https://t.me/DrAkramNadwi/6234
بسم الله الرحمن الرحيم.
“
——————–
এমন এক সময়ে, যখন গর্জনধ্বনির মতো
গাজায় শিশুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে, কিছু শিশু ঘুমিয়ে পড়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর, কিছু মা নিহত হন অথবা বিস্ফোরণের আগুনে সন্তানের বিদায় জানাতে বাধ্য হন। কাঁপা হাতে কিছু বৃদ্ধ তাঁদের শুকিয়ে যাওয়া গালে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মুছেন।
কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউই এই পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাস শুনে না, কেউ আকাশে ছড়িয়ে থাকা এই ব্যথার টুকরোগুলো জড়ো করে না।
হায় সেই ক্লান্ত শরীর আর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়—যারা আর্তনাদ করে ওঠে:
“কী প্রশস্ত এই মৃত্যু, যেন এর মাঝে একটু শান্তি পাওয়া যায়!”
“আর কোথায় সেই নিরাপত্তা ও শান্তি, যখন নিয়তির রায়ে ধেয়ে আসে ধ্বংস!”
এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মধ্যে, যেখানে আমাদের শরীরগুলো আমাদের অনুভবকেও ধারণ করতে পারছে না, সেখানেই একটি প্রশ্ন হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয় :
আমরা কার আশ্রয় নেব ?
আমাদের যদি আপনজন মুখ ফিরিয়ে নেয়, দূরের লোক সরে দাঁড়ায়—তাহলে আমাদের জন্য কে থাকবে?
আমরা আমাদের আপনজন ও ঘনিষ্ঠদের বাহ্যিক আচরণে হতবাক, আর তাদের অন্তরের গোপনতা আরও বেশি হতবাক করে।
এই প্রশ্নের জবাব আসে সহজাত প্রবৃত্তির গভীর থেকে, এমন এক ঈমান থেকে, যেটি রাজনীতির ঝড়ে নিভে যায়নি, স্বার্থের মাপে বিকৃত হয়নি:
আমরা আল্লাহর দিকেই ফিরে যাই, তাঁর কাছেই সাহায্য চাই, তাঁরই ওপর ভরসা করি।
তিনি-ই আমাদের আশ্রয়, যখন সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তিনিই ন্যায়বিচার, যখন পৃথিবী থেকে ন্যায়বিচার হারিয়ে যায়।
ফিলিস্তিন কেবল কোনো আরবের ক্ষত নয়, বা কোনো “বিষয়” নয়, যেটি কনফারেন্সে তোলা হয় আর ঠান্ডা দপ্তরে ভুলে যাওয়া হয়। বরং এটি হচ্ছে উম্মাহর বাস্তবতার দর্পণ, এর সম্মানের মানদণ্ড, এর ধৈর্য ও ঈমানের পরীক্ষা।
এই পৃথিবী যদি রক্তের ছবি দেখে ক্লান্ত হয়েও পড়ে, ধ্বংসের ছায়া দেখে যদি বিরক্ত হয়েও থাকে—তবুও আল্লাহ কখনো মজলুমের করুণ আর্তনাদে ক্লান্ত হন না, কখনো নির্যাতিতের দোয়া ফিরিয়ে দেন না।
একটি মুহূর্তের তন্ময়তায় আমরা স্মরণ করি, আল্লাহ তাআলা আমাদের কষ্টের সময় ধৈর্য ও নামাজের নির্দেশ দিয়েছেন:
“হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও”,
তারপর আমাদের শান্তি দিয়েছেন এই বলে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”
এই আল্লাহর সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি কোনো স্লোগান নয়, বরং এটি এক সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি, যা কোনো সম্মেলনের ইচ্ছায় নির্ধারিত হয় না, কোনো ঘোষণাপত্রে লিখিত হয় না। বরং এটি বাস্তব হয়, যখন অন্তর ধৈর্যে স্থির হয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সত্যে অবিচল থাকে, আর যারা ময়দানে আছে তারা আমানতের খিয়ানত না করে।
তাই আসুন, দিনের বেলায় আমরা আমাদের রবের সামনে রুকু করি, সিজদায় লুটিয়ে পড়ি, আর রাতে তাহাজ্জুদের শক্তি পেলে তাহাজ্জুদ পড়ি।
সৃষ্টি মাত্রই তাঁর পবিত্রতা ও গুণগান করে, পাথর ও পাখিরাও তাঁর জিকিরে মশগুল—তাই আসুন, আমরাও সেই জিকির বুঝে নিই, সেই তাকবির হৃদয়ে ধারণ করি।
এই পরিবর্তনশীল সময়ে অনেক ধারণা একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। আর সবচেয়ে ভয়ানক যে গুলিয়ে যাওয়া বিষয়টি ঘটেছে, তা হলো—কিছু মানুষ ইলম ও তাকওয়ার নামে এমন এক আড়াল বানিয়েছে, যা মানবিক অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেয়।
তারা মনে করায়, যেন একজন আলিমের ভালোবাসার অধিকার নেই, কাঁদারও নেই, যেন একজন মুত্তাকী হাসতেও পারে না, নিঃশ্বাসও নিতে পারে না অন্যদের মতো করে।
তারা ভুলে গেছে যে, সাহাবিরা—যারা ছিলেন সর্বাপেক্ষা পরহেজগার—তাঁরাও হাসতেন-কাঁদতেন, রাগ করতেন-রাজি হতেন, ভালোবাসতেন-কষ্ট পেতেন। তারা নবী ছিলেন না, বরং এমন মানুষ ছিলেন, যাদের মাঝে আত্মার পবিত্রতা ও অনুভবের সত্যতা প্রকাশ পেত।
তাকওয়ার নামে অনুভূতির উপর অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা চাপানো এমন এক প্রজন্ম তৈরি করতে পারে, যারা আবেগহীন জীবন্ত লাশে পরিণত হবে। এর ফলে দ্বীন তার মানবিক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে।
হালাল তো হালালই থাকে, হারাম হারামই থাকে। কেউই আল্লাহর বিধান ছাড়া কোনো কিছু হারাম করে দিতে পারে না। এবং কঠোরতাকে পবিত্রতার পোশাক পরানোও ঠিক নয়।
পবিত্রতা তো একমাত্র মহান আল্লাহরই।
আমরা নিজেদের নাম রাখি ‘আবদুর রহিম’, ‘আবদুল আজিজ’, ‘আবদুস সামাদ’—কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাঁর বান্দা হয়ে উঠতে পারিনি।
এবং সেই কারণেই দুনিয়ার জাতিগুলো আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যেমন ক্ষুধার্তরা থালার চারপাশে ভিড়ে আসে।
বিশ্বের এই নিষ্ক্রিয়তা, মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, আর অবস্থানের বিভ্রান্তির মাঝে একজন মুমিন যা করতে পারে, তা হলো—তার হাত তুলে আকাশের দিকে মুখ করা, তার স্রষ্টার কাছে মিনতি করে বলা:
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে তোমার কোনো সৃষ্টি—কোনো মানুষ বা জাতির ওপর নির্ভরশীল করে দিও না, আমাদের নিজেদের ওপরও ছেড়ে দিও না, আর সেই সব জাতির ওপরও ছেড়ে দিও না যারা আমাদের পরিত্যাগ করেছে।”
তুমি আমাদের রব, আমরা তোমার ছাড়া আর কোনো রবকে চিনি না।
তুমি দরজার স্রষ্টা, যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
আজ আমাদের দোয়া কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি ঈমান। আমাদের অশ্রু কোনো পরাজয় নয়, বরং এটি ইবাদত। মুমিন কখনো হতাশ হয় না, কারণ তার এক মহান রব আছেন—যিনি বলেন:
“আর আমি চাই, যাদের পৃথিবীতে দুর্বল করা হয়েছে, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করি, তাদের নেতা বানাই, আর তাদেরকেই উত্তরাধিকারী বানাই।”
আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতির খেলাফ করেন না।
ফিলিস্তিনে এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যা ঘটছে, তা শুধু কোনো রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বা ক্ষণস্থায়ী কোনো সংকট নয়। বরং এটি এক গভীর নৈতিক ও আত্মিক পরীক্ষা, যা মানুষের আসল রূপ প্রকাশ করে, আনুগত্যের সত্যতা যাচাই করে, তাকওয়া, পরহেজগারি, সাহায্য, দোয়া ও আশার প্রকৃত অর্থকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে।
তাই, হে সেই ব্যক্তি যে এই যন্ত্রণাকে অনুভব করছো—হতাশ হয়ো না।
যার কেবল হৃদয় ও জিহ্বা ছাড়া কিছু নেই—সে আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ জানাও।
আর যে বিজয়ের অপেক্ষায় আছো—জেনে রাখো, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন”, আর বিজয় অতি সন্নিকটে, যদিও পথ দীর্ঘ।
এই পরাভবের যুগে তুমি হয়ে ওঠো বিবেকের কণ্ঠস্বর, সহজাত মানবতার স্পন্দন। তুমি হয়ে ওঠো তাদের একজন—যারা আল্লাহর কথা শুনলে অন্তর কেঁপে ওঠে, আর যখন বিপদ আসে, তখন বলে: “আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই শ্রেষ্ঠ অভিভাবক।”
——————–
✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।