AkramNadwi

সংযুক্ত আরব আমিরাতে সফর ❞ (পর্ব-৭)

https://t.me/DrAkramNadwi/5671

بسم الله الرحمن الرحيم.


শুক্রবার, ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

লেখক: ড. মুহাম্মদ আকরাম নাদভি,অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

|| ঘুমহীন রাতের ছায়া ও নতুন ভোরের সংগ্রাম :

গত রাত আমি মধ্যরাতের দিকে বিছানায় শুয়েছিলাম, আশা করেছিলাম যে দীর্ঘ দিনের ক্লান্তির পর দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু ঘুম আসার বদলে যেন তা আমাকে এড়িয়ে চলল। ডান দিকে-বাম দিকে কাত হতে হতে সময় পার হচ্ছিলো, কিন্তু কোনো ফল হচ্ছিল না। চিন্তা-ভাবনাগুলো আমাকে আক্রমণ করছিল, যা আমাকে আরাম বা বিশ্রাম করতে দিচ্ছিল না। আমি নিজের মনকে শান্ত করার এবং চোখ বন্ধ করার জন্য কঠোর চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ভোর তিনটার আগে ঘুম আমার দরজায় এসে কড়া নাড়ল না।। আর যা ঘুম হলো, সেটাও গভীর ছিল না। যেন স্বপ্নের মাঝেও কোনো ছায়া উপস্থিত ছিল, যা হয় আমাকে দেখতে চাইছিল অথবা আমি তাকে।

ফজরের নামাজের জন্য উঠে দেখি আমি চরম ক্লান্তিতে আক্রান্ত, মনোযোগ বিহীন এবং অবসন্ন। আমার প্রিয় অভ্যাস, অর্থাৎ ব্যায়াম করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জিমে যাওয়ার কোনো মানসিক শক্তি খুঁজে পেলাম না। বরং মনে হলো আমার দেহ আরও বিশ্রাম দাবি করছে। তাই ফজরের নামাজের পর আমি আবার শুয়ে পড়লাম। কিন্তু সেই ঘুমও ছিল হালকা ও ভাঙা-ভাঙা। মাঝেমধ্যে আমি জেগে উঠছিলাম।”

সকাল আটটার দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর শোয়া যাবে না এবং দিনটি শুরু করতে হবে। যা শক্তি অবশিষ্ট ছিল, তা একত্র করলাম এবং কাজ শুরু করলাম। হারিয়ে যাওয়া উদ্যমকে ধৈর্য ও হাতে থাকা কাজে মনোযোগ দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা করছিলাম। দিনের ক্লান্তিকর শুরুর পরেও আমি সচল থাকার এবং সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করে আমার কাজগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

|| ইব্রাহীমিয় পরিবার প্রাঙ্গণ :

সকাল দশটায় আমি ডক্টর জেনান-এর সঙ্গে আল -ইব্রাহীমি পরিবারের গৃহ পরিদর্শন করি। এটি একটি বহু ধর্মের ধর্মীয় কমপ্লেক্স যা আবুধাবির সাদিয়াত দ্বীপে অবস্থিত। এর নকশা মানব ভ্রাতৃত্বের দলিল থেকে অনুপ্রাণিত, যা বৈশ্বিক শান্তি ও সহাবস্থানের জন্য তৈরি। এই দলিলে ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে পোপ ফ্রান্সিস এবং আল আজহার মসজিদের ইমাম শায়খ আহমদ আত-তাইয়েব স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন শেখ সাইফ বিন যায়েদ আল নাহিয়ান (উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) এবং শেখ নাহিয়ান বিন মুবারক আল নাহিয়ান (সহনশীলতা ও সহাবস্থানের মন্ত্রী)।

আল-ইব্রাহীমি পরিবারের ঘরে তিনটি প্রধান উপাসনালয় রয়েছে: মুসা ইবনে মাইমুন সিনাগগ, সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ এবং ইমাম আত-তাইয়েব মসজিদ। এছাড়াও এখানে একটি সাধারণ উদ্যানও রয়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ধর্মীয় সংলাপ ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে শক্তিশালী করা, যাতে এটি মানব ভ্রাতৃত্বের দলিলের একটি বাস্তব রূপ হয়ে ওঠে।

আমাদের পরিদর্শনের সময়, আমরা বিভিন্ন ধর্ম ও জাতীয়তার বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষকে দেখতে পেলাম, যারা ধর্মীয় সহাবস্থান এবং মানব সভ্যতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির ধারণায় মুগ্ধ। জায়গাটি ভ্রমণকারীদের ভিড়ে পূর্ণ ছিল, যারা এই অনন্য অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানার আগ্রহ দেখিয়েছিল।

ডক্টর জেনান ধর্মগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণা জোরদারের গুরুত্ব নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এই ধরনের প্রকল্পগুলো সহনশীলতা ও সংলাপকে উৎসাহিত করে। তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, বিভিন্ন উপাসনালয় একই স্থানে একত্রিত করা ধর্মগুলোর ঐক্যের ধারণাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। আমার মনে হলো, বিভিন্ন পটভূমি থেকে আগত মানুষের এই অনন্য সাক্ষাৎ ইসলামকে ব্যাখ্যা করার এবং দর্শনার্থীদের হৃদয়ে তা প্রিয় করে তোলার সুযোগ খুলে দিতে পারে। এটি ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে বোঝাপড়ার প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে পারে।

||সাদিয়াতের পথচারী পথ :

আল-ইব্রাহীমি পরিবারের ঘর পরিদর্শন শেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এক ঘণ্টার জন্য সাদিয়াতের পথচারী পথে হাঁটবো। সেখানে আমরা উপভোগ করলাম নির্মল বাতাস এবং মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য, যেখানে আকাশের নীল রঙ এবং সমুদ্রের নীল রঙ একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। দৃশ্যটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক ছিল, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজ মাঠ এবং প্রশস্ত পথগুলো দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রাম ও ধ্যানের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। হাঁটার সময় আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের, বিশেষ করে আবুধাবির অবকাঠামোগত ও সভ্যতাগত উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছিলাম। আমরা শহরের অবিশ্বাস্য নগরায়নের কথা আলোচনা করছিলাম, যা আধুনিকতা এবং ঐতিহ্য রক্ষার মধ্যে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে।

আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দেশের জনগণের প্রতি দানকৃত সম্পদ ও সমৃদ্ধির নিয়ামত নিয়েও আলোচনা করলাম। এ নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ থাকা এবং আল্লাহর আনুগত্য করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করলাম, একইসঙ্গে পাপ থেকে বাঁচার জন্য সচেতন থাকার গুরুত্ব তুলে ধরলাম। এই আলোচনার সময় সূরা হূদ-এর বিষয়বস্তু আমার মনে পড়ে। এটি এমন একটি সূরা যা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, এমনকি তিনি বলেছিলেন, “আমাকে সূরা হূদ ও তার সহচর সূরাগুলো বার্ধক্যে উপনীত করেছে।” আমি ভাবছিলাম এই সূরার শিক্ষাগুলো, বিশেষত নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলার নির্দেশনা, যা বিশেষ করে এমন একটি সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক যেখানে প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই।

ক্লান্তি অনুভব করলে আমরা একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ক্যাফেতে থামলাম, যা মুক্ত বাতাসের নিচে অবস্থিত। আমরা বাইরে বসার সিদ্ধান্ত নিলাম। চারপাশের পরিবেশ ছিল শান্ত ও আরামদায়ক। আমরা দু’কাপ কফি অর্ডার করলাম এবং কিছুক্ষণ শান্তি উপভোগ করলাম। মাঝে মাঝে আমরা আবুধাবির চলমান নির্মাণকাজের আওয়াজ শুনছিলাম। এই শব্দগুলো বিরক্তিকর ছিল না; বরং শহরের উদ্যম ও ধারাবাহিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরছিল।

এই সময়টা ছিল একদম নিখুঁত চিন্তাভাবনার জন্য। এক জীবন্ত শহরের মধ্যে বসে থাকার সুযোগ, যা আপনাকে ঘিরে থাকা নিয়ামতগুলোর কথা ভাবতে উৎসাহিত করে। আমরা নির্মাণশৈলীর কোলাহল এবং প্রকৃতির নীরবতার মধ্যে উপলব্ধি করলাম, কীভাবে আবুধাবিতে জীবনের বিভিন্ন উপাদান একত্রিত হয়েছে। এটি এমন এক আধুনিক জীবনধারার উদাহরণ প্রদান করে, যেখানে বস্তুগত উন্নয়ন এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

|| জুমার নামাজ :

আমরা মসজিদ আল-হামদে জুমার নামাজ আদায় করতে গেলাম। মসজিদটি নামাজিদের ভিড়ে পরিপূর্ণ ছিল। মসজিদের অভ্যন্তরীণ কক্ষগুলো সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, এবং নামাজের কাতারগুলো বাইরের আঙ্গিনায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দৃশ্যটি অত্যন্ত মহিমাময় ছিল, যা মানুষের নামাজের প্রতি গভীর আকর্ষণকে প্রতিফলিত করছিল, এমনকি তীব্র গরম এবং দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও।

আমরা লক্ষ্য করলাম যে বেশিরভাগ নামাজি ছিলেন বিদেশি শ্রমিক, যারা মূলত নির্মাণকাজে নিয়োজিত। এটি ছিল প্রশংসনীয় যে এই কঠোর পরিশ্রমী পুরুষেরা জুমার নামাজে উপস্থিত হতে এতটা যত্নবান, যারা তাদের সময় সুচারুভাবে সাজিয়ে এই মহান ফরজ আদায় করেন। তাদের মুখাবয়বে আন্তরিকতা ও বিনম্রতা ফুটে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো তাদের জীবনের ক্লান্তি দূর করার জন্য এক বিশেষ শক্তি ও মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।

এই দৃশ্যটি আমাকে নামাজের মূল্য স্মরণ করিয়ে দিল—যা একজন বান্দা ও তার প্রভুর মধ্যে এক বিশেষ সম্পর্কের মাধ্যম। জীবনযাপনের ব্যস্ততা ও দায়িত্বের ভিড়ে নামাজ যেন এক আশ্রয়। এই শ্রমিকেরা, তাদের দৈনন্দিন ক্লান্তি সত্ত্বেও, শুধু নামাজ আদায়ের জন্য সময় বের করেননি, বরং মুসলিম উম্মাহর কাতারে যোগ দিয়েছেন। এটি এমন এক ঐক্যের চিত্র উপস্থাপন করে, যা বিভিন্ন জাতি ও পটভূমি থেকে আসা মানুষদের একত্রিত করে। মসজিদে এই মানবিক বৈচিত্র্য এবং একাত্মতা ইসলামের মহত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়—যা মানুষকে এক স্রষ্টার ইবাদতে মিলিত করে, যেখানে সব ভেদাভেদ মুছে যায় এবং কেবল ঈমানের বন্ধনই অবশিষ্ট থাকে।

খুতবায় আলোচনা করা হয়েছিল “আলহামদ” শব্দের অর্থ নিয়ে। আমি বলেছিলাম: আল্লাহ দুই ধরনের পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। প্রথমত, তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সকল দোষ ও অপূর্ণতা থেকে পবিত্র। এটি হল তাসবীহ। দ্বিতীয়ত, তিনি সৃষ্টিজীবের প্রতি তাঁর অসীম অনুগ্রহ ও দানশীলতায় পরিপূর্ণ। এটি হল তাহমীদ, যার মধ্যে রয়েছে প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার মিশ্রণ। তাই “আলহামদ” শব্দটি সৃষ্টির বর্ণনা, হিদায়াত, কুরআন অবতরণ এবং সব ধরনের নিয়ামতের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। অপরদিকে, তাসবীহ আল্লাহকে পবিত্র বলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, যেমন রুকু ও সিজদায়।

কুরআনে তাসবীহ শব্দটি নামাজ অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ এটি একজন বান্দার বিনম্র অবস্থাকে প্রকাশ করে। তাই দোয়া শুরুতে বলা হয়: “সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা…” যা তাসবীহ ও তাহমীদের মিশ্রণ।

মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি এবং উপস্থিত নামাজিদের মুখে যে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা দেখেছি তাতে গভীর মুগ্ধতা অনুভব করলাম। এই বিশাল জমায়েত এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ইসলামের সৌন্দর্য এবং মানুষের হৃদয়কে আল্লাহর ইবাদতে একত্রিত করার ক্ষমতার এক জীবন্ত উদাহরণ ছিল। জীবনযাত্রার চাপ এবং দায়িত্বের ভিড়েও এই ঐক্য আমাদেরকে ইসলামের অপার মহিমা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম। ড. জিনান তাঁর প্রাচ্য অধ্যয়ন কর্মসূচির কার্যালয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন এবং অন্য অফিস এবং তাদের মালিকদের সম্পর্কে বললেন। আমি এই মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুশি হয়ে বললাম:
“তোমার দেশ আমার দেশের স্থান নিয়েছে,
তোমার সম্পদ আমার সম্পদের ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছে।”

|| শায়খ নি’মাতুল্লাহ নদভী :

আমি বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বাড়ি থেকে বের হলাম। আমার সঙ্গী ছিলেন আখলাকুর রহমান নদভী, যিনি তাঁর দুই সহকর্মী নদভীদের সঙ্গে গাড়িতে এসেছিলেন। যাত্রাপথে আমরা তাঁদের শিক্ষাজীবন, বিভিন্ন আগ্রহ ও বর্তমান কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করলাম। পাশাপাশি আমরা দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা সম্পর্কে কথা বললাম—এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ, যা শরীয়তবিদ্যা ও আরবি ভাষার প্রচারে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমরা প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্জন এবং সেখান থেকে স্নাতক হয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া আলেমদের সম্পর্কে মত বিনিময় করলাম।

প্রায় পাঁচটার দিকে আমরা পৌঁছালাম শায়খ নি’মাতুল্লাহ নদভীর বাড়িতে। তিনি নদওয়াতুল উলামার একজন প্রাক্তন ছাত্র, যিনি আমার থেকে পাঁচ বছর আগে
থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। এরপর তিনি মদিনার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে আবুধাবিতে দাঈ ও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে আবুধাবিতে বসবাস করছেন। তাঁর জ্ঞান ও দাওয়াতের মাধ্যমে তিনি সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন এবং মানুষ তাঁর শিক্ষাদান থেকে উপকৃত হয়েছে।

শায়খের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক ছিল। তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষ, পাশাপাশি ইসলামি শিক্ষায় পারদর্শী। তাঁর চরিত্র ছিল নম্রতা ও মহত্ত্বে পূর্ণ। এমনকি তাঁর বিশাল মর্যাদাও তাঁকে বিনীত রেখেছে।

শায়খের বাড়িতে আমি তাঁর একজন আমিরাতি বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এই ব্যক্তিটি অত্যন্ত বিদ্বান এবং জ্ঞানীজনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি ভারতে গিয়ে দেশটির আলেমদের থেকে ইলম গ্রহণ করেছেন এবং তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছেন। যদিও আমি তাঁর নাম স্মরণ করতে পারিনি, তবে তাঁর কুনিয়াহ আবু আব্দুল্লাহ মনে আছে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং আমাকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুত্র মুসআব, একজন ভদ্র, মার্জিত এবং সুশৃঙ্খল তরুণ। আমি তাঁদের প্রথমিক হাদিসের পাঠ শোনালাম এবং তাঁদের সাধারণ অনুমতি দিলাম। এটি আমাদের বৈঠকে একটি বরকতময় বৈজ্ঞানিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

আমরা শায়খ নি’মাতুল্লাহর বাড়িতেই মাগরিব এবং এশার নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে আমরা চা, মজাদার ফলমূল ও সামোসা খেতে খেতে আলোচনা শুরু করি। পরিবেশ ছিল অত্যন্ত উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। আমরা হাদিস শরিফ, নদওয়াতুল উলামার অবদান এবং জ্ঞানচর্চা ও প্রসার নিয়ে আলোচনা করলাম। কথোপকথন ছিল সমৃদ্ধ এবং উপকারী, যা আমাদের মধ্যে জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহকে প্রতিফলিত করেছিল।

এই বৈঠকটি শেষ হয় আমাদের হৃদয়ে কৃতজ্ঞতা নিয়ে, কারণ এই বরকতময় মুহূর্তগুলো আমাদের আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং জ্ঞান অর্জনের একত্রীকরণে আবদ্ধ করেছিল। এটি ইসলামি ভ্রাতৃত্বের চেতনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ ছিল, যা সীমা ও দূরত্ব অতিক্রম করে সকলকে একত্রিত করে।

|| নদভীদের সাথে এক সন্ধ্যা :

শায়খ নি’মাতুল্লাহ নদভীর বাড়িতে সেই বরকতময় বৈঠক শেষ হওয়ার পর, আমি তাঁর এবং আখলাকুর রহমান নদভীর সঙ্গে একটি বৈঠকখানার দিকে রওনা দিলাম। সেখানে নদভীরা একটি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক মিলনমেলার আয়োজন করেছিলেন। সভাকক্ষে পৌঁছানোর পর আমরা দর্শকদের বিপুল উপস্থিতি দেখে বিস্মিত হলাম। গোটা পরিবেশ ছিল জ্ঞান ও দাওয়াতের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা এবং যৌথ আগ্রহে পরিপূর্ণ।

উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন অনেক বিদ্বান ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন:

> শায়খ নিজামুদ্দিন নদভী,
> ড. ওলীউল্লাহ নদভী,
> শায়খ খালিদ কানফুরি (আমার এক পুরনো সহকর্মী),
> শায়খ ওয়াজির আহমদ আজমি (আরেক প্রিয় সহকর্মী),
> শায়খ আবদুস সামি কাজমি, এবং
> শায়খ সুহাইব নদভী, যিনি আমাদের প্রিয় শায়খ এবং গবেষক মুহাক্কিক শাহবাজ ইসলামি (রহিমাহুল্লাহ)-এর পুত্র।

এই মহৎ আলেমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ একটি মূল্যবান সুযোগ ছিল। তাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্র ও অবস্থান থেকে জ্ঞান ও দাওয়াতের বার্তা বহন করছেন।

এই সম্মানিত সমাবেশে আমি একটি বক্তব্য রাখি। এতে আমি নদওয়াতুল উলামার গুরুত্ব এবং এর বৈজ্ঞানিক মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করি। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করি, এই প্রতিষ্ঠান কতজন প্রতিভাবান আলেম ও সাহিত্যিক উপহার দিয়েছে। আলোচনায় আমি আমাদের দুই প্রিয় শায়খ, আলিম মুহাম্মাদ ওয়াজিহ রশীদ নদভী এবং আলিম শাহবাজ ইসলামি (রহিমাহুল্লাহ)-এর গুণাবলির ওপর আলোকপাত করি। তাঁদের বৈজ্ঞানিক ও দাওয়াতি অবদান এবং তাঁদের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে যে গভীর প্রভাব পড়েছে, তা তুলে ধরি। উপস্থিতরা তাঁদের জীবনী শুনে স্পষ্টতই আবেগাপ্লুত হন, কারণ এই মহান

ব্যক্তিত্বরা ইসলামের খেদমতে অমূল্য অবদান রেখেছেন।

শায়খ নাজমুদ্দিন নদভী, শায়খ নি’মাতুল্লাহ নদভী, এবং ড. ওলীউল্লাহ নদভীর বক্তব্যও আমাদের আলোচনায় আরও গভীরতা যোগ করে। দর্শকদের প্রশ্ন ও তাঁদের মতবিনিময় অনুষ্ঠানের উত্কর্ষতা বাড়িয়ে দেয়।

সভা শেষে আমরা এক মনোজ্ঞ রাতের খাবারে অংশ নিই, যা শায়খ শব্বীর আহমদ নদভী (রহিমাহুল্লাহ)-এর ভাতিজা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে আয়োজন করেছিলেন। এই খাবারের সময়টিও ছিল উপস্থিতদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করার এক অনন্য সুযোগ। আমরা আমাদের স্মৃতি, আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করি। তাঁদের সঙ্গে কাটানো সময় আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক ছিল। আমি যেমন তাঁদের প্রতি মুগ্ধ, তেমনি তাঁরাও আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন।

|| পরিশেষ :

এই বৈঠক থেকে আমি কৃতজ্ঞ হৃদয়ে বিদায় নিলাম। এই মুহূর্তগুলো ছিল জ্ঞান ও ভ্রাতৃত্বের সমন্বয়ে পূর্ণ, যা আমাদের মধ্যে ইসলামের বার্তা প্রচারে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। “আমি চলে এসেছি, তবে তাঁদের স্মৃতি হৃদয়ে অমলিন রয়ে গেছে।”

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *