https://t.me/DrAkramNadwi/2939
بسم اللّه الرحمن الرحيم.
❝
||একটি উপমা:
“আলিফ লায়লা ওয়ালায়লা” এর একটি বিখ্যাত গল্প রয়েছে: “আলী বাবা এবং চল্লিশ চোর”। এই গল্পটি আমরা সবাই বহুবার শুনেছি ও পড়েছি। গল্পের প্রধান চরিত্র আলী বাবা। একদিন আলী বাবা জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে ফিরছিলেন, তখন তিনি দূর থেকে চল্লিশ চোরকে আসতে দেখলেন। তিনি তাঁর কাঠগুলো সেখানেই রেখে একটি গাছের ওপরে উঠে গেলেন। দেখলেন যে চোরেরা একটি পাহাড়ের সামনে গিয়ে থামলো। তাদের নেতা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে জোরে বললেন, “খুল যা, সিম সিম!” এটা বলার সাথে সাথেই পাহাড়ের পাথর সরে গেল। সব চোর সেই গুহায় প্রবেশ করলো এবং লুট করা জিনিসপত্র সেখানে রাখলো। এরপর তারা সবাই বের হয়ে এলো। চোরদের নেতা আবার পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “বন্ধ হ যা, সিম সিম!” এবং সাথে সাথেই পাহাড়ের মুখ বন্ধ হয়ে গেল।
আলী বাবা এই শব্দ শিখে নিলেন। তিনি এই শব্দ বলে গুহায় প্রবেশ করতেন, সেখান থেকে সোনা নিয়ে আসতেন এবং আবার এই শব্দ বলেই দরজা বন্ধ করতেন।
|| কারণসমূহ:
আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়াকে কারণ-নির্ভর করে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের টিকে থাকার জন্য আমরা খাই এবং পান করি, অর্থ উপার্জন করি, অসুস্থ হলে ওষুধ সেবন করি, কোথাও যাওয়ার জন্য ভ্রমণ করি। এই সব কারণই আল্লাহ তায়ালা তৈরি করেছেন, এবং এগুলো গ্রহণ করা আমাদের জন্য আবশ্যক।
|| দোয়ার স্থান:
সব কারণের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিশ্চিত কারণ হল দোয়া। ইবাদতও দোয়ার অন্তর্ভুক্ত। দোয়ার শক্তিশালী ও নিশ্চিত হওয়ার কারণ হলো এটি সরাসরি মুসাব্বিবুল আসবাব (সকল কারণের স্রষ্টা) এর সাথে সম্পর্কিত। দোয়া এবং আল্লাহ তায়ালা এর মধ্যে কোনো বাহ্যিক বা পার্থিব মাধ্যম নেই।
যেসব বিষয় আমরা বিভিন্ন কারণের মাধ্যমে অর্জন করি, সেই কারণগুলোর সাথে প্রকৃতপক্ষে কোনো বাস্তব সম্পর্ক নেই, আল্লাহর আদেশ ছাড়া। এই দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে, সব আল্লাহর আদেশেই ঘটে। তিনিই কারণের স্রষ্টা এবং ফলাফলও তাঁরই সৃষ্টি। যদি তাঁর আদেশ না থাকে, তাহলে সমস্ত কারণ থাকা সত্ত্বেও কোনো ফল পাওয়া যাবে না।
আল্লাহর আদেশ লাভের মাধ্যম হলো ইবাদত ও দোয়া। আল্লাহর প্রজ্ঞাবান বান্দারা এই রহস্য জানেন। তাই তারা কোনো কারণের ওপর ভরসা করেন না; বরং তারা শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশের ওপর ভরসা করেন। কোনো কারণ গ্রহণ করার আগে তারা আল্লাহ তায়ালা এর কাছে প্রার্থনা করেন। এই প্রার্থনার মাধ্যমেই তাদের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। তারা কারণ গ্রহণ করেন এই জন্য যে তাদের মালিক তাদের প্রয়োজনগুলো কারণের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন। অন্যথায়, সেই কারণগুলো কোনো কিছু সৃষ্টি করে না।
দোয়া নিশ্চিত কারণ। এটি বারবার কুরআন মাজীদে উল্লেখ করা হয়েছে:
“আমি দোয়ার আহ্বানে সাড়া দিই, যখন আমাকে ডাকা হয়”
“আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো”
“কে সে, যে বিপদগ্রস্তের ডাকে সাড়া দেয়, যখন তাকে ডাকা হয়, এবং দুঃখ দূর করে?”
এমন অসংখ্য আয়াত রয়েছে।
|| কষ্টদায়ক বিষয়:
দোয়া এত কার্যকর একটি মাধ্যম, তবুও মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ে অভিযোগ করতেই থাকে। তাদের দোয়ার চেয়ে কারণের প্রতি বেশি ভরসা থাকে। এর কারণ হলো সাধারণত মানুষ দোয়ার প্রকৃত অর্থ বুঝে না এবং সঠিকভাবে দোয়া করে না।
সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় হলো, অনেক আলেমও দোয়ার প্রকৃত অর্থ বোঝেন না এবং সঠিকভাবে দোয়া করেন না।
বেশিরভাগ মানুষ দোয়াকে “খুল যা সিম সিম” এবং “বন্ধ হ যা সিম সিম” এর মতো একটি কোডেড (coded) শব্দ মনে করেন। মনে করেন, যদি কোডটি মনে থাকে, তাহলে দরজা খুলবে; আর যদি ভুলে যান, তাহলে দরজা খুলবে না। এমনকি কোডের অর্থ জানাও এখানে জরুরি নয়।
কারণ, মানুষ দোয়াকে “সিম সিম” এর মতো কোড মনে করে, তাই দোয়ার শব্দ মুখস্থ করে। কেউ কেউ অন্যের দোয়া অনুকরণ করে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে দোয়ার বাক্য কপি-পেস্ট করার প্রচলন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে এবং এটিকে সৎকর্ম হিসেবে ধরা হচ্ছে।
কেউ কেউ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সকালে একটি দোয়া পোস্ট করে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এই শব্দগুলো এদিক-সেদিক পাঠানোর মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হয় না। এমনকি এই শব্দগুলো সবার সামনে উচ্চারণ করলেও কোনো প্রয়োজন পূর্ণ হবে না। কারণ, সৃষ্টির শব্দ বাস্তবতা তৈরি করে না। কেবল আল্লাহ তায়ালা এর বাণী বাস্তবতাকে সৃষ্টি করে। তিনিই একমাত্র “কুন ফাইয়াকুন” এর অধিকারী।
এখানে সংক্ষেপে দোয়ার প্রকৃত অর্থ তুলে ধরা হয়েছে এবং এর সঠিক পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি ভুল পদ্ধতি থেকে দূরে থাকার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যেন আমরা দোয়ার মতো অত্যন্ত কার্যকর এবং শক্তিশালী একটি বিষয় থেকে সঠিকভাবে উপকৃত হতে পারি।
|| দোয়ার প্রকৃত স্বরূপ:
এই বিশ্বজগতের সমস্ত কিছুর মালিক আল্লাহ। তিনিই উপকার করেন এবং তিনিই ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন। পাশাপাশি, তিনি বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু এবং তাদের জন্য এতটাই কল্যাণকামী যে, কোনও মা তার সন্তানদের প্রতি যতটা দয়ালু হতে পারে, তিনি তার চেয়েও বেশি দয়ালু। বান্দাদের প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। আপনি যদি আমার কাছে
এক পয়সা চান, তবে আমি যতই কৃপণ হই না কেন, এক পয়সা দেওয়া আমার জন্য অত্যন্ত সহজ। আল্লাহর কাছে আপনি যা চান, তা ওই পয়সার চেয়েও সহজ।
আমরা নিঃস্ব, অসহায়, এবং আমাদের নিজেদের উপকার বা ক্ষতির কোনও জ্ঞান নেই। আমরা কারণগুলো জানি না, সেগুলো অর্জন করতেও সক্ষম নই, এমনকি কারণ ও পরিণতির মধ্যে কোনও সম্পর্ক স্থাপন করতেও পারি না। আমাদের জন্য একমাত্র পথ হলো, আমাদের সবকিছু আমাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করা। তিনি আমাদের কথা শোনেন, আমাদের প্রয়োজন পূরণ করেন, আমাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হন এবং প্রার্থনার জন্য ইবাদতের সওয়াব প্রদান করেন।
|| দোয়ার পদ্ধতি:
দোয়ার সঠিক পদ্ধতি বুঝতে আপনাকে নিম্নলিখিত তিনটি কাজ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে:
= প্রথম কাজ:
প্রথমেই নিজের প্রয়োজনীয় বিষয়টি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উপলব্ধি করুন। এটা ভাবুন যে, তা পূরণ করতে পারে একমাত্র আল্লাহ। তিনি যদি পূরণ করতে চান, তবে তিনি এর কারণগুলো সৃষ্টি করবেন; আর যদি চান, তবে কোনও কারণ ছাড়াই তা প্রদান করবেন। আবার, যদি তিনি পূরণ করতে না চান, তবে সমস্ত কারণ উপস্থিত থাকলেও আপনার প্রয়োজন পূরণ হবে না।
= দ্বিতীয় কাজ:
নিজের হৃদয়ে ওই বিষয়টি পাওয়ার জন্য গভীর আকাঙ্ক্ষা তৈরি করুন এবং সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আপনার প্রভুর কাছে অনুরোধ জানান, কাঁদুন এবং আকুতি করুন।
= তৃতীয় কাজ:
আপনার প্রয়োজনীয় বিষয়টিকে বাক্যের আকারে গড়ে তুলে আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করুন। চেষ্টা করুন যেন আপনার দোয়া আল্লাহ ছাড়া কেউ না শুনতে পায়। মনে রাখবেন, মুখে যা বলছেন, তা তখনই কার্যকর হবে যখন মন ও হৃদয়ের অংশগ্রহণ থাকবে। সুতরাং, যা বলছেন, তা যেন আপনার হৃদয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। না বুঝে কথা বললে তা দোয়া হয় না।
এইভাবে একবার দোয়া করাই যথেষ্ট। নবীরা (আলাইহিস সালাম) প্রত্যেক দোয়া একবারই করেছেন। আল্লাহ প্রথমবারেই শুনে নেন। তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
এখানে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সহীহ হাদিসে কিছু দোয়া বারবার পড়ার নির্দেশনা কেন দেওয়া হয়েছে? এর উত্তর আলাদা প্রবন্ধে দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ। তবে এখানে এতটুকু বুঝে নিন যে, সেগুলো হয় জিকিরের পর্যায়ে পড়ে এবং জিকিরে পুনরাবৃত্তি কাঙ্ক্ষিত, অথবা সেগুলোর মাধ্যমে বিশেষ কিছু শেখানো হয়েছে।
|| দোয়ায় ভুলগুলো:
আমরা এমন কিছু ভুল করি, যার কারণে দোয়া থেকে কোনও উপকার হয় না:
= প্রথম ভুল:
আমাদের আল্লাহর ওপরই বিশ্বাস থাকে না যে, তিনি আমাদের প্রয়োজন পূরণ করবেন। একবার কেউ ইমাম জাফর সাদিকের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, আমাদের দোয়াগুলো কেন কবুল হয় না? তিনি বললেন, তোমরা জানোই না যে, তোমরা কার কাছে চাচ্ছো।
= দ্বিতীয় ভুল:
আমরা মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করি না। এই উপস্থিতি ছাড়া কোনো দোয়া আসলে দোয়া হয় না। হযরত উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.) এক ব্যক্তিকে দেখেছিলেন, যে নুড়ি পাথর নিয়ে খেলা করছিলো এবং আল্লাহর কাছে হুরের প্রার্থনা করছিলো। তিনি বলেছিলেন: “বি’সুল খাতিবু আনতা,” অর্থাৎ, “হুরের সঙ্গে বাগদান করার এটা কতই না খারাপ পদ্ধতি।”
= তৃতীয় ভুল:
আমরা দোয়ার শব্দগুলোকে যাদু মনে করি, বা এগুলোকে কোনও কোডের মতো ব্যবহার করি। এ কারণেই আমরা বিভিন্ন জায়গার দোয়াগুলো ব্যবহার করতে থাকি। কোরআনে কোথাও পাওয়া যাবে না যে, কোনও নবী বা সৎ ব্যক্তি অন্য কারও দোয়ার বাক্য হুবহু ব্যবহার করেছেন। বরং সবাই নিজেদের দোয়া নিজেদের বাক্যে করেছেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তবে কেন কিছু দোয়ার বাক্য শেখানো হয়েছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, সেগুলো পরকালের বিষয়াবলির সঙ্গে সম্পর্কিত, অথবা এগুলোর মাধ্যমে কিছু বিশেষ বিষয় শেখানো হয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য সময় করা হবে।
= চতুর্থ ভুল:
আমরা একান্তে দোয়া করার বদলে জনসমাগমে দোয়া করি। মানুষ সবার সামনে কাঁদতে কাঁদতে দোয়া করে এবং আকুতি জানায়। এটি অত্যন্ত অভদ্র আচরণ। আল্লাহর সামনে কাঁদার সঠিক পদ্ধতি হলো একান্তে কাঁদা। ইমাম সুফিয়ান সাওরি বলতেন, “যে বিষয়টি অন্যের জ্ঞানে চলে যায়, আমরা তাকে সৎকাজই মনে করি না।”
দোয়ার শব্দই আসল বিষয় নয়, বরং যদি এতে ভুলও হয়ে যায়, তবুও দোয়া গ্রহণযোগ্য হবে। শব্দের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে জ্ঞান ও হৃদয়ের উপস্থিতির প্রতি মনোযোগ দিন। দোয়া কেবল আল্লাহর কাছেই করুন, মানুষের সামনে তা উচ্চারণ করবেন না। যদি আপনি এই নীতিগুলো মেনে চলেন, তবে আপনি দেখবেন যে আল্লাহ তাআলা কত দ্রুত আপনার প্রয়োজন মেটান। যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি একটি নতুন দরজা খুলে দেন এবং সবসময় তার চেয়ে বেশি দেন যা আপনি প্রার্থনা করেন।
একজন ব্যক্তি এক সাধুর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলো, এমন কাউকে জানান, যার দোয়া অবশ্যই কবুল হয়। তিনি উত্তর দিলেন, “আমি এমন কাউকে জানি না যার সব দোয়া কবুল হয়, তবে আমি জানি তিনি (আল্লাহ) সমস্ত দোয়ার উত্তরদাতা।”
যখন আপনি এত দ্রুত দোয়া কবুল হতে দেখবেন, তখন আপনি দোয়াকে ভালোবাসতে শুরু করবেন এবং এমন প্রতিটি বিষয়কে ঘৃণা করবেন যা দোয়া ছাড়া অর্জিত হয়। দোয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর জন্য ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়, এবং ইবাদতের সওয়াব নিশ্চিতভাবে সেই সমস্ত বিষয়ের চেয়েও বড় যা আমরা চাই।
আমাদের প্রতিপালক কতই না দয়ালু যে আমরা তার কাছে আমাদের প্রয়োজনগুলো চাই, তিনি তা সুন্দরভাবে পূরণ করেন এবং আমাদেরকে চিরস্থায়ী সওয়াব প্রদান করেন। সুতরাং, সমস্ত প্রশংসা রাব্বুল আলামিনের জন্য।
——————–
# গবেষণা # তালীম/শিক্ষা # নাসিহা/উপদেশ #
> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
> অনুবাদ ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।