AkramNadwi

একটি চিঠি: নদওয়ায় আমার ছাত্রজীবনের কথা

শিরোনাম : একটি চিঠি: নদওয়ায় আমার ছাত্রজীবনের কথা।
——————–

প্রিয় ভাই,
তুমি একেবারে সরলভাবে একটি প্রশ্ন করেছো, কিন্তু সেই প্রশ্ন আমার হৃদয়ের গভীর দরজাগুলো এমনভাবে খুলেএখানে একবার প্রেস করলে সেটি ইনপুট বক্সে পেস্ট হবে দিয়েছে, যেন শুকনো পাতার গাছে হঠাৎ করে বসন্ত এসে যায়। তুমি জানতে চেয়েছো—আমার ছাত্রজীবনের দিনগুলো কেমন ছিল? সত্যিই কি আমরা ঘুম, ক্ষুধা কিংবা আরামের তোয়াক্কা না করে দিনরাত শুধু জ্ঞানের ছাঁচে নিজেকে গড়তে ব্যস্ত থাকতাম?

প্রশ্নটা তুমি এমনভাবে জিজ্ঞেস করেছো, যেন সেটি কেবল একটি সাধারণ ঘটনা, কিন্তু আমার কাছে এই প্রশ্ন যেন আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা একটি ধ্বনি, এমন এক ক্ষত, যা সময় পার হয়ে গেলেও আজও অক্ষত, এখনও কাঁচা।

গত কয়েক দিন ধরে আমি যেন এই প্রশ্নের ভারে চুপসে গিয়েছিলাম। একাকিত্বের গন্ধভরা রাতগুলো আমার মন-দরজায় টোকা দিতে থাকল, আর নীরবতা যেন ভেতরে এক হারিয়ে যাওয়া সুরের মতো বেজে চলল। অবশেষে, যখন চিন্তার আলো স্মৃতির ছাই উলটে দেখা শুরু করল, তখন এক চেনা গন্ধ ভেসে উঠল, সেই গন্ধ, যা কেবল নদওয়ার দেয়ালগুলোতে ছড়িয়ে থাকা আন্তরিকতা, সাধনা, ভালোবাসা আর জ্ঞানের বোধ থেকেই জন্ম নেয়।

আহ! সেই সময়, সেই পবিত্র সময়, যখন আমি লাক্ষ্ণৌয়ের নদওয়াতুল উলামার মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে শুধু জ্ঞান অর্জন করছিলাম না, বরং নিজের সত্তার পুনর্গঠনেও ব্যস্ত ছিলাম। যেন নিজের আত্মাকে শব্দে শব্দে, আয়াতে আয়াতে গড়ে তুলছিলাম। সেখানে প্রতিটি বই, প্রতিটি শিক্ষক, প্রতিটি আলোচনা ছিল একেকটি আয়না, যার মাধ্যমে আমি নিজের অন্তরের মুখ চিনে নিতে চাইতাম।

আমার সেই শিক্ষা সফর ছিল না শুধুই ডিগ্রি বা সনদ অর্জনের সিঁড়ি। বরং সেটা ছিল এক আত্মিক সাধনা, এক আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের অভিযাত্রা, এমন এক পথ, যা হৃদয়ের আগুনে পোড়া ছাড়া সম্ভব ছিল না।

সেই দিনগুলোতে না ছিল ঘুমের স্বাদ, না খাওয়ার হুশ বা দেহ-মনের কোনো আরাম, আর না পোশাকের রুচিশীলতার প্রতি কোনো আগ্রহ। সময় যেন ছিল এক জ্বলন্ত বালুর মরুভূমির মতো, আর আমরা তাতে ন্যাংটো পায়ে দৌড়াতাম—শুধু এই আশায়, যদি কোনো মুক্তা, কোনো রত্ন, কোনো গোপন রহস্য আমাদের হাতে আসে। আমি তোমাকে কীভাবে বুঝাই—নদওয়ার সেই নিঃসাড় অথচ নূরভরা করিডোরগুলো, সেই নীরব জানালাগুলো, সেই আলো জ্বলা ঘরগুলো—সবই আমার আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

আমার ঘরে যে নিচু মঞ্চবিশিষ্ট খাট ছিল, সেটা আমার আরামস্থল ছিল না। বরং সেটা ছিল আমার মিম্বর। সেখানেই আমি শিবলী, হালী, নজীর আহমদ, আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদি, মাহদি আফাদি, সৈয়দ সুলায়মান ও আজাদের গদ্যরহস্য উন্মোচন করতাম, বুঝতাম, আর তাতে নিজেকে ডুবিয়ে দিতাম। আমি মীর ও গালিবের জটিল ইশারাভাষায় গুলিয়ে যেতাম। আর যখন ইকবালের এই বাক্য সামনে আসত:

“وجود زن سے ہے تصویر کائنات میں رنگ”
“নারীর অস্তিত্বেই মহাবিশ্বের রঙ ও রূপ”

তখন আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবতাম—এই রঙ কী? এই অর্থের উৎস কোথায়? আমি নারীর এই সৌন্দর্যকে কেবল ‘নাজুক লিঙ্গ’ বলে মানতে পারতাম না, বরং তাকে মনে করতাম সৃষ্টির শিখর, সৌন্দর্য ও সূক্ষ্মতার প্রতীক।

আরবী সাহিত্য তখন কেবল এক ভাষা ছিল না আমার কাছে। বরং সেটা ছিল নবুয়তের উত্তরাধিকার, আরব সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ, ভাষার সৌন্দর্য এবং গভীর অর্থবোধের এক বিরাট সমুদ্র। যখন আমি ‘আল-মুয়াল্লাকাত’-এর কবিদের পাঠ করতাম, মনে হতো আজও আরবের জ্বলন্ত মরুভূমি তাদের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিতে কম্পিত। হাসান ইবন সাবিত (রা.), জারীর, বুহতুরী, মুতাানাব্বি ও মা’আররির কবিতাগুলো যেন আমার হৃদয়ের স্পন্দনের সাথেই মিশে যেত। তাদের প্রতিটি পঙক্তি যেন আমার অস্তিত্বের তালা খোলার চাবি হয়ে উঠত।

আর সেই পবিত্র মুহূর্তগুলো—যখন শ্রদ্ধেয় মাওলানা শাহবাজ ইসলাহী (রহ.)-এর বক্তব্য শুনতাম, তা যেন অহির কোমলতা নিয়ে নেমে আসত। হৃদয় নেচে উঠত, চোখ ভিজে যেত, আর বুদ্ধি শ্রদ্ধায় সিজদায় পড়ে যেত। মাওলানা রাবিয় হাসানী নদভী ও মাওলানা সাইয়্যেদ ওয়াযেহ রশীদ নদভী—এই দুই জ্ঞানের দানব—যাদের মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে গেঁথে যেত। তখন মনে হতো, এ তো জ্ঞান নয়, এ তো আলো, শিল্প, আর যেন কবিতার মেলা।

রাতের নীরবতা ছিল আমার নিকটতম সঙ্গী। রওয়াকে আতহার-এর ছাদে উঠে আমি তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ভেতরের জটিলতা সেসব উজ্জ্বল বিন্দুগুলোর কাছে ব্যক্ত করতাম। আজও মনে পড়ে, এক রাতে সূরা ইখলাস নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়ে আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।

“قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ”
“বলুন, তিনি আল্লাহ, যিনি একক”

এই বাক্য যেন আমার স্নায়ু ও শিরা-উপশিরায় গেঁথে গেল। আমি অনুভব করলাম—সমস্ত জ্ঞানই আসলে এই তাওহিদের আন্তরিকতার দিকেই নিয়ে যায়।

তখনকার সিজদাগুলো—সেগুলোতে ছিল না কোনো চাওয়া, না ছিল কোনো আশা—ছিল কেবল এক তীব্র পিপাসা, আল্লাহর সান্নিধ্যের পিপাসা। এমন এক আগুন, যা কাউকে তাড়িত করত, কিন্তু কেউ টের পেত না।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *