AkramNadwi

দ্বীন বোঝা ও বোঝানোর সঠিক পদ্ধতি ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/5661

بسم الله الرحمن الرحيم.

|| প্রশ্ন :

শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভী সাহেব,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি ও বারাকাতুহু। আশা করি আপনি সুস্থ ও ভালো আছেন।
আমি একটি বিষয় নিয়ে আপনার কাছে পরামর্শ চাচ্ছি। দয়া করে আমাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিন।

দ্বীন বোঝা এবং তা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায় (এখানে সালাফি পদ্ধতির উল্লেখ নেই):

1. সূফি পদ্ধতি।
2. শুধু জ্ঞাননির্ভর পদ্ধতি।
3. সূফি ও জ্ঞাননির্ভর পদ্ধতির সংমিশ্রণ।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিশুদ্ধ সূফি পদ্ধতিতে বিভ্রান্তি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। অন্যদিকে, একেবারে খাঁটি জ্ঞাননির্ভর পদ্ধতিতে যুক্তিবাদ ও দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
প্রশ্ন হলো, জ্ঞাননির্ভর পদ্ধতি মস্তিষ্ক ও বুদ্ধিকে আকর্ষণ করে, কিন্তু এতে আধ্যাত্মিকতা অনুভূত হয় না। বিপরীতে, সূফি ও জ্ঞাননির্ভর পদ্ধতির মিশ্রণে যে তৃতীয় পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, তা বুদ্ধি ও মনকে নয় বরং আত্মা ও হৃদয়কে প্রভাবিত করে এবং এতে একধরনের আকর্ষণীয়তা রয়েছে। এর কারণ কী ? আপনার মতে কোন পদ্ধতিটি সঠিক এবং হওয়া উচিত?

শেষে উল্লেখ করছি যে, গাজ্জালি এবং সৈয়দ সুলেমান নদভীর মতো ব্যক্তিরাও শেষ পর্যন্ত এই তৃতীয় পদ্ধতিতে এসে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
ওয়াসসালাম।
সালিম সোলানকি নদভী, রাজস্থান।

|| উত্তর :

প্রথমেই একটি মৌলিক বিষয় মনে রাখুন। এটি ইন -শা-আল্লাহ আপনাকে যেকোনো সমস্যার সঠিক সমাধানে সাহায্য করবে।
দ্বীন ও সত্য অনুসন্ধান করা প্রতিটি মানুষের উপর ফরজ। এটি আল্লাহ তাআলার একটি চিরন্তন নিয়ম যে, নবীগণ ছাড়া অন্য কারো কাছে সরাসরি সত্যের ওহি নাজিল হয় না। কারো কাছে নিশ্চিত কোনো প্রেরণা আসে না এবং সত্যের জ্ঞান স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে হয় না। তদুপরি, কোনো অমাসুম ব্যক্তির পছন্দ বা অপছন্দ কখনোই সত্যের মানদণ্ড হতে পারে না।

সত্য একটি মূল্যবোধ (value), যা সব মূল্যবোধের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য সব মূল্যবোধের মতোই সত্যের জ্ঞান অর্জনও প্রমাণ ও নিদর্শনের ওপর নির্ভরশীল।
দ্বীনের সেই সঠিক পথ, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের গ্যারান্টি দেয়, তা কেবল যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমেই চেনা যাবে।

আল্লাহ তাআলা পরম করুণাময় ও দয়ালু। তিনি তাঁর বান্দাদের ভালোবাসেন এবং তাদের বিভ্রান্তি বা অশান্তিতে ফেলতে চান না। এটি কখনোই সম্ভব নয় যে, সহজ ও আকর্ষণীয় কোনো পথ থাকার পরও তিনি মানুষকে কঠিন ও অপ্রিয় পথে পরিচালিত করবেন।

হেদায়াতের জন্য তিনি সবসময় কিতাব ও সহিফা নাজিল করেছেন। এর মধ্যে শেষ ও পূর্ণাঙ্গ কিতাব হলো কুরআনুল কারিম। সত্যের নির্দেশনার এমন কোনো মৌলিক বা শাখাগত বিষয় নেই যা কুরআন মাজিদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন পদ্ধতিতে এটি ব্যাখ্যা করেছেন, যাতে বিষয়টি মানুষের বোধগম্য হয়। কখনো তিনি ফিতরাতি যুক্তি দিয়েছেন, কখনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ, কখনো সৃষ্টিজগতে চিন্তার নির্দেশ দিয়েছেন, আবার কখনো আত্মার সাক্ষ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। কোথাও উদাহরণ ও কাহিনির আশ্রয় নিয়েছেন, আবার কোথাও সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা দিয়েছেন।

এই জ্ঞান—ফিতরাত, বুদ্ধি ও ওহি—কে কুরআনুল কারিমে সত্যের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“জেনে রাখুন, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই।”
(মুহাম্মাদ -১৯)

“আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে শুধুই জ্ঞানীরা ভয় করে।”
( ফাতির -২৮)

“এগুলোকে কেবল জ্ঞানীরাই উপলব্ধি করতে পারে।”
(আনকাবুত -43)

“তারা বলবে, যদি আমরা শুনতাম বা বুঝতাম, তবে আমরা জাহান্নামের বাসিন্দাদের মধ্যে থাকতাম না।”
(মুলক- ১০)

“বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?”
(যুমার -৯)

রাসুলুল্লাহ ﷺ কে আদেশ করা হয়েছে:
“বলুন, হে আমার প্রভু, আমাকে জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।”
(ত্বাহা -১১৪)

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যার প্রতি আল্লাহ তাআলা কল্যাণ করতে চান, তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন।”
(বুখারী, মুসলিম)

যখন মানুষ জ্ঞানের পথ অবলম্বন করে, তখন সে কিছু কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়, যেগুলো সমাধান করা সহজ নয়। এই কঠিন পর্যায়ে যেন মানুষ সত্যের স্পষ্ট পথ থেকে বিচ্যুত না হয়, সেজন্য আল্লাহ তাআলা নবীদের প্রেরণ করেছেন। নবীগণ পাপমুক্ত এবং সবসময় আল্লাহ তাআলার সাহায্যে পরিচালিত হন।

আল্লাহ তাআলা নবীদের পথকে সোজা পথ (সিরাতুল মুস্তাকিম) বলেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন যে তাঁর বান্দারা তাদের অনুসরণে তাঁর ইবাদত ও আনুগত্য করবে। নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মদ ﷺ। আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো , তবে আমাকে অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।”

কুরআন ও রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাহ থেকে হেদায়াত গ্রহণকারী সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নির্বাচিত দল হলেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম। আসমান-জমিন এমন উত্তম দল আর কখনো দেখেনি। পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিমও সাহাবিদের সবচেয়ে সাধারণ সদস্যের (সাহাবিদের মধ্যে সাধারণ কেউ নেই) মর্যাদায় পৌঁছাতে পারবে না।

সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম-এর পর, যারা কুরআন ও সুন্নাহর কাছাকাছি থাকবে, তারা সত্যের কাছাকাছি থাকবে। আর যারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দূরে থাকবে, তারা সত্য থেকেও দূরে সরে যাবে।

পরবর্তী যুগগুলোতে বিভিন্ন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। প্রতিটি সেই পদ্ধতি, যা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবায়ে কেরামের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) পথ থেকে ভিন্ন, তা বিদআত এবং দ্বীনে নতুন কিছু সংযোজন। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধিক হাদিসে এটি স্পষ্ট করেছেন। এর মধ্যে একটি হাদিসের শব্দ হলো: “ما أنا عليه وأصحابي”۔”
(যা আমি এবং আমার সাহাবিরা পালন করি)

এই নতুন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তাসাউফ। এর মধ্যে সত্যিকারের ইসলামের অংশ খুবই কম, বরং অধিকাংশই রীতিনীতি, অভ্যাস, মনগড়া পরিভাষা এবং প্রমাণবিহীন অবস্থান ও মানসিক পরিস্থিতি। পীর-মুরিদ সম্পর্ক, বিভিন্ন সিলসিলা, নবপ্রবর্তিত দোয়া ও জিকির, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্য, আত্মমগ্নতা, শৌখিনতা, সংকুচিত অবস্থা, প্রফুল্ল অবস্থা, কুতুব, গাউস, ওয়াহদাতুল উজুদ ও ওয়াহদাতুশ্ শুহুদ ইত্যাদি বিষয় তাসাউফকে একটি নতুন পথ বানিয়ে ফেলেছে। এগুলোর কোনোটাই কুরআনে নেই, হাদিসে নেই এবং সাহাবায়ে কেরামের কথা ও কাজে পাওয়া যায় না। বরং এমনকি তাবেয়ীন এবং প্রখ্যাত ইমামদের মতো ব্যক্তিত্ব, যেমন সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব, আলকামা, আসওয়াদ, কাসিম ইবনে মুহাম্মদ, সালিম ইবনে আবদুল্লাহ, আতা ইবনে আবি রাবাহ, হাসান বসরি, ইবনে সিরিন, ইব্রাহিম নাখাই, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, সুফিয়ান সাওরি, আওযাই, লাইস ইবনে সা’দ, আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ ইবনে হাসান, আবদুর রহমান ইবনে মাহদি, ইমাম শাফেয়ী, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, আবু সাওর, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ এবং ইবনে মাজা (রাহিমাহুমুল্লাহ) – এদের কারো থেকেই এগুলোর কোনো রকম উল্লেখ পাওয়া যায় না।

একটি ভুল, যা সর্বদা সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে মানুষকে বিপথগামী করেছে, তা হলো তথাকথিত রুহানিয়াত (আধ্যাত্মিকতা), আকর্ষণীয়তা ইত্যাদির পেছনে ছোটা। মানুষ এটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, দ্বীনের পথে চলার অর্থ হলো মানসিক প্রশান্তি পাওয়া, আত্মিক আনন্দে পরিপূর্ণ হওয়া এবং কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান বা অভিজ্ঞতার অনুভূতি পাওয়া।

এর একটি উদাহরণ হলো, কেউ যদি কেবলমাত্র খাদ্যের স্বাদ এবং লোভের জন্য তা গ্রহণ করে, তবে তার ফলাফল ধ্বংসের দিকে যাবে। খাদ্যের মূল উদ্দেশ্য হলো শক্তি এবং স্বাস্থ্য অর্জন। স্বাদ কেবল একটি গৌণ বিষয়। এমনকি যদি স্বাদ না থাকে, তবুও খাদ্য উপকারী হয়। বরং এটি সম্ভবত আরও উপকারী, কারণ স্বাদের জন্য মানুষ প্রায়ই স্বাস্থ্যকর খাদ্য অতিরিক্ত গ্রহণ করে এবং পরে বিপজ্জনক রোগে আক্রান্ত হয়।

দ্বীনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত এবং আনুগত্য করা। যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে এবং তার আনুগত্যে থাকে, এমনকি যদি তার উপর কোনো প্রেরণা নাও আসে, কোনো ‘কশফ’ বা স্বপ্ন না হয়, কোনো অভিজ্ঞতা বা অবস্থান অনুভূত না হয়, তথাকথিত রুহানিয়াতের কোনো স্বাদ না মেলে, তবুও সে সফল এবং আল্লাহর নিকটবর্তী। আর যে ব্যক্তি ইবাদত এবং আনুগত্যের পথ ছেড়ে তথাকথিত রুহানিয়াত, আকর্ষণ, স্বাদ, আনন্দ, এবং আত্মমগ্নতার পিছনে ছোটে, সে বিভ্রান্ত হবে। এমন রুহানিয়াত খ্রিস্টান, হিন্দু এবং বিভ্রান্ত অন্যান্য জাতির মধ্যেও পাওয়া যায়।

মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি জ্ঞানের আলোকে আল্লাহর ইবাদত করে, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নতের অনুসরণ করে এবং বিদআত ও নতুন সংযোজন থেকে দূরে থাকে, সে আল্লাহর প্রিয় হয়ে যায়। তখন সে প্রকৃত সেই স্বাদ লাভ করে, যা দুনিয়াতেই জান্নাতের অনুভূতি এনে দেয়। শর্ত হলো, মানুষ যেন তাকওয়া এবং ধৈর্যের দৃষ্টান্ত ধরে রাখে এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো লোভ বা আকর্ষণকে তার উদ্দেশ্য বানায় না।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে নিজের সান্নিধ্য দান করুন। আমিন।

—-
> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।

> অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *