❝
بسم الله الرحمن الرحيم.
:: লেখক: ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী،
অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।
:: প্রাকৃতিক নিয়মাবলি এমন ভিত্তি যা মহাবিশ্বের সকল বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন মাধ্যাকর্ষণ, তাপ এবং গতি। এগুলি বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং পরিবর্তন হয় না। এই নিয়মাবলি মহাবিশ্বের শৃঙ্খলাকে নিশ্চিত করে, যা ছাড়া জীবন টিকে থাকা এবং ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। তদ্রূপ, নবীদের দ্বারা প্রাপ্ত ধর্মীয় আইনও এক ধরনের স্থায়িত্ব এবং সামঞ্জস্য বহন করে, যা মানুষের আচরণ এবং তাদের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি জীবনযাত্রার গতিপথ পরিচালনায় এই নিয়মগুলির গুরুত্বকে তুলে ধরে।
মানব জাতি তার সীমিত ক্ষমতা ও জ্ঞানের কারণে প্রাকৃতিক নিয়মাবলিকে অতিক্রম করতে অক্ষম। সে যেমন স্থলভূমিতে হাঁটতে পারে, তেমনি সমুদ্রে হাঁটতে পারে না। যেমন স্থলে সাঁতার কাটতে পারে না, তেমনি পানিতে ভালো সাঁতার কাটতে পারে। সে আকাশে উড়তে বা আকাশের উঁচুতে উঠতে পারে না, এবং দেয়াল বা শিলা অতিক্রম করতে অক্ষম। মানুষের শ্রবণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন সে দূরের শব্দ শুনতে অক্ষম বা তার সামনে না থাকা ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।
মানুষ কেন এই সীমাবদ্ধতার ভুক্তভোগী? কারণ এ মহাবিশ্বের সবকিছু আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়মাবলির অধীন। এই নিয়মাবলি পরিবর্তনীয় নয় এবং মানব মস্তিষ্ক এগুলি অতিক্রম বা পরিবর্তন করতে পারে না। প্রকৃতি বা মহাবিশ্বের এই নিয়মাবলিই জীবনের স্থায়িত্ব এবং ভারসাম্য নিশ্চিত করে।
মানুষ যদি এই নিয়মাবলিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে তবে সে নিজের জন্য কেবল ক্ষতি সাধন করবে এবং এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার হবে। কবি আল-আ’শা বলেন:
পাহাড়কে ভাঙ্গতে চেয়ে কেউ গুঁতা দিলে,
পাহাড়ের কিছু যায় আসে না, কিন্তু তার নিজের শিং ভেঙে যায়।”
এবং হুসাইন বিন হুমাইদ বলেন:
“যে পাহাড় ভাঙ্গতে আসে, তার মাথার জন্য দয়া করো, পাহাড়ের জন্য নয়।”
মানুষের উচিত তার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতায় সন্তুষ্ট থাকা এবং নিজের এবং সমাজের উন্নয়নে কাজ করা, যা তার প্রাকৃতিক ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে, এমনকি নিজেকে ধ্বংস করার পরিবর্তে।
মানুষের ক্ষমতার সীমা বুঝে নেওয়া এবং প্রাকৃতিক নিয়মাবলি সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করাই উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার উপায়। প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ও মানিয়ে চলা ছাড়া এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিয়ে লাভ হয় না।
আল্লাহ রসূলদের মাধ্যমে যে ধর্মীয় আইন পাঠিয়েছেন, তা মানব জাতির জন্য মহান দান। এটি এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা যা সমাজে ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে চায়। এই আইনের বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক নিয়মাবলির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ধর্মীয় আইন স্থায়িত্ব ও স্থায়ীত্বের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়মাবলির চেয়েও শক্তিশালী। যেমন প্রকৃতি একটি নিখুঁত শৃঙ্খলার অধীনে চলে, তেমনই শরীয়তের আইনও সঠিকতা ও ভারসাম্যপূর্ণ। এটি সমাজের সর্বোত্তম স্বার্থ এবং ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চায়। পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে আইনগুলো দেওয়া হয়েছে, তা একটি শক্তিশালী ও সংহত সমাজ গঠনে সহায়ক।
ধর্মীয় আইন দৃঢ় ও মজবুত, এটি মানব আবেগ ও সামাজিক পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সমাজের উন্নতি ও জীবনধারার পরিবর্তনের পরও এই আইনগুলো অটুট থাকে, কারণ এগুলি আল্লাহর ওহী এবং তার ইচ্ছার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এজন্যই এই আইনগুলো মানুষের মাঝে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে এবং ন্যায় ও সত্যের ভিত্তি হয়ে থাকে। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আর তুমি আল্লাহর রীতিতে কখনই কোন পরিবর্তন পাবে না।” (সূরা আহযাব, আয়াত ৬২)।
“কিন্তু তুমি আল্লাহর বিধানের কখনও কোনো পরিবর্তন পাবেনা এবং আল্লাহর বিধানের কোনো ব্যতিক্রমও দেখবেনা।” (সূরা ফাতির, আয়াত ৪৩)।
ধর্মীয় আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে নমনীয়তা রয়েছে, যা এটি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে সক্ষম করে, তবে মূল বিষয়ের কোনো ক্ষতি হয় না। এই স্থায়িত্ব এবং নমনীয়তার সমন্বয় ধর্মীয় আইনগুলোকে শক্তিশালী করে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা প্রদান করে। এটি প্রমাণ করেছে যে সমাজ গঠনে এবং ব্যক্তিদেরকে ভালো কাজের দিকে পরিচালিত করতে এটি অত্যন্ত কার্যকর, যা বিশৃঙ্খলাকে প্রতিরোধ করে এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
যেসব সমাজ ধর্মীয় আইন অনুসরণ করেছে, সেখানে অপরাধের হার কম এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক আরও সংহত ও শ্রদ্ধাশীল। এই আইন পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাহায্যকে উৎসাহিত করে এবং একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ সামাজিক পরিবেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ধর্মীয় আইন, যা আল্লাহ তার রাসূলদের ওপর অবতীর্ণ করেছেন, প্রাকৃতিক নিয়মাবলির একটি প্রতিচ্ছবি বলা যেতে পারে। বরং, এটি আরও শক্তিশালী কারণ এটি একটি অটুট ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি প্রদান করে যা ব্যক্তির অধিকার ও সমাজের মঙ্গল নিশ্চিত করে। তাই মানবজাতির উচিত এই আইনের দিকে ফিরে আসা এবং একটি উত্তম সমাজ গঠনে এর নির্দেশনা থেকে উপকৃত হওয়া।