শিরোনাম : কেন মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হলো?
——————–
بسم الله الرحمن الرحيم.
|| প্রশ্ন:
আমার ছাত্র আবু হানিফা দিলাওয়ার আমাকে একটি প্রশ্ন পাঠিয়েছে—
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, উস্তাজ।
আশা করি আপনি সুস্বাস্থ্য ও ঈমানের সর্বোত্তম অবস্থায় আছেন। আল্লাহ আপনাকে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি ও কল্যাণ দান করুন।
মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে কেন সৃষ্টি করেছেন—এর রহস্য বা প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন: “আল্লাহুস সামাদ”—অর্থাৎ, তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন, কোনো প্রয়োজন বা অভাব থেকে মুক্ত।
কুরআনে মানবসৃষ্টির নানা উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে: আল্লাহর ইবাদত করা, পরীক্ষা দেওয়া, তাঁর প্রতিনিধি (খলিফা) হওয়া, পৃথিবীতে তাঁর আইন প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। অথচ অন্যদিকে, মানুষ জান্নাতে যাক বা জাহান্নামে যাক, তাতে আল্লাহর কিছুই বাড়ে বা কমে না। তিনি তো একেবারেই অমুখাপেক্ষী। তাহলে মানুষকে কেন পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে? আর কেন এত ভয়াবহ ও কঠিন কিছু, যেমন জাহান্নাম, সৃষ্টি করা হয়েছে?
(আমি জান্নাতের প্রসঙ্গ তুলছি না, কারণ তা তো নিঃসন্দেহে এক অনুপম অনুগ্রহ ও স্বস্তি।)
প্রায় বারো বছর ধরে আমি এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর খুঁজছি।
|| উত্তর :
ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
আল্লাহ আপনার আন্তরিক অনুসন্ধানের জন্য আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে সত্যের সন্ধানে ধৈর্য ধরার জন্য আপনাকে পুরস্কৃত করুন।
আপনার উত্থাপিত প্রশ্ন আসলে তাওহিদ ও ঈমানের সবচেয়ে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন: যখন আল্লাহ সর্বতোভাবে অমুখাপেক্ষী—আল্লাহুস সামাদ, সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিজে পূর্ণ এবং কারও প্রয়োজন নেই—তখন মানবজাতিকে কেন সৃষ্টি করা হলো? কেন পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে? আর কেন এত ভয়াবহ বাস্তবতা, যেমন জাহান্নাম, সৃষ্টি হলো?
এর উত্তর শুরু করতে হবে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি থেকে। আল্লাহর প্রতিটি গুণ পূর্ণাঙ্গ, চিরন্তন, আদি-অন্তহীন। সৃষ্টির অস্তিত্ব তাঁর মহিমা, গৌরব ও পূর্ণতায় কোনো বৃদ্ধি আনে না; আবার সৃষ্টির অনুপস্থিতি তাতে এক বিন্দুও ঘাটতি সৃষ্টি করে না। তিনি স্রষ্টা, সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টির বাইরে ও ভিন্ন। তাঁর সঙ্গে কোনো তুলনা বা একাত্মতার দাবি করা কুফরি। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন, বরং সবকিছু তাঁর উপর নির্ভরশীল। কেউ তাঁকে উপকৃত করতে পারে না, কেউ তাঁকে ক্ষতি করতে পারে না; এসব ভাবনা তাঁর সত্তার ঊর্ধ্বে।
তাঁর অন্যতম প্রকাশ্য গুণ হলো, তিনি আর-রহমান, আর-রহীম—অতীব দয়ালু ও পরম দয়ালু। সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দয়ার সম্পর্ক। আর সত্যিকারের দয়া মানে হলো ভালোবাসা ও উপকার। এই দয়ারই ফল হলো সব কিছুর অস্তিত্ব লাভ করা, আর এই দয়ার কারণেই তারা টিকে থাকে এবং কল্যাণে বৃদ্ধি পায়।
কুরআন নানা রূপে বারবার এই সত্য স্মরণ করিয়ে দেয়: প্রতিটি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতগুলো (আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন, আর-রাহমানির রাহীম), আর সবচেয়ে মোহনীয়ভাবে সূরা আর-রাহমান, যেখানে আল্লাহর অনুগ্রহগুলো মস্তিষ্ক ও হৃদয় উভয়কেই ছুঁয়ে যায়।
ফেরেশতা, জিন ও মানুষ—সবাই এই দয়ার প্রকাশ। তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তারা আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহের প্রাপক হয় এবং তাঁর অনুগ্রহে ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। আর এই বৃদ্ধি ও উন্নতির জন্যই তাদেরকে পরীক্ষা নির্ধারিত করা হয়েছে।
এই পরীক্ষা আল্লাহর কোনো প্রয়োজন মেটানোর জন্য নয়, তাঁর সত্তার কোনো ঘাটতি পূরণের জন্যও নয়; বরং এটি মানুষের কল্যাণের জন্য—যাতে তারা তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার করে উত্তমের দিকে অগ্রসর হতে পারে। যত তারা নেক আমলে অগ্রসর হবে, তত তারা আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য হবে। আর তারা যত উন্নত হবে, তাদের ভেতরে আল্লাহর দয়া গ্রহণ করার ক্ষমতাও তত বৃদ্ধি পাবে।
মানুষকে এই পরীক্ষার উপযোগী করতে আল্লাহ তাদের স্বভাবের ভেতরে একটি সুস্থ-সঠিক প্রবৃত্তি (ফিতরাহ) রেখেছেন এবং দিয়েছেন বুদ্ধি (আকল)। কিন্তু অতিরিক্ত দয়ার কারণে আল্লাহ মানুষকে শুধু এ দুটির উপর ছেড়ে দেননি, কারণ প্রবৃত্তি ও বুদ্ধি দুটোই বিভ্রান্ত হতে পারে, আচ্ছন্ন হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি হুকুম-নিষেধ নাজিল করেছেন, নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন, কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন এবং সুসংবাদ ও সতর্কবার্তার একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। সবকিছুই তাঁর পক্ষ থেকে এক মহা অনুগ্রহ, যেমন কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে—
“আজ আমি তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম” (আল-মায়িদাহ: ৩)।
সৃষ্টির বৈচিত্র্যও তাঁর মহা নিদর্শনগুলির একটি। অসংখ্য প্রকারের জীব ও রূপের অস্তিত্বের মাধ্যমে তিনি তাঁর সৃষ্টি-জগৎকে, তাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে, তাঁর ক্ষমতা ও জ্ঞানের অসীমতা অনুভব করান। এই বৈচিত্র্য ফেরেশতা, জিন ও মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত।