শিরোনাম : প্রতিদানে হালুয়া বিলানো।
——————–
আজ বৃহস্পতিবার, ২৬ সফর ১৪৪৬ হিজরি। স্বাভাবিক নিয়মে নাশতার জন্য হোটেলের রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। চারপাশে চাঞ্চল্য আর কোলাহল জমে উঠেছিল। হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের প্রিয় ছাত্র এবং সম্মানিত বন্ধু মুহাম্মদ আলী রাসূল সাহেবের দিকে। তিনি এক কোণে একা বসে কফি পান করছিলেন। কিন্তু তাঁর একাকিত্ব কেবল নিঃসঙ্গতা ছিল না; বরং মনে হচ্ছিল তিনি এমন এক প্রশান্তি ও চিন্তায় ডুবে আছেন, যা হৃদয়বানদের স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য। আমি-ও নাশতা হাতে নিয়ে তাঁর সামনে গিয়ে বসলাম। এভাবেই আমাদের আলাপের শুরু হলো।
শুরুতেই তিনি আমার শিক্ষাদানের পদ্ধতির প্রসঙ্গ তুললেন এবং আন্তরিকভাবে বললেন, ছাত্ররা সত্যিই এর থেকে উপকৃত হচ্ছে। এটি শুনে মনে স্বস্তি এলো। তবে আড্ডা বা আলোচনার ধারা এক জায়গায় থেমে থাকে না। কথার মোড় ঘুরে গেল রবিউল আউয়াল মাস এবং মাওলিদ মাহফিলের দিকে।
রাসূল সাহেব বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বললেন: “এখন এক মাস আমাদের দেশে হট্টগোল চলবে। এই হট্টগোল মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যেখানে সত্য-মিথ্যার কোনো পার্থক্য টিকে থাকে না।”
আমি জবাবে বললাম: “সত্যিই তাই। যদি কেবল তাঁরাই মাওলিদ পালন করতেন যারা এর পক্ষপাতী, তাহলে হয়তো গোলমাল কম হতো। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে—কিছু মানুষ এই সময়ে সিরাত কনফারেন্স বা প্রশিক্ষণমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করে, আর বাকিরা তাদের সমস্ত শক্তি খরচ করে এর খণ্ডন ও বিরোধিতায়। ফলে গোটা সমাজ কোনো না কোনোভাবে এ মাসকে পালন করে। তখন উদ্দেশ্য থাকে না আল্লাহর ইবাদত বা দ্বীনের আমল; বরং সবাই চায় প্রমাণ করতে যে আমার মতই সঠিক, আমারই মত শ্রেষ্ঠ। এই মনোভাবই আসল কার্যক্রমের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।”
এ কথা শুনে রাসূল সাহেব নিজের জীবনের একটি উদাহরণ দিলেন। তাঁর কথা ছিল সহজ, কিন্তু ভেতরে লুকানো ছিল গভীর তাৎপর্য। তিনি বললেন:
“আমাদের পরিবার আধুনিক ধাঁচের জীবনযাপন করত। আমার বাবা-মা দুজনেই চাকুরিজীবী ছিলেন। রবিউল আউয়ালে আশপাশের লোকেরা মাওলিদের উপলক্ষে ঘরে ঘরে হালুয়া পাঠাত। আমাদের ঘরেও হালুয়া আসত। মা বলতেন, আমরা না দেওবন্দী, না বেরলভী। এসব নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাঁর মনে খচখচ করত যে আমরা তো অন্যদের হালুয়া খেয়ে নিচ্ছি, অথচ নিজেরা কাউকে কিছু দিচ্ছি না। কিন্তু সারা দিনের চাকরি ও গৃহকর্মের কারণে মা নিজে হালুয়া বানাতে পারতেন না। তাই বাবা বাজার থেকে হালুয়া কিনে আনতেন এবং আমাদের সন্তানদের বলতেন—যাও, পাড়ায় বিলিয়ে এসো। এভাবে আমাদের হালুয়া আসলে কেবল প্রতিদান বা বদলে দেওয়া হতো, এর সঙ্গে মাওলিদের আসল অনুষ্ঠানের কোনো যোগ ছিল না।”
এবার আমি-ও একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি শোনালাম। আমাদের গ্রামে শবে বরাতে খানা রান্না করে বিতরণের রেওয়াজ ছিল। কিছু পরিবার নিজেদের আগ্রহ বা সামাজিক রীতি মেনে এটি করত। আমার পরিবারও ভেবেছিল, কেবল অন্যের রান্না খেয়ে যাওয়া, অথচ নিজেরা কিছু না দেওয়া, এটি ভদ্রতার বিরুদ্ধে। তাই তারাও খানা রান্না করত ও বিলিয়ে দিত। এ কাজের সঙ্গে ইবাদত বা দ্বীনের সম্পর্ক কম, বরং সামাজিক ভদ্রতার প্রতি আনুগত্যই ছিল বেশি।
এই দুটি ঘটনা বাহ্যত ছোট হলেও আসলে আমাদের সমাজের এক বড় সত্যকে উন্মোচন করে। আর সেই সত্য হলো—ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অনুশীলনগুলো প্রায়শই দ্বীনের প্রকৃত চেতনার চেয়ে সামাজিক রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতার প্রতিফলন বেশি হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের কাজের মূল প্রেরণা অধিকাংশ সময় হয় না দ্বীনকে জীবিত রাখা, নবীর সুন্নাহকে ছড়িয়ে দেওয়া বা ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়া। বরং লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সমাজে ইজ্জত বজায় রাখা, অন্যদের থেকে পিছিয়ে না পড়া এবং নিজের মত বা মসলককে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা।
এই কারণেই রবিউল আউয়ালের মাহফিল হোক কিংবা শবে বরাতের ভোজ—এসবের ভেতর দ্বীনের চেয়ে প্রতিযোগিতা, মতবাদী গর্ব আর সামাজিক প্রদর্শনীর রং-ই বেশি দেখা যায়।
এই বিষয়টি উপেক্ষা করা উচিত নয়। ইসলামের আসল চেতনা হলো—ইবাদত ও নেক আমলের ভিত্তি নেক নিয়ত। যদি নিয়ত খাঁটি হয়, তবে ছোট কাজও মহান হয়ে যায়। আর যদি নিয়ত হয় কেবল রেওয়াজ বা দেখানো, তবে বড় থেকে বড় কাজও নিছক আচারেই সীমাবদ্ধ থাকে।
এই আলোচনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় কার্যক্রমগুলো নতুন করে ভাবার প্রয়োজন আছে। আমরা কি এগুলো করি আল্লাহর স্মৃতি সতেজ রাখতে, সুন্নাহকে জীবিত করতে? নাকি কেবল সমাজের চাপ, প্রথা আর মতবাদী অহমিকার কারণে?
এ প্রশ্ন প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে জেগে ওঠা উচিত। কারণ নিয়ত যদি খাঁটি না হয়, তবে কাজ দ্বীনের পরিবর্তে রেওয়াজে পরিণত হয়। আর এ-ই সেই বিপদ, যা আমাদের উম্মাহকে ক্ষুদ্র মতভেদের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে রেখেছে।
——————–
ক্যাটাগরি : সমালোচনামূলক আলোচনা, আত্মশুদ্ধি।
—
✍️ মূল রচনা: ড. মুহাম্মদ আকরাম নাদভী, অক্সফোর্ড
✍️ অনুবাদ, যাচাই ও সম্পাদনা: মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ
—-
🔗 অনূদিত মূল প্রবন্ধের লিংক: 👇
https://t.me/DrAkramNadwi/6794