AkramNadwi

মানবজাতিকে পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা!

بسم الله الرحمن الرحيم

✍️ লেখক: ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

প্রশ্ন:

লাহোরের সম্মানিত আলেম মাওলানা ফজলুর রহমান মাহমুদ সাহেব (তার মহিমান্বিত ছায়া দীর্ঘায়ু হোক) প্রশ্ন করেছেন:
“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ, সম্মানিত শায়খ! আশা করি ভালো আছেন। আমার একটি প্রশ্ন আছে যে, আল্লাহ তা’আলা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং কারও প্রয়োজন নেই। তাহলে মানবজাতিকে সৃষ্টি করে তাদের পরীক্ষা করার প্রয়োজন কী ছিল? যদি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য ইবাদতই হয়, তাহলে অন্যান্য সৃষ্টিরাও তো ইবাদত করছে? আশা করি আপনি উত্তর প্রদান করবেন।”

উত্তর:

আল্লাহ তা’আলা সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ এবং তাঁর এই পরিপূর্ণতা চিরকাল ছিল এবং চিরকাল থাকবে। তাঁর সত্তা এবং গুণাবলী, উভয়েরই কোনও শুরু বা শেষ নেই। সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর গুণাবলীতে কোনও বৃদ্ধি হয়নি, আর সৃষ্টির অনুপস্থিতিতেও তাঁর সত্তা বা গুণাবলীতে কোনও ক্ষতি হবে না।

তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টির থেকে পৃথক। তাঁর এবং সৃষ্টির মধ্যে কোনও সাদৃশ্য বা সম্পর্ক নেই, এবং তাঁর সাথে কোনও মিলন বা সংযুক্তির দাবি কুফরি। তিনি কারও প্রয়োজন ছাড়াই পূর্ণ এবং সবকিছুই তাঁর প্রয়োজন। তিনি সমস্ত কল্যাণ এবং ক্ষতির সৃষ্টিকর্তা ও মালিক, আর কোনও সৃষ্টি তাঁকে কোনও কল্যাণ বা ক্ষতি করতে পারে না। তাঁর সত্তা এমন সব কল্পনার ঊর্ধ্বে।

তাঁর একটি গুণ হলো “الرحمن ” (অতীব করুণাময়) এবং “الرحيم ” (অত্যন্ত দয়ালু)। সৃষ্টির সাথে তাঁর সম্পর্ক হলো করুণা ও দয়া, যা ভালোবাসা ও উপকারের সমন্বয়ে গঠিত। তিনি সবকিছুই তাঁর এই গুণের প্রকাশ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, যা কোরআনে বারবার বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে, যেমন “بسم الله الرحمن الرحيم” এবং সূরা আল-ফাতিহায়: “الحمد لله رب العلمين. الرحمن الرحيم ,” এবং সূরা আর-রহমান-এ তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ফেরেশতা, জিন এবং মানুষও তাঁর এই দয়ার প্রকাশ, অর্থাৎ, আল্লাহ তা’আলা তাদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তাদের ওপর তাঁর অসীম দয়া বর্ষণ করতে পারেন এবং সেই দয়ার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে দিতে পারেন।

এই দয়ার বৃদ্ধি করার জন্য, তিনি তাদের একটি পরীক্ষা দিয়েছেন, এবং সেই পরীক্ষা হলো তাঁদের প্রদত্ত সক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজেকে আরও ভালো করা। তারা যত ভালো হবে, তারা তত বেশি পুরস্কার এবং অনুগ্রহের উপযুক্ত হবে। তিনি মানুষের স্বভাবের মধ্যে উৎকর্ষ অর্জনের পথ স্থাপন করেছেন এবং সেই স্বভাবের সমর্থনে বিবেক দান করেছেন। যদি এই সৃষ্টি উৎকর্ষ অর্জন করে, তারা আরও বেশি পুরস্কারের যোগ্য হয়, কিন্তু এতে আল্লাহর নিজস্ব কোনও লাভ নেই।

তাঁর করুণা সম্পূর্ণ করতে, তিনি মানুষের স্বভাব এবং বিবেকের সমর্থনের জন্য আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছেন। এই আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা একটি অসাধারণ দয়া, কারণ এগুলো না থাকলে স্বভাব ও বিবেকের পথনির্দেশনা সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেত। কোরআনে “وأتممت عليكم نعمتي” আয়াতে এই বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে।

আল্লাহর সৃষ্টি এতই বৈচিত্র্যময় যে এর প্রকার ও ধরণ অসংখ্য। এই বৈচিত্র্যের মাধ্যমে তিনি তাঁর ক্ষমতা ও জ্ঞানের অসীমতা প্রকাশ করেন। প্রতিটি ভিন্নতা একটি বড় আলামত, যা তাঁর মহানতার প্রমাণ।

এই ভিন্নতা ফেরেশতা, জিন এবং মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্যেও প্রকাশিত হয়েছে। ফেরেশতাদের এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে তারা সবসময় উত্তমের দিকে অগ্রসর হতে পারে, এবং তারা কেবল আজ্ঞাবহ হতে পারে, কখনও অবাধ্য নয়। আল্লাহ তা’আলা তাদের সৃষ্টির সাথে সংযোগকারী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

অন্যদিকে, জিন এবং মানুষের উভয়ের মধ্যেই উত্তম এবং অধম হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। যেহেতু আল্লাহ পরিপূর্ণ দয়াময়, তাই তিনি চান যে জিন এবং মানুষ শুধুই উত্তম হোক এবং তাঁর অনন্ত পুরস্কারের অধিকারী হোক। এই করুণার অধীনে তিনি কিতাব নাজিল করেছেন, নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং সুসংবাদ ও সতর্কীকরণের ব্যবস্থা করেছেন।

মানুষের এই পরীক্ষা মূলত তাদের নিজের উপকারের জন্য। যদি তারা পরীক্ষায় সফল হয়, তবে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং জান্নাতের পুরস্কারের অধিকারী হবে। আর যারা ব্যর্থ হবে, তারা নিজেদের উপর অত্যাচার করবে এবং তার ফলাফল হবে সর্বদয় আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং জাহান্নামের শাস্তি। এই দুই পরিণতির বর্ণনাও তাঁর দয়ার প্রকাশ।

সারসংক্ষেপ:

মানুষের পরীক্ষা মূলত তাদের নিজস্ব উপকারের জন্য, এবং এই পরীক্ষা ব্যবস্থাটি আল্লাহর অসীম দয়ার প্রতিফলন। তিনি ইবাদত ও আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পাপে অসন্তুষ্ট হন, কারণ তিনি তাঁর বান্দাদের পুরস্কৃত করতে ভালোবাসেন এবং তাদের শাস্তি দিতে পছন্দ করেন না।

আল্লাহ আমাদের তাঁর আনুগত্যশীল বান্দা বানান এবং আমাদের জান্নাতে তাঁর সান্নিধ্য দান করুন। আমিন।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *