শিরোনাম : মুমিন হত্যা—এক ভয়াবহ অপরাধ।
————–
|| প্রশ্ন :
সম্মানিত ও মহাশ্রদ্ধেয় জনাব মাওলানা ড. আকরাম নাদভী সাহেব,
আসসালামু আলাইকুম ও রহমতুল্লাহি ও বারাকাতুহু।
আশা করি সুস্থ আছেন। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চাই।
কোনো মুসলিম যদি ইচ্ছাকৃতভাবে আরেক মুসলিমকে হত্যা করে, সে সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—
“আর যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম—সে সেখানে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার উপর রাগ করবেন, তাকে অভিশাপ দেবেন এবং তার জন্য প্রস্তুত করবেন মহা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
(সূরা নিসা: ৯৩)
তবে এ শাস্তি থেকে ব্যতিক্রম হবে সে ব্যক্তি, যে আন্তরিকভাবে তওবা করবে—
“তবে তারা ছাড়া, যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে। আল্লাহ তাদের মন্দ কাজগুলোকে সৎকাজে পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।”
(সূরা ফুরকান: ৭০)
এ বিষয়ে সবার ঐকমত্য হলো—যে ব্যক্তি হত্যার পর তওবার শর্ত পূর্ণ করে আন্তরিক তওবা করে, সে জান্নাতে যাবে। অর্থাৎ সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না।
কিন্তু মতভেদ হয়েছে এই জায়গায় যে—যদি কেউ কোনো মুসলিমকে হত্যা করে এবং তওবা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে, তবে কি তার ক্ষমা হবে? সে কি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, নাকি ঈমান তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে?
আশআরী ও মাতুরিদী আলেমদের মতে—
যদি কেউ তওবা ছাড়াই মারা যায়, তবুও তার ঈমানের কারণে জান্নাতে প্রবেশের সম্ভাবনা আছে। তাদের ব্যাখ্যায় “চিরকাল” (خلود) বলতে দীর্ঘ সময় বোঝানো হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে তারা এ আয়াত উদ্ধৃত করেন—
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরককে ক্ষমা করবেন না; এর বাইরে যা কিছু আছে, যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করল, সে তো ভয়াবহ পাপের মিথ্যা আরোপ করল।”
(সূরা নিসা: ৪৮)
কিন্তু এই ব্যাখ্যা আয়াতের সরল অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না। বরং অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয় এই ব্যাখ্যা—কুরআনে যেখানে কুফর ও শিরকের সাথে চিরস্থায়ী জাহান্নামের কথা এসেছে, তা আসলে এই ইঙ্গিত বহন করে যে কিছু কিছু বড় গোনাহ ঈমানকে নষ্ট করে দেয়। তাই যদি হত্যাকারী তওবা ছাড়া মারা যায়, তবে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। কেননা জান্নাতে প্রবেশের শর্ত হলো ঈমান, আর মুসলিম হত্যা বা অনুরূপ অপরাধ তখনই সংঘটিত হয়, যখন অন্তর থেকে ঈমান বিলীন হয়ে যায়। এজন্যই এসব গোনাহর ব্যাপারে কুরআনে “চিরস্থায়ী জাহান্নাম”-এর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
এই হাদিসও তা সমর্থন করে—
“মুসলিমকে গালি দেওয়া ফিসক (অপকর্ম), আর তাকে হত্যা করা কুফর।”
(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
—মুহাম্মদ আদিল মু’আয নাদভী
উত্তর
আপনার উত্থাপিত প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সূক্ষ্ম। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বহু আলেম এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। কিন্তু সঠিক উপলব্ধির পথে দুটি বড় বাধা রয়েছে, যা দুর্ভাগ্যবশত উম্মতের জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে—
প্রথমত : কুরআন ও সুন্নাহকে সেই সব মতবাদী ঘরানার ব্যাখ্যা অনুযায়ী বোঝা, যেগুলো নবীজির যুগ ও সাহাবাদের যুগের পর শত শত বছর পরে সৃষ্টি হয়েছে, এবং তারপর সেই ব্যাখ্যাগুলোই আসল নসের উপর কর্তৃত্বশীল করে দেওয়া।”
দ্বিতীয়ত: কুরআন ও সুন্নাহর গভীর বার্তাকে কেবল ফতোয়ার ভাষায় সীমাবদ্ধ করা—যেন এগুলো শুধু আইনি বিধান, যা ক্বাযি বা মুফতির দৃষ্টিতে বোঝার এবং প্রয়োগের বিষয়।
কুরআনের এ কঠোর সতর্কবাণী—
“আর যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম—সে সেখানে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার উপর রাগ করবেন, তাকে অভিশাপ দেবেন এবং তার জন্য প্রস্তুত করবেন মহা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
এটি কোনো ফতোয়ার আইনি ভাষা নয়। বরং আল্লাহ এ শৈলী ব্যবহার করেছেন, যাতে মুমিনের প্রাণের মর্যাদা মানুষের অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেন কোনো মুসলিম এ ব্যাপারে সামান্যতম অসতর্কতাও না করে।
অতএব, “কে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে আর কে ক্ষমা পাবে”—এটা আমাদের এখতিয়ারের বিষয় নয়। কুরআনের উদ্দেশ্য হলো অপরাধের ভয়াবহতা ও তার গুরুতর পরিণতি স্পষ্ট করা। কিন্তু কিয়ামতের দিন কে ক্ষমা পাবে আর কে পাবে না, তা আল্লাহর জ্ঞান, বিচার ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আমাদের কাজ নয় আমাদের ফিকহি বা কালামি মতবাদের ভিত্তিতে কাউকে জান্নাত বা জাহান্নামের চূড়ান্ত ফয়সালা দিয়ে দেওয়া।
তওবার প্রসঙ্গে কুরআন স্পষ্ট করে বলেছে—
“তবে তারা ছাড়া, যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে—আল্লাহ তাদের মন্দ কাজগুলোকে সৎকাজে পরিবর্তন করে দেবেন।”
অতএব, হত্যাকারী যদি আন্তরিকভাবে তওবা করে, ঈমানের ওপর অটল থাকে এবং সৎকাজ করে, তবে আল্লাহ তার গোনাহকে নেকিতে রূপান্তর করতে পারেন।
কিন্তু যদি কেউ তওবা ছাড়াই মারা যায়, তবে তার পরিণতি কী হবে—আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। সে যে অবশ্যই ক্ষমা পাবে, তা-ও নয়; আবার যে অবশ্যই চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, তাও নয়। এ ফয়সালা একমাত্র আল্লাহর হাতে।
মূল শিক্ষা