https://t.me/DrAkramNadwi/5685
بسم الله الرحمن الرحيم
❝
লেখক : ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী
অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।
||
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এতে “আমরা আমরা” শব্দের পুনরাবৃত্তি, আর “আমি আমি” শব্দের আধিক্য। “আমি আমি” মানে অহংকার, ঔদ্ধত্য, গর্ব, আর অযথা নিজের ঢাক পেটানোর প্রকাশ। কথার বড়াই কতটা নিন্দনীয়! নিজের প্রশংসা কতটা অশোভন! এর চেয়ে বড় দোষ আর কী হতে পারে যে একজন মানুষ নিজের বিষয়ে কথা বলে, অথচ তার নিজের কিছুই নেই—বরং তার নিজের অস্তিত্বও তার নিজের নয়।
হে আদম সন্তান! হে শূন্যতার প্রতিপালিত! নিজের প্রকৃত সত্তা চিনে নাও, নিজের সীমা জানো। তোমার জ্ঞান কি এক মিথ্যার গল্প নয়? তোমার ক্ষমতা কি এক অসহায়তার কল্পনা নয়? তোমার কাছে এমন কী আছে যা সত্যিই তোমার? বরং তুমি নিজেই বা কী? তুমি বলছ “আমি,” “আমার,” “আমাকে”—এই শব্দগুলোর অর্থ কী? মাথা থেকে পা পর্যন্ত, বাহ্যিক থেকে অন্তর্দেশ পর্যন্ত, এমন কী আছে যা “আমি” নামে পরিচিত? নামহীন কিছু কি মিথ্যা নয় কি ? প্রমাণহীন দাবি কি ভ্রান্তি আর অসত্যের শামিল নয়? তোমার মিথ্যার বড়াই আর অহংকারের কীই-বা মূল্য? তোমার কল্পনাপ্রবণতা আর বাহ্যিকতা-প্রীতি কতটা করুণ!
|| হে মাটির সন্তান!
হে অপবিত্র বীজ থেকে উদ্ভূত মানব!
তোমার শুরু নিরাশ্রয়ের অসীম শূন্যতায়, আর তোমার শেষ নিকটবর্তী বিলীনতায়। তুমি নিজের ইচ্ছায় এই পৃথিবীতে পা রাখনি, আর নিজ ইচ্ছায় এখান থেকে বিদায়ও নেবে না। বলো, সত্যি করে বলো—যা তুমি “ইচ্ছা” বলে অভিহিত করো, তা আসলে কী? তোমার অন্তর কি সাক্ষ্য দেয় না যে “ইচ্ছা” তোমার সৃষ্ট নয়, তোমার সম্পত্তিও নয়? তোমার কাছে কি উন্মোচিত হয়েছে সেই রহস্য যে “ইচ্ছার” উৎস কোথায়? “ইচ্ছা” কেমন করে গঠিত হয়?
তুমি নিজেকে “ইচ্ছাশীল” বলো, আর তোমার মতো মানুষদের “ইচ্ছাপূরণকারী” মনে করো। এই ভ্রান্ত তর্কে পূর্ব-পশ্চিম হাসে, আর ভূমি ও সমুদ্র বিস্ময়ে থমকে যায় এই শব্দচাতুর্যের খেলায়।
হে অজ্ঞতার সিংহাসনে বসা!
হে অসচেতনতার আসর সজ্জিতকারী!
তোমার অজ্ঞতা সবার সামনে প্রকাশিত, আর তোমার অসচেতনতার গল্প সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তবুও তুমি নিজেকে বড় মনে করো, অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করো। অহংকার কি তোমার জন্য শোভনীয়? ঔদ্ধত্য ও গর্ব কি তোমার উপযুক্ত?
তুমি যদি প্রকৃত দৃষ্টি রাখো এবং তোমার হৃদয় যদি জাগ্রত হয়, তবে বুঝবে তুমি খুব শীঘ্রই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে, তোমার অস্তিত্ব একটি অতীত কাহিনীতে পরিণত হবে। তুমি থাকবে না, তোমার স্মৃতিও মুছে যাবে। সব চিহ্ন মুছে যাবে, তুমি অন্ধকার হয়ে যাবে, তোমার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যাবে। কেউ তোমার ভালো কিছু বলতে পারবে না, খারাপ কিছুও না। তোমার প্রশংসা অর্থহীন হবে, আর তোমার নিন্দাও তোমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
তোমার অবস্থা সেই তৃণবীজের মতো, যা আগ্নেয়গিরির চূড়ায় উড়ে বেড়ায়। বলো, আগ্নেয়গিরির সামনে এই তৃণবীজের জীবনের স্থায়িত্ব কতটুকু? বলো, এই দুর্বল, গর্বিত ঘাসের আত্মপ্রবঞ্চনা কত দিন টিকবে? এই অসহায় সত্তা আগ্নেয়গিরির উপর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে?
যদি তোমার অস্তিত্ব নিয়ে গর্ব থাকে, তবে জেনে রাখো, এটি কেবল একধরনের অহমিকার বস্তু। তুমি কি জানো না যে যখন ফুল ফোটে, তখন বসন্ত নয়? বরং শরৎ ঋতুই উপস্থিত। তুমি যদি তোমার বাকশক্তি নিয়ে গর্ব করো এবং নিজেকে বুলবুল কিংবা তোতাপাখির মতো ভাবো, তবে ভেবে দেখো, তোমার জন্মের আগে এই বাকশক্তি কোথায় ছিল? আর মৃত্যুর পরে তোমার এই বাকশক্তির পরিণতি কী হবে?
যদি তুমি তোমার বুদ্ধি নিয়ে গর্ব করো, তবে কি ইতিহাস তোমাকে জানায়নি যে প্রাজ্ঞ এবং প্রতিভাবান মানুষেরা কোথায় হারিয়ে গেছে? বিশাল প্রতাপের সময়ে হঠাৎ মৃত্যু তোমার শিকার করবে, এটা কি তুমি নিশ্চিত না?
তোমার এই অস্তিত্বের যাত্রা কেবল কয়েক মুহূর্তের। কোনো শহর, কোনো গন্তব্য, কোনো পথপ্রদর্শক বা সঙ্গী—কিছুই নেই। পথের কোনো বিরাম নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট পথ।
হায়! তুমি এই অস্তিত্বের মায়ায় মুগ্ধ হয়েছো, আর তোমার নশ্বরতা সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়েছো। জীবনের সমস্ত তেজ এবং উচ্ছ্বাস কেবল এই জন্য যে, তুমি মাটিতে মিশে যাও। সেই সময় কত কাছেই না, যখন তোমাকে জীবনের গল্পের একটি হারিয়ে যাওয়া পাতায় পরিণত করা হবে:
“পা পড়ল এক মস্তকাধারীর ওপর, যা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে।
সে বলে উঠল, ‘সাবধানে হাঁট, পথিক! আমিও একদিন কারো গর্বের মুকুট ছিলাম।’’
জীবনের প্রতিটি শ্বাস কতটা অনিশ্চিত! যে আর্তনাদ একবার ওঠে, তা দ্রুত নিঃশব্দ হয়ে যায়। শিশিরবিন্দু কতই না ক্ষণস্থায়ী! তার সৌন্দর্য কেবল সেই ভোর পর্যন্ত স্থায়ী, যা সূর্যের আলো ছড়াতেই বিলীন হয়ে যায়। বাগানের প্রতিটি সৌন্দর্যের গল্প এমনই।
“আমি বললাম, ‘ফুলের স্থায়িত্ব কতটুকু?’
কুঁড়ি শুনে হাসল।”
যদি হৃদয় আলোকিত হয় এবং মস্তিষ্ক বুদ্ধিমান হয়, তবে তুমি বুঝতে পারবে যে তোমার অস্তিত্ব কেবল একধরনের প্রতারণা। তুমি কেবল এক স্বপ্ন, এক কল্পনা, এক মরীচিকা। হায়! তোমার নির্বুদ্ধিতা এবং অজ্ঞতা! তবুও তুমি অহংকার করো! তোমার আত্মপ্রবঞ্চনা এমন এক দুরারোগ্য ব্যাধি।
সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল কোথায় গেল? আল-ফারাবি, ইবনে সিনা ও মোল্লা সাদরা কোথায় মিশে গেল? ফিরাউন, কারুন, হামান কোথায়? আলেকজান্ডার, ফিরদৌস এবং দারার প্রতাপ কোথায়?
“যে মস্তক আজ রাজত্ব নিয়ে গর্বিত,
কাল তার উপর হবে শোকের মাতম।”
|| হে আদমের সন্তান!
তুমি দুর্বল। যদি তোমার হাতে দারার শৌর্য আসে, আলেকজান্ডারের মহিমা তোমার ভাগ্যে জোটে, তুমি সোলায়মানের রাজত্বের উত্তরাধিকারী হও, এবং জুলকারনাইনের সমকক্ষ হও—তবুও তুমি অক্ষম। সবচেয়ে দুর্বল প্রাণীও তোমাকে পরাস্ত করতে পারে। একটি সাধারণ রোগই তোমার অক্ষমতার পর্দা উন্মোচন করতে সক্ষম। দুর্গ ও প্রাচীরের মধ্যে তুমি নিরাপদ নও। মানুষ ও জিনের সৈন্য দ্বারা সুরক্ষিত, তরবারি ও বর্শার ছায়ায় থেকেও তুমি নিরাপত্তা অনুভব করো না। আরব-আজম, গ্রিক-রোমের চিকিৎসকরা, এমনকি গ্যালেন এবং ইবনে সিনার মতো মহান চিকিৎসকরা তোমার রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় অক্ষম। মৃত্যুর দূত সামনে এলে সবাই মাথা নত করে।
|| তুমি নির্ভরশীল।
যদি তোমার হাতে কারুনের সম্পদ আসে, পৃথিবীর সব সোনা-রূপার মালিক হও, পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত সম্পদ দখলে রাখো—তবুও তুমি ফকির , তুমি অসহায়। এই জগতের বিস্তৃতিও তোমাকে আশ্রয় দিতে পারে না। সম্ভাবনার জগতের বিশালতাও তোমাকে স্বাবলম্বী বানাতে পারে না।
তোমার প্রভু শক্তিশালী ও অজেয়।
তিনি ধনী ও নির্ভরহীন। এই বিশাল কারখানা তাঁরই সৃষ্টি। স্থান তাঁরই এবং সময়ও তাঁরই। তিনি সর্বশক্তিমান, জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাময়। আরশ-কুরসি এবং নীল আকাশ তাঁরই। সবাই তাঁর অধীনস্থ। তাঁর প্রতিটি আদেশই অসীম প্রজ্ঞার ভাণ্ডার। সৌন্দর্য ও কৃপার উৎস তিনিই। স্বর্গের সকল সৌন্দর্য তাঁর কীর্তির একটি ক্ষুদ্র আভাস।
তাঁর মহিমা প্রতিটি কণায় প্রকাশিত। তিনি অদৃশ্য থেকেও সর্বত্র বিরাজমান। তাঁর জ্যোতির্ময় প্রতাপ সর্বত্র প্রতিফলিত। তাঁর পূর্ণ শক্তি ও প্রজ্ঞা সবকিছুতে প্রমাণিত। ছয় দিকেই তাঁর সৌন্দর্য ও মহিমার প্রদর্শনী চলছে। তিনি বেপর্দা এবং বেখেয়াল। তাঁর দর্শনের জন্য প্রয়োজন পবিত্র চক্ষু ও একাগ্র দৃষ্টি। তিনি বাণীর ঊর্ধ্বে এবং চিন্তার ঊর্ধ্বে। তাঁর মহত্ত্ব কী—তিনি পবিত্র এবং মহিমান্বিত।
প্রত্যেক সৃষ্টিই তাঁর বন্দনা করে।
সবাই তাঁর প্রশংসায় মুখর। প্রতিটি জীবের ঠোঁটে তাঁর কাহিনি, প্রতিটি পাখির কণ্ঠে তাঁর গুণগান। যে তাঁকে স্মরণ করে, সে তাঁরই স্মরণে মগ্ন। তাঁর স্মরণ ছাড়া অন্য কিছু মানায় না। তাঁর প্রশংসার সঙ্গে অন্য কারও প্রশংসা সাজে না। তিনি সৃষ্টিকুলের প্রশংসা থেকে মুক্ত এবং মানুষের বোধের সীমার বাইরে।
মানুষ মূর্খ ও অবিচারী। এত জ্ঞানহীনতা ও অন্যায় সত্ত্বেও মানুষ কীভাবে তার প্রভুর বর্ণনা করতে পারে? সব পবিত্র ফেরেশতারা যদি একত্র হয়ে তাঁর প্রশংসা রচনা করে, তবুও তা অসম্পূর্ণ থাকবে।
হে আদমের সন্তান!
তিনিই তোমার আশ্রয়। তিনিই তোমার প্রার্থনা কবুল করেন। তিনিই প্রয়োজন পূরণকারী এবং মর্যাদা বৃদ্ধিকারী। তিনি তাঁর “كن” আদেশ দিয়ে সময়ে সময়ে তকদিরের সিদ্ধান্ত করেন। তিনি যা চান, তাই ঘটে। যা চান না, তা ঘটে না। যার মুখ আল্লাহর দিকে নিবদ্ধ, তার জন্য কোনও বিপদ নেই। যার হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দু তাঁর প্রভু, তার জন্য কোনও দুঃখ নেই।
তাঁর প্রতি মনোযোগ দাও।
দুর্বল ও অজ্ঞ মানুষের সম্পর্ক ছিন্ন করো। যিনি এই পুরো জগত সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সম্মানে মাথা নত করো। তাঁকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানাও। তাঁর সামনে আনুগত্যের সেজদা করো। একত্ববাদের প্রশংসায় জিহ্বা সিক্ত করো। ক্ষমাশীলের বন্দনা করো। প্রিয়তম প্রভুর দরজার বাইরে আর কারও কাছে মাথা নত করো না। শুধুমাত্র আল্লাহর স্মরণে জীবন নিবেদিত করো।
“লাব্বায়েক! হে দুই জগতের বিচারক! আমাকে অহংকার থেকে মুক্ত করো। পাপীর লজ্জার অনুভূতি দাও। আমিই অসহায়—হে সহায়ক! আমাকে সাহায্য করো। তোমার দয়া ও করুণা ছাড়া আমার আর কোনও আশ্রয় নেই। হে বিশ্বজগতের প্রতিপালক! আমাকে করুণা করো।”