় বসবাসরত প্রসিদ্ধ কুরআনী গবেষক, উস্তায নুমান আলী খান আমার নিকট সুরা ইউসুফে “সিকায়া” ও “সোয়াআ'” শব্দের অর্থ সম্পর্কে একটি প্রশ্ন পাঠিয়েছেন।

উত্তর:

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“অতঃপর যখন সে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করে দিল, তখন সে তার ভাইয়ের বোঝার মধ্যে পানপাত্রটি (السقاية) রেখে দিল। তারপর এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করল: ‘হে কাফেলা! তোমরা তো অবশ্যই চোর।’ তারা ফিরে এসে বলল: ‘তোমরা কী হারিয়েছ?’ তারা বলল: ‘আমরা রাজবাটখারা (صواع الملك) হারিয়েছি, এবং যে এটি ফিরিয়ে দেবে, তার জন্য এক বোঝা খাদ্য রয়েছে, আর আমি এর নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’ … তারা বলল: ‘যদি তোমরা মিথ্যাবাদী হও, তবে এর শাস্তি কী?’ তারা বলল: ‘যার বোঝার মধ্যে এটি পাওয়া যাবে, সে-ই হবে এর শাস্তি। আমরা এইভাবেই জালিমদের শাস্তি দিয়ে থাকি।’ এরপর সে প্রথমে তাদের বোঝাগুলো পরীক্ষা করল, তারপর তার ভাইয়ের বোঝা থেকে এটি বের করে নিল। এইভাবেই আমি ইউসুফের জন্য কৌশল অবলম্বন করলাম… (সুরা ইউসুফ ৭০-৭৬)

সাধারণ মুফাসসিরদের মতামত:

ইমাম আবু জাফর তাবারী তার তাফসীরে বলেন: “السقاية” (সিকায়া) বলতে বোঝানো হয় পানপাত্র, যা রাজা পান করার জন্য এবং খাদ্য পরিমাপের জন্য ব্যবহার করতেন।

এরপর তিনি একাধিক বিদ্বান থেকে এই অর্থ উদ্ধৃত করেছেন এবং ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেছেন:
“এরপর রাজবাটখারা (সোয়াআ’) অর্থাৎ সিকায়া আনতে আদেশ দিলেন। বলা হয়, এটি রূপার তৈরি ছিল। এরপর এটি তার ভাই বেনিয়ামিনের বোঝার মধ্যে রেখে দেওয়া হলো। তারপর তিনি তাদের কিছুটা সময় দিলেন, এবং যখন তারা গ্রাম থেকে কিছু দূরে চলে গেল, তখন তাদের ধরা হলো। এরপর একজন ঘোষণা করল: ‘হে কাফেলা! তোমরা তো অবশ্যই চোর। থেমে যাও।’ এরপর তাদের কাছে দূত এসে বলল: ‘আমরা কি তোমাদেরকে সম্মানজনক আতিথেয়তা প্রদান করিনি? তোমাদের জন্য যথাযথ পরিমাণ খাদ্য পরিমাপ করিনি? তোমাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করিনি? এবং তোমাদেরকে আমাদের ঘরে স্থান দিইনি?’ তারা বলল: ‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন এই অভিযোগ?’ সে বলল: ‘আমরা রাজবাটখারা (সোয়াআ’) হারিয়েছি এবং এর জন্য তোমাদেরকেই সন্দেহ করছি।’ তারা বলল: ‘আল্লাহর কসম! তোমরা তো জানো, আমরা পৃথিবীতে দুষ্কর্ম করতে আসিনি এবং আমরা চোরও নই।’

আবু জাফর বলেন:
“আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, এরপর ইউসুফ তাদের বোঝা ও ব্যাগ পরীক্ষা করতে শুরু করলেন, রাজবাটখারা (সোয়াআ’) খোঁজার জন্য। প্রথমে তিনি তার অন্য ভাইদের ব্যাগ পরীক্ষা করলেন, একে একে প্রত্যেকের ব্যাগ দেখলেন, এরপর শেষ ব্যাগে, অর্থাৎ তার নিজের ভাইয়ের ব্যাগ পরীক্ষা করলেন এবং সেখান থেকে এটি বের করলেন।”

এতে দেখা যায়, “সিকায়া” ও “সোয়াআ’” একই জিনিস, যা পানপাত্র এবং খাদ্য পরিমাপের পাত্র উভয় হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। এবং অধিকাংশ মুফাসসির এই মতের প্রতিই গিয়েছেন।

এই ব্যাখ্যার অস্পষ্টতা:

এই ব্যাখ্যার কিছু অসুবিধা রয়েছে:

১. সাধারণত দরিদ্ররা একই পাত্র বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু ধনীরা তা করেন না। বিশেষত রাজারা তো একেবারেই তা করতেন না। প্রাচীন মিশর ছিল তখনকার উন্নততম সভ্যতা। তাই এটা কল্পনাও করা যায় না যে, পানপাত্র এবং খাদ্য পরিমাপের পাত্র একই হতো।

২. কুরআনের আয়াতগুলোতে ব্যবহৃত সর্বনামগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় যে, “ولمن جاء به حمل بعير وأنا به زعيم” (যে এটি আনবে, তার জন্য এক বোঝা খাদ্য, এবং আমি এর নিশ্চয়তা দিচ্ছি) ইত্যাদিতে সর্বনামটি পুংলিঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু পরে বলা হয়েছে: “ثم استخرجها من وعاء أخيه” (এরপর সে এটি তার ভাইয়ের ব্যাগ থেকে বের করল) — এখানে সর্বনামটি স্ত্রীলিঙ্গে এসেছে।

আল-জামখশারী তার তাফসীর আল-কশশাফ এ বলেছেন:
“যদি প্রশ্ন করা হয়: কেন ‘সোয়াআ’ (صواع) শব্দের জন্য একবার পুংলিঙ্গ এবং পরে স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে?’ উত্তর হলো: প্রথমে ‘সিকায়া’ (সিকায়া) অর্থে এটি স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে, অথবা ‘সোয়াআ’ শব্দটি পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়ভাবেই ব্যবহারযোগ্য।”

৩. একই বস্তু একই প্রসঙ্গে দুই ভিন্ন নামে কেন উল্লেখ করা হলো? যদি এটি একই বস্তু হতো, তবে একে হয় “সিকায়া” বলা হতো, নয়তো “সোয়াআ’”।

আল-জামখশারী এই প্রশ্নের জবাবে বলেন:
“সম্ভবত ইউসুফ এটি ‘সিকায়া’ নামে ডাকতেন, কিন্তু তার দাসেরা এটিকে ‘সোয়াআ’ বলত। তাই যে অংশে ইউসুফের সাথে সম্পর্কিত প্রসঙ্গ এসেছে সেখানে ‘সিকায়া’ বলা হয়েছে, আর যেখানে দাসদের কথা এসেছে সেখানে ‘সোয়াআ’ বলা হয়েছে।”

আরও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা:

আমি মনে করি, এর চেয়ে উত্তম ব্যাখ্যা হলো: এখানে দুটি ঘটনা একসঙ্গে সংঘটিত হয়েছে:

প্রথম ঘটনা: ইউসুফ তার ভাই বেনিয়ামিনের ব্যাগে পানপাত্র (সিকায়া) রেখে দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা: খাদ্য পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত রাজবাটখারা (সোয়াআ’) হারিয়ে গিয়েছিল।

ফলে খাদ্য পরিমাপের কাজে নিয়োজিত দাসেরা ইউসুফের ভাইদের উপর সন্দেহ করে এবং শাস্তির সেই বিধান নির্ধারণ করে, যা ইউসুফ চেয়েছিলেন:
“যার ব্যাগে এটি পাওয়া যাবে, সে-ই এর শাস্তি স্বরূপ বন্দি থাকবে।”

এখানে সর্বনাম পুংলিঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ এটি “সোয়াআ’” (صواع) শব্দের প্রতি ইঙ্গিত করছে। কিন্তু ইউসুফের ভাইরা “সোয়াআ’” চুরি করেননি। ফলে দাসেরা এটি খুঁজে পেল না, বরং তারা পানপাত্র (সিকায়া) খুঁজে পেল, যা ইউসুফ আ. নিজেই বেনিয়ামিনের ব্যাগে রেখেছিলেন। তাই বলা হয়েছে: “ثم استخرجها من وعاء أخيه” — এখানে সর্বনাম স্ত্রীলিঙ্গ হয়েছে, কারণ এটি “সিকায়া” (سقاية) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

সুতরাং রাজবাটখারা (সোয়াআ’) হারিয়ে যাওয়াটা ইউসুফের জন্য সহজ করে দিয়েছিল। তিনি নিজে কিছু করতে না গিয়েও তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়েছিলেন। খাদ্য পরিমাপের দাসরাই সেই কাজ করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কৌশলের অংশ হিসেবে কার্যকর হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“এইভাবেই আমি ইউসুফ আ. এর জন্য কৌশল অবলম্বন করলাম।”

——————–

# প্রশ্নোত্তর # তাফসীর

মূল: ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *