https://t.me/DrAkramNadwi/6178
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
————
(উর্দু থেকে আরবিতে অনুবাদ: সালসাবিল হাজ শরীফ, মা’হাদু সালাম এর ছাত্রী )
আমি বুখারার জামে মসজিদে উচ্চকণ্ঠে ডাক দিলাম: “হাদ্দাছানা” ও “আখবারানা”—এই অপরিচিত আহ্বানে পুরুষ-মহিলা সবাই অবাক হয়ে তাকাল। আমি আরও উচ্চস্বরে বললাম, কিন্তু কোনো প্রজ্ঞাবান বুড়ো কিংবা সচেতন যুবকের কানেও আমার ডাক পৌঁছাল না। আমি পুনরায় চিৎকার করে বলতে থাকলাম: “হাদ্দাছানা আল-হুমাইদী, ক্বালা হাদ্দাছানা সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা”, “হাদ্দাছানা আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসুফ, ক্বালা আখবারানা মালিক”, “হাদ্দাছানা মুহাম্মাদ ইবনু সালাম আল-বায়কান্দি, ক্বালা আখবারানা ওকীউ”।
কিন্তু না, কোনো শ্রোতা ছিল না, কোনো সাড়া ছিল না। শুধুমাত্র আমার নিজের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল।
এ কি সেই বুখারারই জামে মসজিদ নয়, যেখানে এক সময় ইবনে বুখারী যদি বলতেন “হাদ্দাছানা”—তবে হাজার হাজার মানুষ তা মনোযোগ দিয়ে শুনত, হৃদয়ের রক্ত দিয়ে সেই শব্দগুলো লিখে রাখত, ও মনে প্রাণে তা সংরক্ষণ করত?
আমি বুখারা দুর্গের সামনে বসে আশ-শিফা (ইবনে সিনার গ্রন্থ) পড়াতে শুরু করলাম, আল-কানুন (তিব্ব বিষয়ে ইবনে সিনার গ্রন্থ) ব্যাখ্যা করলাম—কিন্তু আমার ব্যাখ্যা সাধারণের কাছে হয়ে উঠল এক দুর্বোধ্য ধাঁধা, আমার কথা যেন দুরূহ রূঢ় কূটকচালে ভরা।
আমি অভিজ্ঞান ও বেদনা নিয়ে প্রেসিডেন্ট আবু আলী’র (ইবনে সিনা) কাছে অভিযোগ করলাম:
“হে তৃতীয় শিক্ষক! হে জ্ঞান ও যুক্তির অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী! হে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের ইমাম! কী হয়েছে তোমার শহরের, যে আজ আর কেউ তোমার বইয়ের পাঠ নেয় না?”
তখন অর্থ ও ব্যাখ্যার গভীর সমুদ্রের এক ডুবুরি আমাকে কানে কানে বললেন:
“হে ফারঙ্গিদের দেশে বাস করা ব্যক্তি! ফিরে যাও তোমার দেশে। তুমি কি জানো না—‘আশ-শিফা’ ও ‘আল-কানুন’ এখন এমন দুই বিধবা রমণী, যাদের আশ্রয় হারিয়েছে ফজলুল হক খাইরাবাদীর পর?”
আমি তখন সমরকন্দের রেগিস্তানে অবস্থিত তিনটি মহামর্যাদাপূর্ণ মাদ্রাসার দিকে রওনা হলাম—ফিকহ ও তার মূলনীতি, দর্শন ও যুক্তি, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে লাগলাম। তখন যেন আলাউদ্দিন আস-সামারকান্দী, আল-কাসানী, এবং মোল্লা আবদুর রহমান জামীর আত্মারা আমার সঙ্গে ফিসফিসিয়ে বলল:
“আমাদের কষ্ট দিও না, আমাদের উপর ক্ষত সৃষ্টি কোরো না। আমরা এখানে এখন শুধু কল্পনার ছায়া মাত্র।”
আমি তখন আমার অভিযোগ নিয়ে হাজির হলাম ইমাম আবু মানসুর আল-মাতুরিদীর কবরের পাশে। আশ্রয় খুঁজতে লাগলাম উলুঘ বেগের মানমন্দিরে। কিন্তু হায়! আমার সুমধুর কণ্ঠস্বর বাতাসে মিলিয়ে গেল।
আমি এসে দাঁড়ালাম খাওয়ারিজমের আকাদেমিয়া আল-মামুন-এর সামনে।
আমি সেখানে আল-খাওয়ারিজমির জন্য অ্যালজেব্রা ও গণিতের নিয়মাবলি ব্যাখ্যা করলাম।
আবু মানসুর আল-ইরাকির গবেষণা, এবং আল-বিরুনির “তাহকীকু মা লিল হিন্দ” বই নিয়ে বক্তৃতা দিলাম।
কিন্তু প্রতিটি পথচারী কটুভাবে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি আশাহত হয়ে ভাবতে লাগলাম—এরা জ্ঞানের এতটাই অপ্রয়োজনীয় মনে করছে?
তখনই সেই প্রতিষ্ঠান আমাকে বলে উঠল:
“হে অতীতের যাত্রী! চোখ খুলো। অতীতের বিভ্রমে বাস কোরো না। তুমি এখন এক ভিন্ন সময়ে আছ।”
খোরাসান ও মাওয়ারাউন্নাহর (নদীর ওপারের দেশগুলো) অঞ্চলে ইসলামী ইতিহাসের এক বিশাল ঐতিহ্য রয়ে গেছে। এ অঞ্চল এমন অসংখ্য জ্ঞানী-গুণীকে ধারণ করেছে, যাদের কবর গুনে শেষ করা যায় না।
এখানে হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, যুক্তি, দর্শন, কালাম, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোল—এত সব বিষয়ে কত মূল্যবান গ্রন্থ লেখা হয়েছে! এখানে বুদ্ধি ও বর্ণনার নানা শাস্ত্রে কত সূক্ষ্ম তত্ত্ব তৈরি হয়েছে!
কিন্তু এ ভূমি, যে ভূমি ইমাম বুখারী, আল-ফারাবী, ইবনু সিনা, আল-খাওয়ারিজমি, ও আল-বিরুনির মতো মনীষীদের জন্ম দিয়েছে—এখন বহু শতাব্দী ধরে বন্ধ্যা।
হায় আফসোস!
তাশখন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, খাওয়ারিজমের মসজিদ ও মাদ্রাসা, বুখারার কালান মসজিদ ও মীর আরব মাদ্রাসা, সমরকন্দের রেগিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, উলুঘ বেগের মানমন্দির—সবই আজ কেবল জাদুঘর!
কি বিরাট ছিল তাদের অতীত গৌরব! আর আজ কী বিষাদময় ও বেদনাদায়ক তাদের গল্প!
জায়গাগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই, কিন্তু সময় পাল্টে গেছে।
এই পরিবর্তন যেন তাদের নিজ ভূমিতে পরবাসী, নিঃসঙ্গ ও অসহায় করে তুলেছে।
আমি নদীর ওপারের শহরগুলোতে হাঁটতে লাগলাম—সমাধান খুঁজতে খুঁজতে। কিন্তু কিছুই পেলাম না।
একসময়, যখন হতাশা আমাকে পেয়ে বসেছে, তখন জনপুরের প্রজ্ঞাবান দার্শনিককে দেখলাম এক সরু গলিপথে হেঁটে যেতে। আমি তার পেছনে ছুটে গিয়ে ডাকলাম:
“হে যুক্তি, ইতিহাস ও সাহিত্যের ইমাম!
হে তিনি, যার কথা সর্বদা মাওয়ারাউন্নাহর দিয়ে শুরু হতো এবং সেখানেই শেষ!
দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার ক্লাসরুমগুলো সাক্ষী তোমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার।
আজ কোথায় সেই নদীর ওপারের ঐতিহ্য? কোথায় সেই গৌরবময় খোরাসান?”
তিনি, সেই গবেষণামগ্ন বিশ্লেষক, আমাকে এক এমন জবাব দিলেন, যা আমাকে শোক ও চেতনার সাগরে ডুবিয়ে দিল:
“হে গ্রাম্য যুবক, হে জনপুরের এক অজানা গলির সন্তান! শুনো এবং ভালো করে ভাবো:
যখন তুমি একটি উটে চড়ো, তুমি চাইলে তাকে বসাতে পারো, থামাতে পারো, যেখানে ইচ্ছা।
সময়ও এক উটের মতো, তুমি তাকে চড়ে যাত্রা করতে পারো।
কিন্তু মনে রেখো, প্রিয় ছাত্র, প্রিয় আবু আল-ইরফানের সঙ্গী:
এই সময়—এই উট—কখনো বসে না, কখনো থামে না।
আমার পক্ষ থেকে তোমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই বার্তা পৌঁছে দিও:
সময় দ্রুতগতির। যদি তোমরা এই গতি সহ্য করতে না পারো, তবে জাদুঘরে স্থান পাবে—সময় ও স্থান—উভয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
এই প্রেরণাময় বার্তা শোনার পর আমি চমকে উঠলাম।
আমি খুঁজতে লাগলাম সেই মানুষটিকে, যার কাছে দর্শন যেন এক দাসী,
যার জিহ্বা সদা ও সর্বদা খোরাসান ও নদীর ওপারের কথা স্মরণে রাখত।
কিন্তু আফসোস! আমি অনেক দেরি করে ফেলেছি।
তিনি আমার চোখের আড়াল হয়ে গেছেন, আর আমি তাঁকে খুঁজে পেলাম না।
——————–
।
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।