https://t.me/DrAkramNadwi/5852
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
————-
আমাদের এক পীর আছেন—দস্তগীর ও উজ্জ্বল অন্তরের অধিকারী, শ্রদ্ধার যোগ্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি সর্বদা কথায় ও কাজে এই বাক্যটি বারবার উচ্চারণ করেন: مستند ہے ميرا فرمايا ہوا”
(আমার বলা কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত।)
তিনি যদিও একটি মাদ্রাসা থেকে স্নাতক, তাই তাকে মাওলানা ও আলিম বলা যেতে পারে। বরং, তিনি এক বছরের ইফতা কোর্সও সম্পন্ন করেছেন, ফলে মুফতি নামেও তার পরিচিতি রয়েছে। তবে আমরা তাকে পীর ও মুরশিদ বলেই ডাকি, কারণ দীর্ঘকাল ধরে তাঁর পূর্বপুরুষদেরও এই পেশাই ছিল। অর্থাৎ, সাজাদা-নশিনির দায়িত্ব তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন, এবং এটি তার জন্য যথার্থও বটে।
শৈশব থেকেই কিছু বিষয় তাকে বারবার কণ্ঠস্থ করানো হয়েছে, যা তিনি অপরিবর্তনীয় সত্য বলে মনে করেন। এসব বিষয়ের বিপরীতে যে কোনো যুক্তিসম্মত কথা তিনি নির্বুদ্ধিতা মনে করেন। আর যদি তার শৈশবের বিশ্বাসগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, তবে তিনি কুরআন ও সুন্নাহকেও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে কুণ্ঠিত হন না। এসব দৃঢ় বিশ্বাসের মধ্যে কয়েকটি হলো:
1. পৃথিবী গোলাকার নয়, বরং সমতল।
2. পৃথিবী একটি গরুর শিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যখন গরুটি শিং পরিবর্তন করে, তখন ভূমিকম্প হয়।
3. ভারত হলো আল্লাহর নির্বাচিত ভূমি। যদিও কুরআন হিজাজে অবতীর্ণ হয়েছে, তবে তা মূলত ভারতে পড়া ও বোঝা হয়েছে।
4. ধর্ম ও দুনিয়ার সব বিষয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের বক্তব্যই প্রমাণসিদ্ধ। আসমান ও জমিন এর চেয়ে উত্তম মানুষ দেখেনি।
পীর সাহেবের প্রথম বক্তব্যের সঙ্গে আমরা শতভাগ একমত। তিনি পৃথিবীকে সমতল প্রমাণ করার অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি পেশ করেন—”আল্লাহ আমাদের চোখ দিয়েছেন, তাই আমরা যা দেখি সেটাই সত্য।” চোখে স্পষ্ট দেখা যায় যে, পৃথিবী গোল নয়, এবং তা কখনো গোল হতে পারে না। যদি গোল হতো, তাহলে যারা অন্য দিকে আছে, তারা উল্টো ঝুলে থাকত। প্রতিবছর হজে লাখো মানুষ আসে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ বলেনি যে তার এলাকায় সবকিছু উল্টো হয়ে আছে।
তার দ্বিতীয় বক্তব্যও আমরা বিনা দ্বিধায় মেনে নিই। যখনই তিনি এটি বলেন, মজলিসে কিছু লোক ইশারা-ইঙ্গিত করতে থাকে। কিন্তু আমরা কখনোই এমন ধৃষ্টতা দেখাই না। আমরা ভাবি, যদি বিজ্ঞানীদের ভূমিকম্প সম্পর্কিত ব্যাখ্যা সত্যও হয়, তাতে কী আসে যায়? এখন পর্যন্ত কোনো বিজ্ঞানীই তো ভূমিকম্প থামাতে পারেনি। সুতরাং, পীর সাহেবের কথাই কেন সত্য ধরে নেওয়া হবে না? তাছাড়া, পীর সাহেবের বক্তব্যে গরুর মতো মহিমান্বিত প্রাণীর মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছে, যা বিজ্ঞানীদের তুলনায় অনেক বেশি পবিত্র।
আমরা পীর সাহেবের তৃতীয় বক্তব্য সম্পর্কে মৃদু স্বরে আপত্তি জানিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম:
“হুজুর, যদি এটি মেনে নেওয়া হয়, তবে এতে তো ইমাম আবু হানিফার অসম্মান হয়!”
আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে ইমাম সাহেবের নাম উল্লেখ করেছিলাম, কারণ পীর সাহেব যাই হোন না কেন, তিনি ইমাম আবু হানিফার বিরুদ্ধে একটি শব্দও শুনতে রাজি নন।
আমাদের মনে হয়েছিল, আমরা লাখ টাকার প্রশ্ন করেছি।
কিন্তু পীর তো পীরই হন!
তিনি বললেন:
“তোমরা ইতিহাস ও সীরাতের বই ভালোভাবে পড়োনি। যদি গবেষণা করতে, তবে নিশ্চিত জানতে যে ইমাম সাহেব ছিলেন ভারতীয়, এবং বংশগতভাবে ‘জাট’। ‘জাট’-এর আরবি রূপ হলো ‘যোত’ (زوط), তাই ইমাম সাহেবকে ‘যোতি’ বলা হয়।”
পীর সাহেবের এই অদ্বিতীয় গবেষণায় উপস্থিত শ্রোতারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন এবং চতুর্দিক থেকে প্রশংসার স্লোগান উঠল।
পীর সাহেব গর্বভরে বললেন:
“কুরআনের পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ বই হলো সহিহ বুখারি। সেটিও ভারতে লেখা হয়েছিল!”
সকল শ্রোতা হতবাক!
তাদের বিস্ময় ভেঙে দিয়ে পীর সাহেব বললেন:
“বুখারা আসলে ‘বিহার’-এর আরবি রূপ! বিহার বরাবরই জ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চার কেন্দ্র ছিল। ইমাম বুখারি সেখানকারই বাসিন্দা ছিলেন!”
চতুর্থ বক্তব্য বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছিল।
একদিন, একান্তে আমরা বিনয়ের সঙ্গে বললাম:
“আপনি যাদের ‘আকাবির’ বলেন, তারা তো একেবারে পরবর্তী যুগের ছিলেন। তাদের ‘মুতাখখিরিন’ (পশ্চাদবর্তী) বলা উচিত!”
তিনি বললেন:
“এটি একটি রহস্য, যা তোমাদের মতো বাহ্যবাদীরা কখনোই বুঝতে পারবে না।
যদি আমরা তাদের ‘মুতাখখির’ বলি, তবে আমাদের কথার গুরুত্ব কমে যাবে।
আমরা যে কথাই তাদের নামে প্রচার করি, তা শুধুমাত্র ‘আকাবির’ নামেই প্রসার লাভ করে।
তুমি তো পশ্চিমে থাকো। তুমি কি জানো না, ‘লেবেল’ লাগানোর কী সুবিধা?
একটি লেবেল লাগিয়ে সবচেয়ে নিম্নমানের পণ্যও বাজারে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি করা যায়!
এখন আমরা বুঝতে পারলাম—
আমাদের পীর সাহেব হলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানের সমন্বয়কারী এক মহান ব্যক্তি!
আমাদের বিশ্বাস যেহেতু দুর্বল, তাই আমাদের মনে আরেকটি সন্দেহ জন্ম নিল, এবং তা আরও দৃঢ় হতে থাকল।
আমরা বললাম:
“হুজুর, আপনি ‘আকাবির’ (أكابر) শব্দের পরিবর্তে ‘কিবার’ (كبار) শব্দটি কেন ব্যবহার করেন না? ‘আকাবির’ বললে তো সাহাবি ও তাবেঈদের মর্যাদার ওপর আঘাত আসে!”
তিনি বললেন:
“এটাতেও একটি উপকারিতা আছে।
আমরা চাই না আমাদের ‘আকাবির’-এর বিরুদ্ধে কেউ সাহাবি ও তাবেঈনের নাম উল্লেখ করুক।
তাই আমরা তাদের ‘আকাবির’ বলি, যেন আমাদের মাযহাব, মতবাদ এবং চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব বিশ্বব্যাপী বজায় থাকে!”
মুরিদ তো সেই, যার মনে কোনো সন্দেহ জন্মায় না।
কিন্তু আমার মনে একটি সন্দেহ উদয় হলো। লক্ষ চেষ্টা করেও সেটা দমিয়ে রাখতে পারলাম না, বরং তা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল। যখন বিষয়টি আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, তখন আমি পীর ও মুরশিদের সাহায্য কামনা করলাম।
আমি আরজ করলাম,
“হজরত! সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) তো উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষ, তাহলে আপনি তাঁদেরকে ‘আকাবির’-এর তালিকা থেকে কীভাবে পৃথক করলেন?”
পীর সাহেব হাসলেন, জোরে হাসলেন, তারপর বললেন,
“আমার বিশ্বাস ছিল, তুমি অবশ্যই এই প্রশ্ন করবে। আমরা এর সমাধান আগেই বের করেছি। আমরা সাহাবাদের জন্য একটি নতুন পরিভাষা সৃষ্টি করেছি, যা যদিও কিতাব ও সুন্নাহতে নেই, তবে এটি খুব কার্যকর।”
আমি অধীর হয়ে প্রশ্ন করলাম,
“শেষ পর্যন্ত সেই পরিভাষাটি কী?”
তিনি বললেন, এবং কী চমৎকার বললেন,
“সাহাবারা হলেন ‘মিআরায়ে হক’ (সত্যের মানদণ্ড)।”
আমার অজ্ঞতা আমাকে কথা বলতে বাধ্য করল, আমি আরজ করলাম,
“হজরত! যদি তাঁরা সত্যের মানদণ্ড হন, তাহলে তাঁদের কথা ‘আকাবির’-এর কথার চেয়ে উচ্চতর হয়ে যাবে।”
তিনি বললেন,
“তা কখনোই হতে পারে না! আমরা ‘আকাবির’-এর মাজহাব অনুসরণ করি এবং তাঁদের কথাই মেনে চলব। ‘সাহাবারা সত্যের মানদণ্ড’—এটিকে আমরা আকিদার বিষয় বানিয়ে ফেলেছি, এর সঙ্গে আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা সাহাবাদের আকিদাগতভাবে সত্যের মানদণ্ড মনে করি, আমলে নয়। বুঝলে?”
হাদিস সম্পর্কে প্রশ্ন ও পীরের প্রতিক্রিয়া
আমি যখন কিছু হাদিস অধ্যয়ন করলাম, এবং সহীহ-দাঈফের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত হলাম, তখন আমি আরজ করলাম,
“হজরত! ‘আহলে হাদিস’-রা বলে থাকেন যে, আমাদের ‘আকাবির’-এর কিছু কথা সহীহ হাদিসের বিপরীত।”
আমার কথা শুনে পীর ও মুরশিদ মেজাজ হারালেন। রাগান্বিত হয়ে বললেন,
“এই অজ্ঞ ও প্রতারকদের ‘আহলে হাদিস’ বলো না! এই শব্দ দিয়ে তারা তোমাকে ধোঁকা দেয়। তাদের আসল নাম ‘গায়রে মুকাল্লিদ’, বরং সঠিক নাম ‘গায়ের কে মুকাল্লিদ’।
ভবিষ্যতে আমার সামনে ‘আহলে হাদিস’ শব্দটি ব্যবহার কোরো না!
এবং শোনো,
যখন তারা তোমাকে বলে যে,
‘অমুক হাদিস আমাদের আকাবিরের কথা ও আমলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’,
তখন তুমি শুধু একটাই প্রশ্ন করবে,
“তোমরা বেশি বুঝো, না আমাদের আকাবির? যাঁরা সারাজীবন ‘কালাল্লাহ’ (আল্লাহ বলেছেন) এবং ‘কালা রাসুল’ (রাসুল বলেছেন) বলে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন?”
এরপর তারা নিজেরাই নীরব হয়ে যাবে।
আমার চূড়ান্ত আস্থার জন্ম
এখন আমি আমার পীরের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে গেলাম।
আমার প্রত্যয় দৃঢ় হলো যে, আমি সঠিক পীরকেই বেছে নিয়েছি।
আমি আরজ করলাম,
“হজরত! এই অসাধারণ জ্ঞান ও তীক্ষ্ণতা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? আপনার প্রতিভার সামনে তো পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব ওলামারাই তুচ্ছ মনে হয়!”
তিনি বললেন,
“এটি ফিকহের কিতাব পাঠ করার বরকত।”
আমি আরজ করলাম,
“হজরত! আমরাও তো ফিকহ পড়েছি, কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার একটুও প্রকাশ পায়নি!”
তিনি বললেন,
“তুমি তো ‘নাদভী’ (দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার ছাত্র) হও, আর নাদভীরা ফিকহ বোঝে নাকি?
তোমরা তো ‘কুদুরি’, ‘শরহে বেকায়া’ এবং ‘হেদায়া’-এর ‘হায়েজ-নেফাস’-এর অধ্যায় পড়ে মনে করো যে ফকিহ হয়ে গেছো।
আমরা ‘কিতাবুল হিয়াল’ (চতুরতার কিতাব) পড়েছি!
ফিকহের আসল কিতাব হলো ‘কিতাবুল হিয়াল’।
সেখানেই আছে সব চাতুর্য ও ধূর্ততা, সেখানে আছে সব ধরনের কৌশল, সেখানে গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে।
এবং,
“সেখান থেকেই রিন্দ (ধূর্ত) ব্যক্তি ‘গুম্বদে মিনা’র রহস্য বুঝতে পারে।”
—————–
# কথোপকথন
লিখেছেন :
মুহাম্মাদ আকরাম নাদভী – অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা:
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।