শিরোনাম : নীরবতার দিগন্ত : হিথ্রো থেকে শিকাগোর যাত্রা।
——————–
আঠাশে আগস্ট, দুই হাজার পঁচিশের সকাল। আমি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে আছি। মনে হচ্ছে যেন সময় এখানে থেমে গিয়ে আমার শ্বাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করেছে। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে সূর্যের কোমল রশ্মি ভেতরে আসছে, সেই আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে হৃদয়ের গভীরতম কোণ। চারপাশে তাকালে মনে হয়, প্রতিটি যাত্রী আলাদা এক গল্প বয়ে এনেছে। নীরবতাও কথা বলছে—এমন এক সুরে, যা কেবল অন্তরের কানেই ধরা দেয়।
লাউঞ্জের ভেতর আলো-আঁধারির মৃদু আবহ। নীরবতার মাঝে ছড়িয়ে আছে ক্ষীণ শব্দের গুঞ্জন: কারও জুতার টোকা, কারও পোশাকের হালকা খসখস, আর প্রতিটি ঘোষণার শীতল ধ্বনি। সব মিলেমিশে যেন এক নরম সুর তৈরি করছে, যা হৃদয়ের তারে আঘাত হানছে। এক মা বুকে শিশুকে আঁকড়ে রেখেছেন, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মাতৃস্নেহের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে। এক তরুণ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অস্থিরভাবে এদিক-সেদিক হাঁটছে। কেউ আবার ফোনের আলোয় ডুবে আছে নিজের জগতে। এ সব দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়—প্রত্যেক মানুষ নিজের ভুবনে মগ্ন, আর প্রতিটি হৃদয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকে এক অদেখা জগৎ, যা হয়তো কখনো প্রকাশ পায় না।
বাইরে রানওয়ে জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ইস্পাতের ডানা মেলে রাখা বিমানগুলো। যেন আকাশের পাখি, উড়াল দেওয়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে প্রতীক্ষা করছে। আর আকাশ—সে লন্ডনের আকাশ। ধূসর, গম্ভীর, মেঘে মোড়া, ক্লান্ত অথচ প্রস্তুত। ভাবি, একবার বিমান মাটি ছাড়লেই সবকিছু বদলে যাবে: শহরের আলো, পথঘাট, মানুষ—সব ধোঁয়াটে কুয়াশায় মিলিয়ে যাবে। কিন্তু অন্তরের যাত্রা, ভাবনা, স্বপ্ন আর আশা রয়ে যাবে অটল। হয়তো সেটিই আসল ভ্রমণ।
কফির তীব্র গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। চকচকে মেঝে আলো প্রতিফলিত করে যেন জলের ঢেউ তৈরি করছে। অনুভব করি, এ মুহূর্ত কেবল অপেক্ষার নয়—এ মুহূর্ত আমাকে মিলিয়ে দিচ্ছে আমার ভেতরের দিগন্তের সাথে। শুনি নিজের হৃদস্পন্দন, উপলব্ধি করি প্রতিটি ক্ষণ: বিমানের ডানার কাঁপন, মেঘের ফিসফিস, বাতাসের মৃদু নড়াচড়া আর অন্তরের গভীরতা। প্রতিটি জিনিস একেকটি প্রতীক, প্রতিটি মুহূর্ত একেকটি বার্তা, আর প্রতিটি যাত্রা যেন এক অন্তর্দৃষ্টি।
ফোনে স্ত্রীর সাথে কথা হলো—নানা বিষয় আর ভবিষ্যতের ভ্রমণ নিয়ে। এরপর মারয়াম কাতার থেকে ফোন করল। শুধু সালাম-দোয়াই নয়, নিজের লেখা নিয়ে পরামর্শও নিল। আলাপচারিতায় একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, অন্যদিকে ছিল আন্তরিকতা ও স্নেহের উষ্ণ বন্ধন। সেই মেলবন্ধন চিন্তা ও ভালোবাসার সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করল।
এদিকে مجلسِ فكرِ اسلامي (মাজলিসে ফিকরে ইসলামি) গ্রুপ বেশ সরগরম। মাহমুদ ভাই আমার সফরের খবর দিলেন। আর সালমান ভাই ব্যস্ত আছেন মানুষকে মুকাল্লিদ আর দেওবন্দি বানানোর মহৎ কাজে। সাধারণত তিনি আগেভাগেই জয় ঘোষণা করে বসেন, কিন্তু আজ ভাগ্যে পরাজয় জুটেছে। তার দায় চাপালেন স্ত্রীকে, যে নাকি নাশতার ব্যবস্থা করেননি। বন্ধুমহলে এটি নতুন কিছু নয়, সবাই জানে সালমান ভাইয়ের জয় কিসের বরকতে আসে।
চিন্তা করি, জীবনের আসল রূপ দুটি। একদিকে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় গড়া সাধারণ দিক। অন্যদিকে রয়েছে আধ্যাত্মিক, সৃজনশীল আর দার্শনিক দিক। কেবল তত্ত্ব বা যৌক্তিক সংজ্ঞা মানুষকে পুরোপুরি বোঝাতে পারে না; প্রকৃত উপলব্ধি আসে অভিজ্ঞতা আর প্রত্যক্ষতায়। আজ অন্তরের ভ্রমণে আমি সেটাই অনুভব করছি। এই সময়, এই প্রতীক্ষা, এই নীরবতা—সবই আমাকে শিখাচ্ছে, জীবন কেবল বাইরের নয়, ভেতরেরও।
দেখি, মানুষ তিনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করতে পারে—
১. সামাজিক মানুষ: যে সমাজ ও পরিবেশের সাথে যুক্ত, যার চিন্তা-ভাবনা চারপাশের রীতি ও নিয়মে বাঁধা।
২. অভ্যাসের মানুষ: যে বাঁচে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আর আনন্দের খোঁজে, নিজের ইচ্ছা আর অভিজ্ঞতার তাড়নায়।
৩. অপূর্ণ মানুষ: যে ভেতরের সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার চেষ্টা চালায়, দুর্বলতা আর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সৃজনশীল শক্তি দিয়ে নিজেকে নির্মাণ করে।
আমি নিজের সাথে সবচেয়ে কাছাকাছি পাই এই অপূর্ণ মানুষকেই। কারণ সে-ই দুর্বলতা ও কঠিনতার মাঝেও নিজেকে চিনতে শেখে, নিজেকে গড়ে তোলে। সেই নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যেই জীবনের মর্যাদা, সৌন্দর্য আর তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে।
বিমানের উড্ডয়নের প্রস্তুতি এক প্রকার সুফিয়ানা দৃশ্য তৈরি করে। ডানার কাঁপন, ধাতব শরীরের কম্পন, যাত্রীদের উদ্বেগ আর আশার মিশ্রণ—সব মিলিয়ে হৃদয়ের তারে সুর তোলে। কল্পনা করি, বিমান যখন মেঘের আচ্ছাদন ভেদ করবে, আলো-ঝলমলে রেশমি সুতোয় জড়িয়ে পড়বে, তখন আমার ভেতরের প্রশ্ন, স্বপ্ন, ভয় আর আশা—সব উড়ে যাবে নতুন দিগন্তের পথে।
নীরবতার উড্ডয়ন:
আমি দেখি, প্রতিটি যাত্রায় মানুষ তার স্বপ্ন, ভয় আর আশাকে সাথে করে নেয়। হয়তো এ সেই মুহূর্ত, যখন প্রতিটি হৃদয় নিজের ভেতরের প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়, আর প্রতিটি আত্মা নিজের গভীরতাকে ছুঁয়ে ফেলে। আমিও সেই সুরে মিশে যাই—নিজের অন্তর্লোকের সাথে।