https://t.me/DrAkramNadwi/6042
بسم الله الرحمن الرحيم
——————
মুফতি সালমান সাহেব ইলাহাবাদীর রাজকীয় দাওয়াতের টেবিলে নানা ধরণের পানীয় পরিবেশিত ছিল। হাফেজ মাহমুদ করীম সাহেব লজ্জাবশত এক গ্লাস পান করলেন। ড. আনাস সাহেব ইলাহাবাদী কৃত্রিমতা দূর করে দুই গ্লাস পান করলেন। মুফতি সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শত্রুতার, তাই আমি পরের সম্পদ অপচয়ের নিয়তে তিন গ্লাস পান করলাম, আর যদি পেটের একটু বেশি জায়গা থাকত, তাহলে আরও কয়েক গ্লাস পান করতাম।
মাওলানা আফতাব সাহেব নাদভী, ধনবাদীর অভিধানে ‘মাজাজ’ (রূপক) বলে কিছু নেই। তিনি বললেন, “আপনারা গ্লাস কীভাবে পান করলেন? মানুষ তো পানি পান করে, দুধ পান করে, লাস্সি পান করে, রূহআফজা শরবত পান করে। আশ্চর্য! আপনারা তো গ্লাসই পান করে ফেললেন!”
তাঁকে বোঝানো হচ্ছিল, আমরা বিভিন্ন পানীয় পান করেছি, যা গ্লাসে পরিবেশিত ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁকে বোঝাতে সফল হওয়া যায়নি।
মানুষ ‘গ্লাস’ বলে, অথচ বোঝায় ভেতরের পানীয়। ‘বাড়ি’ বললে বোঝায় বাড়ির লোকজন, ‘দেশ’ বললে বোঝায় তার নাগরিকরা, ‘বইয়ের পৃষ্ঠা’ বললে বোঝায় তার শব্দ বা বাক্য।
বালাগাতবিদগণ এরকম প্রকাশভঙ্গিকে বলেন: “যখন পাত্র (ظرف) বলে পাত্রের ভেতরের জিনিস (مظروف) বোঝানো হয়।”
সুন্নত ও হাদীসের মধ্যে যে সম্পর্ক, তার একটি ব্যাখ্যাও এ রকমই:
সুন্নত হচ্ছে পাত্র (ظرف), আর হাদীস হচ্ছে তার ভেতরের বস্তু (مظروف)।
এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি যেটি সর্ববৃহৎ অনুগ্রহ ছিল, সেটি ছিল আল-কুরআন, যা তাঁর প্রতি ওহি হিসেবে নাজিল করা হয়েছে। তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, এটি কেবল কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক গ্রন্থ নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনপথ নির্দেশিকা। এর ওপর আমল করলে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা লাভ করা যাবে।
আসমানী শিক্ষাব্যবস্থার অনুযায়ী, তিনি এই কুরআনের ওপর আমল করেছেন। তাঁর এই আমলই হচ্ছে “সুন্নতে সানিয়া” এবং “উসওয়ায়ে হাসানা”—যার অনুসরণ প্রত্যেক মানুষের ওপর অপরিহার্য। কেউ যত বেশি তাঁর সুন্নতের ওপর আমল করবে, ততটাই সফল হবে। আর যে দূরে থাকবে, সে আল্লাহর দরবার থেকেও দূরে থাকবে।
নবীজির সাহাবায়ে কিরাম (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম) কুরআন ও সুন্নতের মধ্যে কোনো ফারাক করেননি। তাঁরা নবীজিকে বলতে শুনেছিলেন: “তোমরা এমনভাবে সালাত আদায় করো, যেমন আমাকে সালাত আদায় করতে দেখো।”
“তোমরা আমার থেকে তোমাদের হজের রীতি শিক্ষা নাও।” ইত্যাদি।
তাঁরা যখন কোনো আমল নবীজিকে করতে দেখতেন, তখন সেটি তাঁরা ঠিক তেমন করেই শিখতেন, যেমন করে কুরআন শিখতেন।
যেসব সাহাবী নিজে থেকে কোনো আমল প্রত্যক্ষ করেননি, বা যারা নবীজির ইন্তিকালের পর মুসলমান হয়েছেন—তাঁরা ওই সাহাবীদের থেকে সুন্নত শিখেছেন, যারা প্রত্যক্ষ দর্শনে ছিলেন।
যারা সরাসরি নবীজির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের কাছে সুন্নত কেবল ‘সুন্নত’ই ছিল। তাঁরা নবীজিকে যেমন করতে দেখতেন, তেমনি করতেন।
আর যারা সরাসরি শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তাঁদের কাজ কঠিন হয়ে পড়ল। এখন তাঁদের কাছে সুন্নত আর শুধু সুন্নত রইল না, বরং একটা রিপোর্টে পরিণত হলো।
অর্থাৎ যারা দেখেছে, তারা রিপোর্ট করছে, কী দেখেছে। এই রিপোর্টকেই আরবি ভাষায় বলা হয় হাদীস, খবর, নাবা ও তারীখ।
কিছু সুন্নত ছিল, যেগুলোর ওপর আমলকারী ছিলেন অনেক মানুষ—যেমন নামাযের রাকাত, যাকাতের নিসাবের বিবরণ, কুরবানী ইত্যাদি। আবার কিছু সুন্নত ছিল, যেগুলো একজন বা দুজন সাহাবীর আমল বা শিক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে।
যখন সুন্নত হাদীস বা খবরে পরিণত হলো, তখন অপরিহার্য হয়ে পড়ল এ বিষয়ে যাচাই করা—এই রিপোর্ট বা বর্ণনা সঠিক কি না?
প্রথম যুগে যারা সুন্নত বর্ণনা করতেন, তাঁদের মধ্যে দুটি শর্ত দেখা হতো—
এক. বর্ণনাকারী যেন সত্যবাদী হন ।
দুই. যা তিনি বর্ণনা করছেন, তা তিনি ভালোভাবে বুঝেছেন এবং বর্ণনা করার সময় পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
প্রথমটিকে বলা হয় ‘আদালত’ বা ‘ইস্তিকামাত’,
দ্বিতীয়টিকে বলা হয় ‘যবত’ বা ‘ইত্বকান’।
এই দুটির সম্মিলনকে বলা হয় ‘সিকাহ’ (ثقہ)—অর্থাৎ নির্ভরযোগ্যতা।
যখন বর্ণনা করার এই ধারা শুরু হলো, তখন তা কেবল সুন্নতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না।
কারণ মুসলমানদের মধ্যে তাঁদের নবীর প্রতি যে ভালোবাসা, তা আবেগপ্রসূত নয়—বরং তাঁদের দ্বীন ও ঈমানের দাবি।
নবীজির জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি তাঁদের কাছে প্রিয়। ফলে তাঁর দৈনন্দিন জীবন, তিনি কী খেতেন, কী পান করতেন, তাঁর স্ত্রীদের অবস্থা, যুদ্ধ-বিগ্রহের বিবরণ, তাঁর চেহারার বর্ণনা—সব কিছুই সংরক্ষিত হয়েছে।
যখন বর্ণিত বিষয়সমূহের পরিমাণ বেড়ে গেল, তখন ভুল বর্ণনার সম্ভাবনাও বেড়ে গেল, ঘটনাগুলোর মধ্যে গুলিয়ে যাওয়া শুরু হলো, আর রিপোর্ট-সংক্রান্ত যা যা সাধারণভাবে হয়, তার সব কিছুই ঘটতে থাকল।
এই উম্মতের ওপর আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ হলো—শুরু থেকেই আলেমগণ হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে কঠোর শর্ত আরোপ করেছেন।
হাদীসের মান এত উচ্চতর হয়েছে যে, বিশ্বের কোনো জাতির ইতিহাসই এর সমকক্ষ হতে পারে না।
এর বিস্তারিত আলোচনা একটি আলাদা প্রবন্ধে আসবে।
“উপরে যেমন বলা হয়েছে, হাদীস ও খবরের বিষয়বস্তু নানা রকমের হয়ে উঠেছিল, যেমন
সুন্নতে হুদা – অর্থাৎ রাসূল صلى الله عليه وسلم–এর সেই সকল আমল যেগুলোর সম্পর্ক কুরআনের প্রয়োগের সঙ্গে ছিল। এটিই সেই জিনিস যা শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনার প্রেরণ হয়েছিল।
সুন্নতে আদাহ – অর্থাৎ এমনসব কাজ যা আপনি একজন মানুষ হিসেবে বা একজন আরব হিসেবে করেছেন। যেমন, খাদ্য যেন হালাল ও পবিত্র হয়—এটা সুন্নতে হুদার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হালাল ও পবিত্র খাদ্য কীভাবে রান্না করা হবে, সেটা সুন্নতে আদাহর অন্তর্ভুক্ত। আপনি صلى الله عليه وسلم ত্রীদ খেতেন, আজ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমরা বিরিয়ানি খায়। সুন্নতে আদাহ অনুসরণ করা আবশ্যক নয়। তবে কেউ যদি ভালোবাসা থেকে তা অনুসরণ করে, তাহলে অনেক সময় সেই ভালোবাসার কারণে সে সাওয়াব পেতে পারে; কারণ রাসূলের প্রতি ভালোবাসা নিজেই একটি সুন্নতে হুদা।
আপনার বাহ্যিক বর্ণনা।
আপনার পরিবার ও কওমের অবস্থা।
যুদ্ধ ও সন্ধির বহু বিবরণ—যার মধ্যে কিছু বিবরণ সুন্নতে হুদার অন্তর্ভুক্ত, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুন্নতে হুদা ও সুন্নতে আদাহ–এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বহু গবেষক উপস্থাপন করেছেন। সবচেয়ে ব্যাপক ও স্পষ্ট ব্যাখ্যা তিনি করেছেন—শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, তাঁর বিখ্যাত কিতাব হুজ্জতুল্লাহিল বালিগা-তে।
সারকথা এই যে, হাদীস/খবর/রিপোর্টের মর্যাদা পাত্র (গ্লাস)-এর মতো, আর সুন্নতের মর্যাদা নির্দিষ্ট পানীয়-এর মতো। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহ—যেগুলোর একটি বড় অংশ সুন্নতে হুদা নিয়ে গঠিত।
এখানে আরও একটি বিষয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন, আর তা হলো: সুন্নতকে ‘সুন্নতে ইবরাহিমী’ বলা কি সঠিক? — এ প্রশ্নের উত্তর পরবর্তী প্রবন্ধে আসবে।
———-
যেমন উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, হাদীস ও বর্ণনাগুলোর বিষয়বস্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের হতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ:
১. সুন্নতে হুদা — এটি সেইসব আমল, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে কুরআনের শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যেই তাঁর প্রেরণও হয়েছিল।
২. সুন্নতে আদাহ — অর্থাৎ এমন কিছু কাজ, যা তিনি একজন মানুষ হিসেবে বা একজন আরব হিসেবে করেছেন। যেমন: খাবার হালাল ও পবিত্র হওয়া উচিত — এটি সুন্নতে হুদার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হালাল ও পবিত্র খাবার কীভাবে রান্না করা হবে — এটি সুন্নতে আদাহর অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘সারিদ’ খেতেন, আর আজকের উপমহাদেশের মুসলমানরা ‘বিরিয়ানি’ খায়। সুন্নতে আদাহ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক নয়; তবে কেউ যদি রাসূলের ভালোবাসা থেকে তা পালন করে, তাহলে সেই ভালোবাসার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাওয়াব পেতে পারে। কারণ রাসূলকে ভালোবাসা নিজেই সুন্নতে হুদার অন্তর্ভুক্ত।
৩. রাসূলের বাহ্যিক গঠন ও রূপের বিবরণ।
৪. তাঁর পরিবার ও জাতির পরিস্থিতি।
৫. যুদ্ধ ও শান্তি সংশ্লিষ্ট বহু বিশদ বিবরণ — যদিও এর কিছু কিছু অংশ সুন্নতে হুদার মধ্যেও পড়ে।
সুন্নতে হুদা ও সুন্নতে আদাহ — এই দুইয়ের ব্যাখ্যা অনেক গবেষক দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে সুসংহত ও স্পষ্ট ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা গ্রন্থে।
সারকথা হলো: হাদীস/খবর/রিপোর্টের অবস্থান একটি গ্লাসের মতো, আর সুন্নাহ তার মধ্যে থাকা বিশেষ পানীয়ের মতো। যেমন: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহ — এদের একটি বড় অংশে সুন্নতে হুদা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে — তা হলো: সুন্নাহকে ‘সুন্নতে ইব্রাহীমী’ বলা কি ঠিক? — এর উত্তর পরবর্তী লেখায় দেওয়া হবে। (ইন-শা-আল্লাহ)
——————–
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।