AkramNadwi

তাসাউফের পাঠ্যক্রম

https://t.me/DrAkramNadwi/6236

بسم الله الرحمن الرحيم.

|| প্রশ্ন :

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
শ্রদ্ধেয় জনাব ড. মুহাম্মদ আকরম নাদভী (হাফিযাহুল্লাহু ওয়া-রা’আহ)—
আপনার খেদমতে একটি প্রশ্ন পেশ করছি। প্রশ্নটি হলো, যদি তাসাউফের জন্য একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হয় এবং খানকাহগুলোতে তা পড়ানো হয়, তাহলে কোন কোন কিতাব নির্বাচন করা ও পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উত্তম হবে?

= জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
আপনার ভাই:
নূরুর রহমান উসমানি
শাইখুল হাদীস, জামিয়া ইমাম আবু হানিফা রহ.,
ও নাজিমে তালিমাত, জামিয়া দারুল উলুম, খোস্ত, আফগানিস্তান।

|| উত্তর :

আলহামদুলিল্লাহ। ছালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রাসূল সা., তাঁর পরিবার, সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর অনুসারীদের প্রতি।

তাসাউফ—যদিও মূলত এটি জুহদ, ইখলাস, তাকওয়া ও ইহসানেরই নাম—তবুও ইতিহাসের দীর্ঘ সফরে এর পরিধিতে বহু অগ্রহণযোগ্য কথা, কুসংস্কার এবং আধ্যাত্মিক বিচ্যুতি এসে ঢুকে পড়েছে। বহু চিন্তা ও কাজ, যা না কুরআন থেকে নেওয়া, না সুন্নাহ থেকে, তা তাসাউফের নামে চালু হয়ে গেছে।

তাই বর্তমান যুগে তাসাউফের একটি পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি—এমন একটি পাঠ্যক্রম, যা গবেষণা, পরিশুদ্ধি এবং আত্মশুদ্ধির মূল রূহকে জীবন্ত করে, এবং একজন সালিককে কিতাব ও সুন্নাহর ভিত্তিতে আল্লাহর পথে ও মারেফাতের পর্যায়ে উন্নীত করতে সহায়তা করে।

এই পাঠ্যক্রমে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত :

১. কুরআন ও সুন্নাহ : তাসাউফের প্রাথমিক ভিত্তি :

তাসাউফ যদি শরিয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে তা কেবল কোনো আবেগময় অবস্থা বা বিভ্রান্তি হয়ে পড়ে। তাই তাসাউফের প্রতিটি পদক্ষেপ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে হতে হবে। এই উদ্দেশ্যে :

কুরআন মাজিদের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির অন্তর্ভুক্ত থাকা উচিত।

মুওত্তা ইমাম মালিক: এই গ্রন্থটি মৌলিক সুন্নতসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করে।

রিয়াদুস সালিহীন (ইমাম নববী রহ. ): হাদিসের এই বিশাল ভাণ্ডার আত্মশুদ্ধির পথে যাত্রাকারীর হৃদয় ও কর্মকে পরিশুদ্ধ করে এবং আধ্যাত্মিক পথে শরয়ী দিকনির্দেশনা দেয়।

২. তাসাউফের মৌলিক শিক্ষা: পরিভাষা ও পর্যায়সমূহ

তাসাওউফ শুধুমাত্র কোনো আবেগ বা মুহূর্তের নাম নয়, বরং এটি একটি পরিপক্ব চিন্তন ও বাস্তবতার ধারাবাহিক ব্যবস্থা, যেখানে সালিককে (আত্মশুদ্ধির পথে যাত্রাকারীকে) বিভিন্ন “মাকাম” ও “আহওয়াল”-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। এগুলোর সঠিক বোধগম্যতার জন্য নিম্নলিখিত কিতাবগুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত:

রিসালাহ কুশায়রিয়া (ইমাম কুশায়রি র.): তাসাউফের পরিভাষা, মাকাম, আহওয়াল এবং আদবের মৌলিক উৎস।

ইহইয়া উলুমুদ্দিন (ইমাম গাযালী রহ .) – নির্বাচিত অধ্যায়: বিশেষ করে নিয়ত, ইখলাস, তাওয়াক্কুল, জুহদ ও আত্ম-সমালোচনার (মুহাসাবা) অধ্যায়গুলো।

আওয়ারিফুল মা’আরিফ (শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী রহ.): খানকাহের আদব, আত্মিক তরবিয়ত এবং বাস্তবিক তাসাওউফের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।

কাশফুল মাহজুব (আলী হুজভিরী রহ.): ফারসিতে লেখা প্রথম দিককার ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাসাওউফ-গ্রন্থ।

মসনবী মানভী (মাওলানা রুমি রহ.) – নির্বাচিত অংশ: প্রকৃত প্রেম, আত্মশুদ্ধি এবং আত্মিক উপাখ্যানের মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী হিকমত।

৩. সীরাতে নবী ﷺ: পূর্ণাঙ্গ আদর্শের আলোকে

তাসাউফে নবী করিম ﷺ -এর সীরাহ হলো চরিত্র, জুহদ, তাকওয়া ও উত্তম আমলের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। একজন সালিকের উচিত তাঁর সীরাহ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখা:

যাদুল মা’আদ (ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ.) : নবীজীর বাস্তব জীবন, ইবাদত, লেনদেন এবং জুহদের পূর্ণ চিত্র।

সীরাতুন নবী সা. (আল্লামা শিবলী নোমানী রহ.) – প্রথম দুই খণ্ড: চিন্তাশীল ও সাহিত্যিক ধাঁচে রচিত সীরাত।

সীরাতে ইবনে হিশাম: প্রাচীনতম সীরাতের অন্যতম উৎস, যেখানে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ও প্রামাণিক বর্ণনা বজায় রাখা হয়েছে।

৪. সাহাবায়ে কেরাম ও তাসাওউফের বুযুর্গদের জীবনী

আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার বাস্তব নমুনা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং পরবর্তীকালের কামেল অলিয়ার জীবনে পাওয়া যায়। তাদের বর্ণনা ছাড়া তাসাউফের শিক্ষা অসম্পূর্ণ:

হিলইয়াতুল আওলিয়া (আবু নুয়াইম ইসপাহানী রহ.): আওলিয়া ও জাহিদদের ঘটনাবলির এক অমূল্য ভাণ্ডার।

সিয়ারু আ’লামিন নুবালা (ইমাম যাহাবী র.) – নির্বাচিত অধ্যায়: সাহাবা, ইমাম, ফকীহ, সুফি ও মুহাদ্দিসদের জীবনী।

৫. তাসাউফের ইতিহাস ও সিলসিলাগুলোর পরিচিতি

তাসাওউফ কেবল একটি তাত্ত্বিক ধারণা নয়; এর একটি সুসংহত জ্ঞানগত ও আধ্যাত্মিক ইতিহাস রয়েছে। তাসাউফের সিলসিলা, শিক্ষা ও ব্যক্তিত্বসমূহের অধ্যয়ন এই পাঠ্যক্রমের অপরিহার্য অংশ:

খাজিনাতুল আসফিয়া (মুফতী গুলাম সারওয়ার লাহোরী রহ.): তাসাউফের সিলসিলা, বুযুর্গ, এবং আত্মিক ঐতিহ্যের বিস্তারিত পর্যালোচনা।

৬. সমালোচনামূলক অধ্যয়ন: ভারসাম্য ও আত্ম-পর্যালোচনা

তাসাউফের নামে যে বাড়াবাড়ি ও বিভ্রান্তি সংঘটিত হয়েছে, তা থেকে সজাগ করা এবং সরলমনা আত্মশুদ্ধির পথে যাত্রাকারীকে বিদআত, অতিরঞ্জন ও ভুল ধ্যানধারণা থেকে বাঁচানো অপরিহার্য:

তালবিসে ইবলীস (ইমাম ইবনুল জাওযী রহ.): দ্বীনের নামে প্রচলিত বিদআত এবং তাসাওউফে প্রবেশ করা বিকৃতি ও বিভ্রান্তির নিখুঁত বিশ্লেষণ।

সাইদুল খাতির (ইবনুল জাওযী রহ.): এক ব্যথিত আলিমের অন্তরঙ্গ সংলাপ, আত্মশুদ্ধি ও চিন্তামূলক আত্মসমালোচনার দর্পণ।

আল্লাহ আমাদের সকলকে হিদায়াত দান করুন এবং প্রকৃত তাসাউফের পথে অটল রাখুন। আমিন।

তাসাউফের এই প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য কেবল তথ্য প্রদান নয়, বরং এমন একটি চিন্তাশীল ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ গঠন করা, যেখানে জ্ঞান, আমল, মহব্বত ও ইখলাসের সুশোভন সেচ হবে। এই পাঠ্যক্রম থেকে এমন মানুষ গড়ে উঠবে, যারা শুধু নিজেরাই আত্মশুদ্ধির পথে চলবে না, বরং অন্যদেরও হকের পথে আহ্বান করবে।

প্রয়োজন এ কথা গভীরভাবে অনুধাবন করার যে—এই পাঠ্যক্রম যেন গবেষণামূলক, শিক্ষামূলক ও বাস্তবিক রূপে গঠিত হয়, এবং খানকাহগুলোতে একে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

والله ولي التوفيق، وهو الهادي إلى سواء السبيل
আল্লাহই তাওফিকদাতা, এবং তিনিই সরল পথের দিকে পথনির্দেশক।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *