শিরোনাম : লেখা ও চিঠিপত্রের সোনালি যুগ: এক হারানো সভ্যতার কাতর স্মৃতিচারণ।
——————–
“আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু আপনি রিসিভ করলেন না।”
“হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করেননি।”
“কয়েকবার মিস কল দিলাম, কিন্তু আপনি নিরবই রইলেন।”
এটাই আমাদের যুগের সেই অসহনীয় বোঝা—যেখানে যোগাযোগের আধুনিক মাধ্যমগুলো যতটা সুবিধা দিয়েছে, মানুষ ঠিক ততটাই অস্থিরতা ও অশিষ্টাচারকে বাড়িয়ে তুলেছে। প্রত্যেকেই চায়, সে কল দিলে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর মেলে; বার্তা পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে জবাব আসুক। কেউ ভাবতে চায় না যে অপরপক্ষ হয়তো ব্যস্ত, বিশ্রাম নিচ্ছে, কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিমগ্ন।
যোগাযোগ ও বার্তা প্রেরণের এই তড়িৎগতি যেমন জীবনে সহজতা এনেছে, তেমনি এক ধরনের বেপরোয়া স্বচ্ছন্দ্যতা ও অযথা হস্তক্ষেপকেও সাধারণ করে তুলেছে। ফোন করা ও মেসেজ পাঠানো এতটাই সহজ হয়ে গেছে যে, মানুষ অন্যের সময়ের মূল্য ভুলে বসেছে। যদি তারা বুঝত যে প্রতিটি কল বা প্রতিটি মেসেজ জরুরি নয়! মাঝে মাঝে মন চায় এ ধরনের অকারণ ও অযথা যোগাযোগের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করি; কিন্তু আবার ভাবি—দোষ তো আবিষ্কারের নয়, ব্যবহারের ভঙ্গিমার।
কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো, যখন চিঠি লেখার রেওয়াজ ছিল? তখন শব্দগুলো ভেবে লেখা হতো, অনুভূতিগুলো যত্নে কলমবন্দি করা হতো। আর প্রাপক প্রতিটি শব্দকে মর্যাদা দিত। চিঠির অপেক্ষার মধ্যেই এক মিষ্টি অনুভূতি লুকিয়ে থাকত, আর উত্তর আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে এক রকম প্রশান্তি মিশে থাকত। আজকের সুবিধা আমাদের কাছ থেকে সেই গাম্ভীর্য আর সেই সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে।
আজ হঠাৎ করেই সেই যুগের স্মৃতি হৃদয়ে গভীরভাবে ভেসে উঠছে। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির আত্মা লুকিয়ে থাকে তাদের স্মৃতিতে। যদি কোনো জাতি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে ভুলে যায়, তবে তার বর্তমান হয়ে পড়ে নিরুৎসব, আর ভবিষ্যৎ হয়ে যায় দিশাহীন।
হায়! এ মর্মান্তিক পরিণতিই আমাদের জীবনে প্রবেশ করেছে। আমরা অগ্রগতির চাকচিক্যে হারিয়ে ফেলেছি সেই মূলধন, যা একসময় ছিল আমাদের আত্মার প্রশান্তি, আমাদের সমাজজীবনের সৌরভ।
অতীতের ছায়ায় চোখ রাখলেই ভেসে ওঠে এমন এক যুগ, যেখানে ভালোবাসা, অভিমান, আনন্দ-বেদনা ও সম্পর্কের সুতো গাঁথা থাকত চিঠির মাধ্যমে। প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি মহল্লায় ঝুলে থাকা ডাকবাক্স ছিল মানব-অনুভূতির বিশ্বস্ত রক্ষক। তাতে যতই মরিচা ধরুক, তার ভেতরে রাখা কাগজগুলোয় বয়ে যেত কেবল শব্দ নয়, ধুকপুক করা হৃদয়ের স্পন্দনও।
কখনো চিঠি থাকত খামে মোড়া, কখনো বা এক টুকরো পোস্টকার্ড—হায়! সেই ছোট্ট আয়তাকার কাগজ! দেখায় তুচ্ছ, অথচ প্রভাবে পাহাড়সম দৃঢ়। দামে সস্তা, কিন্তু অনুভূতিতে অমূল্য। আপাত দুর্বল, কিন্তু সহজেই বহন করত গভীর আবেগের ভার। সেই কাগজে কখনো আসত সুস্থতার খবর, কখনো অসুস্থতার সংবাদ, কখনো আসত বিয়ের নিমন্ত্রণ, কখনো আবার প্রিয়জনের মৃত্যুবার্তা। প্রায়ই দেখা যেত—শব্দগুলো প্রান্ত ছাপিয়ে যেন চিৎকার করে বলছে: “ভালোবাসা কোনো সীমানায় বাঁধা নয়।”
সেই চিঠিগুলোতে ছিল এক অদ্ভুত জাদু। কোনো প্রিয়জনের লেখা হাতে এলে মনে হতো, শত মাইল দূরে বসা তার মুখ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কলম নয়, হৃদয় কথা বলত। কালির সুগন্ধ, কাগজের সোঁদা গন্ধ—সব মিলিয়ে গড়ে তুলত এক পূর্ণ অনুভূতির জগৎ।
আর সেই দেশান্তরী চিঠি—সহজ সরল, তিন স্তরে ভাঁজ করা পাতলা কাগজ। শুধু বার্তা নয়, তাতে লেখা থাকত শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের খোঁজখবর, মায়ের দোয়া, বাবার উপদেশ, ভাইয়ের ভালোবাসা, বোনের আবদার। খুললেই যেন আবেগের এক নতুন জগৎ মেলে ধরত।
কী চমৎকার ছিল সেই সময়! ডাকের অপেক্ষায় গ্রামের মোড়ে বসে থাকত প্রবীণরা, গলিতে খেলায় মগ্ন থাকত শিশুরা, মাটির আঙিনায় বসে থাকত মায়েরা—সবার চোখ আটকে থাকত সেই খাকি পোশাক পরা ডাকপিয়নের দিকে। তার সাইকেলের ঘণ্টা বাজলে হৃদয় দুলে উঠত। আর যখন সে ডেকে উঠত: “চিঠি এসেছে…” তখন চোখে ভরে যেত আলো, ঠোঁটে ভেসে উঠত দোয়া, আর হৃদয়ে জ্বলে উঠত কৃতজ্ঞতার প্রদীপ।
ও ছিল অন্য রকম সময়। দূরত্ব ছিল, কিন্তু হৃদয়গুলো ছিল কাছাকাছি। আজ দূরত্ব যেন নেই—মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ভিডিও কল শারীরিক ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে; অথচ মনগুলোর নৈকট্য হারিয়ে গেছে।
হায়! আজ আর আসে না সেই প্রবাসফেরত, আসে না কোনো চিঠি, জাগে না সেই স্মৃতি। সবকিছু তীব্রগতির জীবনের ঘূর্ণাবর্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পোস্ট অফিস আজ নির্জন, ডাকবাক্স মরিচায় ভরা, আর যে প্রজন্ম চিঠির সঙ্গে নিঃশ্বাস নিত, তারা বিদায় নিচ্ছে।
হৃদয়বিদারক সত্য হলো—আমাদের যুগে শুধু শব্দই পাল্টায়নি, ভালোবাসার ভাষাও ফিকে হয়ে গেছে। মানুষ আজ যন্ত্রে পরিণত, সম্পর্কগুলো ডিজিটালে বন্দি, আবেগগুলো ফাইলের ভেতর সঙ্কুচিত, আর অনুভূতিগুলো স্রেফ ইমোজি হয়ে গেছে।