https://t.me/DrAkramNadwi/5650
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
সোমবার, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
লিখেছেন : ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভী,
অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট বাংলাদেশ
|| প্রাতঃকালীন প্রথম অধিবেশন :
সকাল ৯:৩০ মিনিটে প্রথম সকালের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রশাসনিক বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য নির্ধারিত ছিল। অধিবেশন শুরু হয়েছিল কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান সমস্যা, আর্থিক সম্পদের ঘাটতি, এই বিষয়ে আলোকপাতের মাধ্যমে। এই ঘাটতির কারণ এবং এর প্রভাব নিয়ে গভীর আলোচনা হয়, যা কাউন্সিলের কার্যক্রম এবং ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোতে প্রভাব ফেলছে। এই সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্য বিভিন্ন ধারণা এবং প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়, যার মধ্যে নতুন অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধান এবং সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কর্মক্ষম দক্ষতা উন্নয়ন এবং মহাসচিবের উপর অর্পিত দায়িত্ব কমানোর জন্য, সক্রিয় এবং দক্ষতার সাথে অভিজ্ঞ দুইজন সহকারী নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দৈনন্দিন কার্যক্রমে তাকে সমর্থন করার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে, এমন একটি দল নির্বাচন করা প্রয়োজন যারা বিভিন্ন ফাইল পরিচালনা করতে নমনীয়তা এবং পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম।
অধিবেশনে কাউন্সিলের সদস্যপদ সম্প্রসারণের বিষয়টিও আলোচিত হয়। ইউরোপ এবং বৃহত্তর ইসলামী বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং সংস্থাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সদস্যপদ বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিত্ব শক্তিশালী করা এবং এর প্রভাব বিস্তৃত করা। উপস্থিত সদস্যরা এই উদ্যোগের প্রতি গভীর সমর্থন প্রকাশ করেন এবং এর গুরুত্বের উপর জোর দেন। তারা উল্লেখ করেন যে, এটি কাউন্সিলের লক্ষ্য অর্জন এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এর অবস্থানকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অধিবেশনের শেষাংশে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নির্ধারণ করা হয় এবং এটি নিয়মিতভাবে অনুসরণ করার জন্য একটি সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়।
|| প্রাতঃকালীন দ্বিতীয় অধিবেশন :
দ্বিতীয় প্রাতঃকালীন অধিবেশন সকাল ১১টা ১৫ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলতে থাকে। এই অধিবেশনে যে গবেষণাপত্রগুলো উপস্থাপন করা হয়, সেগুলোর মধ্যে ছিল:
> ১. “জার্মানিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মুসলিমদের জীবনে প্রভাব” – উপস্থাপক: নাদা বাসিসু, যিনি ফিলিস্তিন থেকে আগত এবং বর্তমানে জার্মানিতে বসবাসরত।
> ২. “ফরাসি আইনগুলোর সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস রক্ষার ফিকহি পদ্ধতি” – উপস্থাপক: জাকারিয়া হুসাইনি।
> ৩. “পশ্চিমে ইসলামী উপস্থিতির বার্তাবাহী দিক এবং দ্বীন ধর্ম রক্ষার ফিকহ” – উপস্থাপক: ড. আমিন হাজমি।
> ৪. “ধর্মীয়তার দিকনির্দেশনা দিতে কাউন্সিলের ভূমিকা” – উপস্থাপক: ড. সালেম শাইখি।
|| ইসলামী সমাজ গঠনে পিতামাতা, ইমাম ও দায়িত্বশীলদের ভূমিকা :
গবেষণাপত্র উপস্থাপনের পর আমার পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরার সময় আমি বিশেষভাবে জোর দিয়েছি পিতামাতার শিক্ষায়নের ওপর। তাদের শিক্ষাগত এবং ধর্মীয় ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর গুরুত্ব উল্লেখ করেছি, যেন তারা তাদের সন্তানদের প্রশ্নগুলোর ইসলামি ভারসাম্যপূর্ণ উত্তরের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন। এই উত্তরগুলো যেন শিশুদের বুদ্ধি এবং মানসিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এগুলো হতে হবে প্রজ্ঞায় ভরা, ভালোবাসায় পূর্ণ, এবং এমনভাবে গঠিত যা শিশুদের মনে ইসলামী মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে পারে এবং তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। সঠিক উত্তর শুধুমাত্র বিধান জানানোতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এমন হতে হবে যা হৃদয় ও মস্তিষ্ককে সন্তুষ্ট করে এবং শিশুকে ধর্ম ও তার দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে সংযোগ অনুভব করায়।
আমি আরও জোর দিয়েছি ইমাম, খতিব, মসজিদের দায়িত্বশীল এবং ফতোয়ার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার উপর। কারণ তারা ইসলামী সমাজ গঠনে এবং এর সদস্যদের দিকনির্দেশনা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের আচরণ উন্নত করা এবং সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে, তাদের বয়স বা পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, আরও বেশি বোঝাপড়া ও নমনীয়তার সঙ্গে আচরণ করার জন্য তাদের প্রস্তুত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে নারী-পুরুষ উভয়ের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে আচরণ, যুবসমাজের সমস্যাগুলো সচেতনতা এবং প্রজ্ঞার সঙ্গে সমাধান করা এবং শিশুদের প্রয়োজনগুলো দয়া এবং ধৈর্যের সঙ্গে পূরণ করা।
|| সান্ধ্যকালীন অধিবেশনের আলোচনার বিষয়বস্তু :
দুটি সান্ধ্যকালীন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফতোয়া বিষয়ক আলোচনার জন্য।
এর মধ্যে আলোচিত বিষয়গুলো ছিল :-
ব্যভিচারের ফলে জন্ম নেওয়া কন্যার জন্য মাহরাম সম্পর্ক প্রমাণ, বংশধারা প্রমাণ, ন্যায়সংগত কারণের ভিত্তিতে ১২০ দিনের আগে গর্ভপাতের বৈধতা, চক্ষু সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ভরাট, আমাজন কোম্পানির সাথে পণ্য পরিবহনের কাজ, গর্ভপাতের ক্ষতিপূরণ, সুদভিত্তিক ব্যাংকে কাজ করা, নিকাব পরিধান, কবরস্থানে মৃতদেহ দ্রুত পচানোর জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার, মস্তিষ্কের মৃত্যু নিয়ে ইসলামিক বিধান, ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকে কাজের বৈধতা এবং যেসব দেশে দুপুর ২টায় সূর্য অস্ত যায়, সেখানে মাগরিবের পর জুমা নামাজ আদায় করা বৈধ কি না।
যখনই কাউন্সিলের কাছে উপস্থাপিত প্রশ্নগুলোর মধ্যে থেকে কোনো সদস্য একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন, তা আর্থিক, চিকিৎসা বিষয়ক বা আধুনিক কোনো বিষয় সম্পর্কিত হোক, তখন সদস্যদের মধ্যে মুক্ত আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। এই আলোচনা পরস্পরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসার পরিবেশে পরিচালিত হয়। প্রত্যেকের মতামত ও উপস্থাপিত প্রমাণ মনোযোগ সহকারে শোনা হয় এবং আলোচনা এমনভাবে এগিয়ে চলে যাতে সর্বসম্মত বা প্রায় সর্বসম্মত একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।
এই পদ্ধতিটি আধুনিক সমস্যাগুলো সমষ্টিগত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে মোকাবিলার একটি চমৎকার উদাহরণ। এটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অভিজ্ঞতা ও মত বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করে এবং সদস্যদের মধ্যে যৌথ দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। এর ফলে কাউন্সিল কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়ে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফতোয়া কাউন্সিলগুলো এই অসাধারণ মডেলটি অনুসরণ করতে পারে। এটি বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক ন্যায়বিচার অর্জনে ভূমিকা রাখে এবং ইসলামী মূল্যবোধের নির্দেশিত শূরার চেতনা প্রদর্শন করে। এর ফলে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো আরও শক্তিশালী হয় এবং মানুষের বাস্তব প্রয়োজন ও সমস্যার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে।
|| শায়খ হুসেইন হালাওয়ার সঙ্গে লিঙ্গ নির্ধারণের ওপর একটি আলোচনা :
রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার গ্রহণের পর, আমি শায়খ হুসেইন হালাওয়ার সঙ্গে আমার কক্ষে ফিরে আসি। সেখানে গর্ভধারণে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়। আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করি, যেখানে আমি উল্লেখ করি যে সাধারণ মানুষের জন্য লিঙ্গ নির্ধারণের অনুমতি দেওয়া হলে তা লিঙ্গ বৈষম্যের সমস্যাকে আরও গভীর করতে পারে। এর ফলে নারীদের অবমাননা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সমাজে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে।
আমি ভারতীয় উদাহরণ তুলে ধরি, যেখানে অনেক মানুষ কন্যা ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের গর্ভপাত করে থাকেন। এর পেছনে রয়েছে সেই সাংস্কৃতিক বিশ্বাস যা ছেলেদের কন্যার তুলনায় বেশি প্রাধান্য দেয়। এই প্রবণতা লিঙ্গ সমতার অভাবের একটি গভীর সমস্যা প্রকাশ করে এবং তা সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
শায়খ হুসেইন বিচক্ষণতা ও আবেগপূর্ণভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, তিনি ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি পছন্দ করেন এবং সমাজে তাদের মহান ভূমিকার প্রতি তার বিশেষ সম্মান রয়েছে। আমি হাসি দিয়ে বলি, “আপনি বিশ্বের সেই অল্প সংখ্যক মানুষদের একজন, যারা বিষয়গুলোকে এমন ন্যায় ও ভারসাম্যের দৃষ্টিতে দেখেন।”
|| উপসংহার :
এই আলোচনা একটি জটিল সামাজিক সমস্যার উপর গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন ছিল। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ নৈতিকতা ও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা পারস্পরিক সম্মান ও প্রশংসার মাধ্যমে একটি নির্মল আলোচনার রূপ নিয়েছে।