AkramNadwi

সুনানে তিরমিজিতে একটি হাদিসের দুর্বলতার কারণ ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/6193

بسم الله الرحمن الرحيم.


——————–

|| প্রশ্ন:

আমার প্রিয় ছাত্রী সালসাবিল হাজ শরীফ, আস-সালাম প্রতিষ্টানে (معهد السلام) অধ্যয়নরত, আমাকে লিখেছেন:

“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
শ্রদ্ধেয় শাইখ, আমি আপনাকে একটি হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাই যা আমি তিরমিজিতে পেয়েছি। হাদিসটি হাকিম তাঁর ‘মুস্তাদরাক’-এ, ইবনু মাজাহ তাঁর ‘সুনান’-এ, এবং ইমাম আহমদ তাঁর ‘মুসনাদ’-এ বর্ণনা করেছেন। তবে ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম তাঁদের ‘সহীহ’ গ্রন্থে এটি স্থান দেননি। আমি জানতে চাই এর কারণ কী।

আমি সনদের দিকে তাকিয়ে কোনো স্পষ্ট দুর্বলতা খুঁজে পাইনি।

এটাই সেই হাদিস:
قال رسول الله ﷺ:
“ألا أنبئكم بخير أعمالكم، وأزكاها عند مليككم، وأرفعها في درجاتكم، وخير لكم من إنفاق الذهب والورق، وخير لكم من أن تلقوا عدوكم، فتضربوا أعناقهم ويضربوا أعناقكم؟” قالوا: بلى، قال: “ذكر الله تعالى”.

وقال معاذ بن جبل رضي الله عنه: “ما شيء أنجى من عذاب الله من ذكر الله”.

“আমি কি তোমাদের এমন একটি কাজের কথা বলব না যা তোমাদের সেরা আমল, তোমাদের প্রভুর কাছে সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা সবচেয়ে উঁচু করবে, তোমাদের জন্য স্বর্ণ ও রূপা দান করার চেয়েও উত্তম, এমনকি শত্রুর মুখোমুখি হয়ে তাদের গর্দান কাটার বা তারা তোমাদের গর্দান কাটার চেয়েও উত্তম?”
তারা বলল, ‘অবশ্যই বলুন।’
তিনি বললেন: ‘আল্লাহর জিকির।’
তখন মু’আয ইবনু জাবাল (রাযি.) বললেন: “আল্লাহর জিকিরের মতো কোনো কিছুই আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারে না।”

আমার প্রশ্ন দুটি ভাগে বিভক্ত:
প্রথমত: কোন ‘ইলত’ (দুর্বলতা) এই হাদিসটিকে সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিমে স্থান পাওয়া থেকে বিরত রেখেছে?
দ্বিতীয়ত: যদি ঘরের মধ্যে বসে আল্লাহর জিকির করাকে জিহাদের ময়দানে গর্দান কাটা-কাটির থেকেও উত্তম বলা হয়ে থাকে, তাহলে তো তরবারি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও সীমান্ত পাহারা দেওয়ার ত্যাগ ও কষ্টের মানে কী? সহজ কাজ কীভাবে কঠিন কাজের চেয়ে উত্তম হয়?
এই কথা কি তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে যারা যুদ্ধ করতে অক্ষম—যেমন নারীরা, রোগীরা? তাহলে কি এটি তাদের মনোবল চাঙা করতে বা সান্ত্বনার জন্য বলা?”

|| উত্তর:

এই হাদিসটি ইমাম তিরমিজি ‘দাওয়াত’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন:
“আমাদের কাছে হাদিসটি হুসাইন ইবন হুরাইস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: আমাদের কাছে তা ফাজল ইবন মূসা বর্ণনা করেছেন, তিনি আব্দুল্লাহ ইবন সাঈদ (ইবনু আবি হিন্দ) থেকে, তিনি জিয়াদ (মাওলা ইবনু আয়াশ) থেকে, তিনি আবু বাহরিয়া থেকে, তিনি আবু আদ-দারদা (রাযি.) থেকে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: ‘আমি কি তোমাদের এমন একটি আমলের কথা বলব না যা তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, তোমাদের প্রভুর কাছে সবচেয়ে পবিত্র, মর্যাদায় সবচেয়ে উন্নত, স্বর্ণ-রূপা দান করার চেয়েও উত্তম এবং শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের গর্দান কাটার বা তোমাদের গর্দান কাটার চেয়েও উত্তম?’
তারা বলল: ‘অবশ্যই বলুন।’
তিনি বললেন: ‘আল্লাহর জিকির।’
মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযি.) বলেন: “আল্লাহর জিকিরের চেয়ে বেশি কোনো কিছু আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে না।”

এই হাদিসটি অনেকে একই সানাদে আব্দুল্লাহ ইবন সাঈদ থেকে বর্ণনা করেছেন, আবার কেউ কেউ তা মুরসাল রূপে (সাহাবির নাম বাদ দিয়ে) বর্ণনা করেছেন।

ইবনু মাজাহ হাদিসটি ‘আদব’ অধ্যায়ে ইয়াকুব ইবনু হুমাইদ ইবনু কাসিব, যিনি মুগীরাহ ইবনু আবদুর রহমান থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু সাঈদ ইবনু আবি হিন্দ থেকে, তিনি পূর্বোক্ত সানাদে তা বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে দুটি পৃথক সানাদে হাদিসটি এনেছেন।
হাকিম তাঁর ‘মুস্তাদরাক’-এ হাদিসটি এনেছেন এবং বলেছেন: “এই হাদিসের সানাদ সহীহ, তবে বুখারি ও মুসলিম তা বর্ণনা করেননি।”

তাহলে বুখারি-মুসলিম কেন তা গ্রহণ করেননি?
আমি বলি: হাদিসটিতে তিনটি দুর্বলতা (علل) আছে—

প্রথমত: সনদের দুজন বর্ণনাকারীর মধ্যে সহীহ হওয়ার শর্ত পূরণ হয়নি।
তারা হল:

আবু বাহরিয়া — তাঁর নাম আবদুল্লাহ ইবনু কায়স আল-কিন্দি আত-তারাগুমি আল-হিমসি। বুখারি-মুসলিমের শর্তে গ্রহণযোগ্য নন।

জিয়াদ ইবনু আবি জিয়াদ — নাম মাইসারাহ, আল-মাখজুমি আল-মাদানি, যিনি আব্দুল্লাহ ইবনু আয়াশ ইবনু আবি রাবিয়াহর মাওলা। বুখারি তাঁর কোনো হাদিসই গ্রহণ করেননি। মুসলিম শুধু ‘আরাক ইবনু মালিক’ থেকে তাঁর একটি হাদিস নিয়েছেন, কিন্তু এ হাদিস সে সানাদে নয়।

দ্বিতীয়ত: ইরসাল বা মুরসালভাবে বর্ণনা করা হয়েছে — যা তিরমিজি নিজেই উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয়ত: ওকূফ — ইমাম মালিক তাঁর ‘মুয়াত্তা’য় হাদিসটিকে সাহাবির (আবু দারদা) বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে সেখানেও সানাদে বিচ্ছিন্নতা আছে— অর্থাৎ জিয়াদ ইবনু আবি জিয়াদ ও আবু দারদার মাঝে একজন বর্ণনাকারী বাদ পড়েছেন। সম্ভবত তিরমিজি ইরসাল বলার মাধ্যমে এই বিচ্ছিন্নতাকেই ইঙ্গিত করেছেন।

হাদিসের ব্যাখ্যা:
এই হাদিস অন্য আমলের গুরুত্ব কমায় না; বরং তাদের গুরুত্বই প্রমাণ করে। আল্লাহর জিকির সব কিছুর মূল, এবং সব আমলের উদ্দেশ্যও সেটাই।

আল্লাহ তাআলা স্বয়ং নামাজ সম্পর্কে বলেছেন—যা ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:
“আর আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে নামায কায়িম কর।” [সূরা তোয়াহা, ২০:১৪]

এই হাদিসে যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে তারা এমন লোক, যারা সব ধরনের আমল করেন। তাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে মূল ভিত্তি—আল্লাহর স্মরণ।

আমরা তো দ্বীনের মূল ও শাখা—উভয় দিকেই মারাত্মক ঘাটতিতে আছি। আমাদের পক্ষে এই হাদিসকে জিকিরের মাধ্যমে জিহাদ ও রিবাত (সীমান্ত পাহারা) ত্যাগের অজুহাত বানানো ঠিক নয়।

আল্লাহ ও রাসূল যেসব ফরজ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, তা বাদ দেওয়া বা অবহেলা করা এই হাদিসের ভুল প্রয়োগ হবে।

মুনাওয়ী তাঁর ‘ফাইযুল কাদীর’ গ্রন্থে বলেছেন:
এই হাদিস তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, যাদের জন্য আল্লাহর জিকিরই সবচেয়ে উত্তম।
যদি কোনো সাহসী মুজাহিদ থাকেন, যিনি ইসলামের জন্য যুদ্ধ করলে কল্যাণ হবে, তাকে বলা হবে: “তোমার জন্য উত্তম হলো জিহাদ।”
যদি কোনো ধনী ব্যক্তি থাকেন যার দান দরিদ্রদের উপকারে আসবে, তবে বলা হবে: “তোমার জন্য উত্তম হলো সদকা।”
যদি কেউ হজে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তাকে বলা হবে: “তোমার জন্য উত্তম হলো হজ।”
যার পিতা-মাতা জীবিত, তাকে বলা হবে: “তাদের খেদমত করো।”

এভাবেই বিভিন্ন হাদিসের মধ্যে সমন্বয় ও ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *