https://t.me/DrAkramNadwi/5695
بسم الله الرحمن الرحيم.
❝
প্রশ্ন: প্রিয় ভাই, মাওলানা সালমান বজনূরী, নাদওয়াতুল উলামার শিক্ষক, তার এক বন্ধুর পাঠানো বার্তাটি শেয়ার করেছেন:
“মুহাদ্দিসে জালিল, জ্ঞানীদের প্রিয় সাথী, এবং সত্যের পথে সঠিক পথনির্দেশক!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
ধর্মপরায়ণদের মাঝে সাধারণভাবে প্রচলিত একটি সমস্যার ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন। আশা করি, এই বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে সাওয়াব অর্জন করবেন।
‘… وَمَا انْتَقَمَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ لِنَفْسِهِ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلَّا أَنْ تُنْتَهَكَ حُرْمَةُ اللَّهِ فَيَنْتَقِمَ بِهَا لِلَّهِ’ (সহীহ বুখারি: ৬১২৬)।
প্রথম প্রশ্ন এই হাদিস এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদিস সম্পর্কে: “হুরমত বা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন” দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? দ্বিতীয় বিষয় হল, বাবা-মা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের এবং মাদ্রাসার শিক্ষকরা বড় শিক্ষার্থীদের নামাজে অবহেলা বা অন্যান্য ফরজ পালনে গাফলতির বিষয়টিকে ‘হুরমত লঙ্ঘন’ ধরে নিয়ে শাস্তি দেওয়া কি সঠিক হবে?
আপনার টেলিগ্রাম চ্যানেলে ২২ জুন ২০২০-এ প্রকাশিত
“واضربوهم عليها وهم ابناء عشر”
(অঅর্থাৎ- “এবং দশ বছর হলে তার (নামাযের) উপর তাদেরকে প্রহার কর।”)
হাদিস সম্পর্কিত প্রবন্ধের আলোকে নামাজ শিক্ষা নিঃসন্দেহে ইসলামের মূল রীতি। তবে নামাজের গাফলতিতে শাস্তি প্রদানের বিষয়টি এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। এখন প্রশ্ন হলো, বাবা-মায়েরা সাধারণত তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের এবং শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য এই হাদিসের ভিত্তিতে সংশোধনী এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে, এই ক্ষেত্রে বাবা-মা এবং শিক্ষকদের জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক পদ্ধতি কী হবে? এবং ইসলামের রীতিনীতির আলোকে তাদের কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?
:: আপনাদের প্রিয় ভাই: মুহাম্মদ ইয়াহইয়া খান নদভী
|| উত্তর :
আপনার প্রশ্নের গুরুত্ব ও সবার উপকারের কথা মাথায় রেখে উত্তরটি কিছুটা বিস্তারিতভাবে দেওয়া হবে, যাতে শিক্ষা ও সংশোধনের বিষয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা স্পষ্ট হয় এবং সংশ্লিষ্ট সন্দেহসমূহ দূর হয়ে যায়। উত্তরটি সহজবোধ্য করার জন্য তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. শিক্ষার মৌলিক নীতি,
২. শিক্ষার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ,
৩. বাবা-মা ও শিক্ষকদের জন্য সঠিক পদ্ধতি।
|| শিক্ষার মৌলিক নীতি :
আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে সৎ এবং অসৎ উভয় প্রবৃত্তি স্থাপন করেছেন:
وَ هَدَیۡنٰهُ النَّجۡدَیۡنِ.
“আর আমি তাকে (পাপ ও পুণ্যের) দু’টো পথ দেখিয়েছি।”
(সুরা আল-বালাদ, আয়াত: ১০)।
এর পেছনের উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষা, যার জন্য মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে:
وَ نَبۡلُوۡكُمۡ بِالشَّرِّ وَ الۡخَیۡرِ فِتۡنَۃً ؕ وَ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ.
“আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।”
(সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫)।
এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যাবে কে ভালো আর কে মন্দ ?
আল্লাহ আমাদের রব এবং তিনি আমাদের প্রতি অসীম দয়ালু। তাঁর এই দয়ার দুটি অংশ: প্রেম ও উপকার। অর্থাৎ তিনি আমাদের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা রাখেন এবং আমাদের কল্যাণে কাজ করেন। কোরআনে এই দয়ার বিষয়টি ‘রহমান’ ও ‘রহিম’ শব্দের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। এই দয়ার কারণেই তিনি আমাদের সুস্থ প্রকৃতি দান করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি।
এই প্রকৃতিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য তিনি আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আমরা জ্ঞান লাভ করি। ইন্দ্রিয়গুলোকে আবেগ এবং জিন-মানুষের শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি আমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন। বুদ্ধি তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করে। যেহেতু বুদ্ধি মানুষের মধ্যে থাকে, তাই এটি কখনো দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা বুদ্ধির রক্ষার জন্য ওহি (আলোর দিশা) প্রেরণ করেছেন এবং নবী-রাসুলদের পাঠিয়েছেন, যারা নিজেদের জীবন ও শিক্ষা দিয়ে সঠিক পথে চলা সহজ করে দেন।
এই সবকিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে মানুষ চিন্তা-ভাবনা করে সঠিক পথ বেছে নিতে পারে। মানুষকে জোর করে সঠিক পথে চালানোর নির্দেশ আল্লাহ দেননি; বরং তিনি তাদের ভালো-মন্দের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন:
فَمَنۡ شَآءَ فَلۡیُؤۡمِنۡ وَّ مَنۡ شَآءَ فَلۡیَكۡفُرۡ.
“সুতরাং যে ইচ্ছা করে সে যেন ঈমান আনে এবং যে ইচ্ছা করে সে যেন কুফরী করে।”
(সুরা কাহফ, আয়াত: ২৯)।
এতে স্পষ্ট হয় যে ইচ্ছা ও বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়। ইচ্ছা জ্ঞানের উপর নির্ভর করে, আর সঠিক জ্ঞানের ভিত্তি হলো সঠিক প্রকৃতি ও সুস্থ বুদ্ধি।
যেহেতু মানুষ ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন, তাই তারা কখনো ভালোকে বেছে নেবে, কখনো মন্দকে। আল্লাহ তায়ালা মন্দ কাজ করার ক্ষমতা মানুষ থেকে কেড়ে নেননি এবং কোনো মানুষকেও এই অধিকার দেননি যে অন্যদের মন্দ কাজ করার অধিকার কেড়ে নেবে। অর্থাৎ ভুল করা মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।
যেহেতু আল্লাহ নিজেই মানুষের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখান এবং তাদের ইচ্ছাশক্তি ছিনিয়ে নেন না, তাই অন্য কেউ এই বিষয়ে সীমা লঙ্ঘনের অনুমতি পাবে না। এই বিষয়ে নবীদের আদর্শই সর্বোত্তম পথ, যা পরবর্তী অংশে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের শুধুমাত্র ভালো-মন্দের শিক্ষা ও দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু কাউকে বাধ্য করার নয়।
|| নবীজির আদর্শ :
যে উচ্চ মর্যাদায় নবীজিরা অধিষ্ঠিত হন, সেখানে দুষ্ট লোকদের সহ্য করা সহজ হয় না। এজন্য তাদের বিনয়, ধৈর্য এবং উদারতার উচ্চ নৈতিক গুণাবলিতে সজ্জিত করা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিয়েছেন:
وَ اِنَّكَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ.
“তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে সমুন্নত।”
(সূরা আল-ক্বালাম, আয়াত ৪)।
আরও নির্দেশনা দিয়েছেন:
خُذِ الۡعَفۡوَ وَ اۡمُرۡ بِالۡعُرۡفِ وَ اَعۡرِضۡ عَنِ الۡجٰهِلِیۡنَ.
“ক্ষমা গ্রহণ কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অজ্ঞদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।”
(সূরা আরাফ, আয়াত ১৯৯)।
এই মহান চরিত্রের ফলস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ ﷺ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সময় কাউকে প্রহার করেননি। সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য হাদিসে এসেছে:
“আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ কখনো কোনো কিছুকে নিজ হাতে আঘাত করেননি, না কোনো নারীকে, না কোনো চাকরকে।”
মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহ-তে উল্লেখ আছে:
“কাসিম বলেছেন, লোকেরা নারীদের মারধর করতে নিষেধ করেছিল এবং বলা হয়েছিল, তোমাদের উত্তমরা কখনো প্রহার করেন না। তিনি (কাসিম) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ ছিলেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং তিনি কাউকে প্রহার করতেন না।”
এমনকি, হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ শিশুদেরও ধমক দিতেন না। যদি কেউ কোনো কাজ করতে ব্যর্থ হতো, তিনি জিজ্ঞেস করতেন না যে, কেন সেই কাজটি সম্পন্ন হয়নি।
এসব ছিল তাঁর সাধারণ নীতি। তবে দুইটি ক্ষেত্র ছিল যেখানে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে:
1. যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা: জিহাদে যুদ্ধের নির্দেশ রয়েছে, এবং এই সময়ে তিনি এবং তাঁর সাহাবারা সেই আদেশ যথাযথভাবে পালন করতেন। উপরের উল্লেখিত হাদিসে এর ব্যাখ্যা রয়েছে: “তবে তিনি আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হলে ভিন্ন কথা।”
2. আল্লাহর বিধান কার্যকর করা: চুরি বা ব্যভিচারের শাস্তি দেওয়ার সময়। এর উল্লেখ রয়েছে আপনার উল্লিখিত হাদিসে: “কেবল যখন আল্লাহর কোনো নিষিদ্ধ কাজ লঙ্ঘন করা হতো, তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন।”
এই ব্যতিক্রমগুলো শুধুমাত্র শাসক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য প্রযোজ্য। সাধারণ শিক্ষক, দাঈ বা অভিভাবকদের জন্য নয়।
—
|| অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য সঠিক পদ্ধতি :
অভিভাবক ও শিক্ষকরা নিজেরাই সংশোধনের প্রয়োজনীয়তায় রয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের সংশোধন ছাড়া অন্যকে সংশোধন করতে যাবে, সে শুধু অরাজকতা সৃষ্টি করবে। সংশোধন একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। এর দুটি মূলভিত্তি রয়েছে:
1. সংশোধনকারী এমন যোগ্যতা রাখবেন, যাতে তিনি যুক্তিসংগতভাবে মনকে প্রভাবিত করতে পারেন এবং ভালো-মন্দকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেন।
2. সংশোধনকারী নিজে উত্তম চরিত্রের উদাহরণ হবেন।
অভিভাবক, শিক্ষক এবং দাঈদের উত্তম চরিত্র ধারণ করতে হবে, ধৈর্যের শক্তি অর্জন করতে হবে এবং সহিষ্ণুতা ও উদারতায় নিজেদের সজ্জিত করতে হবে। তাদের অধীনস্থদের সাথে নম্র ব্যবহার করতে হবে। হাদিসে আছে, “আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে কোমলতাকে পছন্দ করেন।”
যারা শিক্ষা ও সংশোধনের কাজ করছেন, তাদের অবশ্যই নৈতিক হওয়া উচিত, গীবত ও মিথ্যা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সর্বদা নম্রতা, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে।
যে ব্যক্তি নিজেই সংশোধিত নয়, তাকে কোনোভাবেই শিক্ষক বা প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা উচিত নয়। খারাপ চরিত্রের লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শিশুদের নেকড়ের হাতে তুলে দেওয়ার মতো। আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিণত ও অশিক্ষিত আলেম এবং মুফতির আধিক্য। তাদের নিকট না রয়েছে উত্তম চরিত্র, না রয়েছে ভালো-মন্দকে যুক্তিসংগতভাবে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা। ফলে তারা অন্যকে প্রহার করে বা কষ্ট দিয়ে নিজের কর্তব্য শেষ করতে চায়। যেখানে প্রহার করা সম্ভব নয়, সেখানে তারা বিভ্রান্তি, কাফের ঘোষণা বা অন্যদেরকে ফাসেক বলে আখ্যায়িত করে। এই অশোভন লোকেরা দ্বীনের যে ক্ষতি করেছে, তা সম্ভবত অন্য কোনো গোষ্ঠী করেনি।
আল্লাহ আমাদের উত্তম চরিত্রে সজ্জিত করুন।
——-
> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
> অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।