https://t.me/DrAkramNadwi/5780
بسم الله الرحمن الرحيم.
আমাদের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী (নামের উল্লেখ সচেতনভাবে এড়ানো হয়েছে) একজন “মুফতি-ই-আসর,” এবং এই পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে যেন এক প্রহরী। তাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থেকে মানুষ এবং জিন কেউই নিরাপদ নয়। তাদের দেখলে শরীরে এমন এক শীতল স্রোত বয়ে যায়, যা একসময় সৌদি মুতাওয়ার (ধর্মীয় পুলিশ) সামনে দাঁড়ালে হতো। তাদের যুক্তি সবসময় কোনো প্রখ্যাত বুজুর্গের বাণী বা কোনো প্রতিষ্ঠানের ফতোয়ার ওপর ভিত্তি করে থাকে। যদি কখনো কোনো হাদিস উল্লেখ করেন, তবে তা অবশ্যই হবে মাওজু (বানোয়াট), ওয়াহী (দুর্বল), মুনকার (অগ্রহণযোগ্য), বা শাজ (বিচ্ছিন্ন)। সহীহ হাদিস তাদের কাছে বিরল, আর কুরআন তো আরও দূরের বিষয়; কারণ এটি একটি কিতাব যা কেবল তারাবির নামাজে পাঠ করা হয়।
গতকাল আমার মতো অনেক মুসলিমের আনন্দের সীমা ছিল না, যখন মুফতি সাহেব তাদের বক্তব্য সমর্থনে সহীহাইন থেকে একটি বিখ্যাত হাদিসের উদাহরণ দিলেন। এরপর আমাদের আশা হতে শুরু করল যে একদিন মুফতি সাহেব আল্লাহর কিতাবকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
এই উদাহরণে আনন্দ উপভোগ করতে তখনো আমরা পুরোপুরি সক্ষম হইনি, এরই মধ্যে মুফতি সাহেব আমাদের কাছে দাবি করলেন যে আমরা এখন তাদের কথা মেনে নেব এবং আমাদের পূর্বের সমস্ত ধারণা থেকে আন্তরিকভাবে তওবা করব। আমরা বারবার অনুরোধ করলাম, “মুফতি সাহেব, আপনি একটি প্রবন্ধ লিখে আমাদের ব্যাখ্যা করুন যে এই হাদিস কিভাবে আপনার কথার সমর্থন করে? এবং কীভাবে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে?” এরপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন, এবং আমরা তাকে আর স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করিনি, কারণ আমাদের আশঙ্কা ছিল যে কোনো একদিন তিনি আমাদের “মুনকারে হাদিস” উপাধিতে ভূষিত করবেন।
এই ঘটনা বারবার ঘটে থাকে। আজকেই আমার এক আন্তরিক বন্ধু তাদের একটি দাবির সমর্থনে জিবরাইলের হাদিসের উদাহরণ দিলেন। আমি বললাম, “এই হাদিস আপনার বক্তব্যকে কিভাবে প্রমাণ করে?” তিনি বললেন, “এসব ব্যাখ্যা হাদিসের শারহগুলোতে আছে, এবং এটাই জুমহুরের বক্তব্য।” বহুবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তিনি একই উত্তর দিতে থাকলেন এবং কোনো ব্যাখ্যা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেন।
এই ঘটনা বিরল নয়, বরং বহু আলিম এবং মুফতিরা একই পথে গর্বের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছেন। এই শ্রেণির ব্যক্তিরা কোনো বাণী, পত্র, ফতোয়া, হাদিস অথবা কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “আমাদের ওপর কেবল স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দেওয়া দায়িত্ব।” তারা কখনো ভাবেন না যে একক শব্দ বা অসম্পূর্ণ বাক্যকে বাক্য বলা যায় না। অগোছালো বাক্যকে কারো মুখের ওপর ছুড়ে দেওয়া প্রবন্ধের কাজ হতে পারে না।
তাদের আবার অভিযোগ থাকে যে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণি অমুক অমুক লেখকের বই কেন পড়ে? তারা তো পথভ্রষ্ট হচ্ছে! আমাদের দায়িত্ব হলো ফতোয়া এবং বিতর্কের লাঠি দিয়ে তাদের আমাদের পথের অনুসারী বানানো।
যদি আপনি চারজন বন্ধু একসঙ্গে থাকেন এবং আপনাদের কাছে কিছু অতিথি আসে, তখন আপনাদের চারজনের সিদ্ধান্ত হলো ভালো আপ্যায়ন করা। একজন বাজার থেকে একটি মোটা মুরগি নিয়ে আসলেন, আরেকজন বড় একটি মাছ কিনলেন, তৃতীয়জন বিরিয়ানি তৈরির উপকরণ (ছাগলের মাংস, চাল ইত্যাদি) কিনলেন, এবং চতুর্থজন টাটকা সবজি নিয়ে সেটিকে তেল, পেঁয়াজ এবং মশলায় মৃদু আঁচে ভেজে নিলেন। যখন সেটি সুস্বাদু হয়ে উঠল এবং সেখান থেকে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বের হতে থাকল, তখন সেটি চুলা থেকে নামিয়ে আনলেন।
অতিথিদের আসার পর, প্রথম বন্ধু জীবন্ত মুরগিটিকে ডাইনিং রুমের একটি কোণায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। দ্বিতীয়জন একটি পানিভর্তি পাত্রে মাছ রেখে দিলেন, আর তা সাঁতার কাটতে শুরু করল। তৃতীয়জন বিরিয়ানির সব উপকরণ মেঝেতে ছড়িয়ে দিলেন। চতুর্থজন সুন্দর ও সুস্বাদু সবজিকে একটি চমৎকার থালায় সাজিয়ে রাখলেন, সবার সামনে ডাইনিং টেবিলে প্লেটগুলো রাখলেন, টাটকা রুটি একটি ঝুড়িতে গুছিয়ে দিলেন, এবং সবার সামনে গ্লাসে পানি রাখলেন।
অতিথিরা খুবই আনন্দিত হলেন। তারা আনন্দ নিয়ে সবজি খেলেন, খাবারের প্রশংসা করলেন এবং এটি ভালোভাবে পরিবেশন করার প্রশংসা করলেন। অতিথিরা যখন চলে গেলেন, তখন প্রথম বন্ধু অভিযোগ করলেন, “কতটা রুচিহীন এই মানুষগুলো, আমার মুরগির দিকে একবারও তাকায়নি।” দ্বিতীয়জন রাগ করে বললেন, “এমন নির্লজ্জ অতিথিরা কোথা থেকে আসে? মাছের চেয়ে ভালো খাবার আর কী হতে পারে?” তৃতীয়জন ঘৃণাভরা কণ্ঠে বললেন, “বিরিয়ানি হলো খাবারের সেরা রাজা, আর এই বোকা মানুষগুলো বিরিয়ানি ছেড়ে সবজির দিকে ঝুঁকে পড়ল।”
এরপর এই তিনজন বন্ধু চতুর্থ বন্ধুর বিরুদ্ধে হয়ে গেলেন এবং তার ওপর দোষ চাপালেন যে তিনি কোনো “ভারতীয় দর্শনের” দ্বারা প্রভাবিত। তিনি মাছ বা মাংস খান না এবং অতিথিদেরও মাছ-মাংস খাওয়ান না। তারা বললেন, “মনে হচ্ছে তিনি অতিথিদের ওপর কোনো জাদু করেছেন, যাতে তারা মুরগি, মাছ, ও বিরিয়ানির দিকে একবারও তাকায়নি।” এই কথা বলে তারা তিনজন মিলে তাকে
তাদের ঘর থেকে বের করে দিলেন এবং তাকে ও সমস্ত অতিথিদের একটি “অজানা ভ্রান্ত ফেরকার” অনুসারী বলে রায় দিলেন।
তিনজন বন্ধু তাদের চতুর্থ বন্ধু এবং ওই অতিথিদের খণ্ডনের জন্য দশটি প্রবন্ধ রচনা করল। তারা জনসমক্ষে বিতর্কের আয়োজন করল এবং তাতে ওই বন্ধুকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করল। এক বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাদের বলল, “আপনারা খণ্ডনমূলক লেখা এবং বিতর্ক করার পরিবর্তে যদি নিজেদের খাবার ভালোভাবে রান্না করে পরিবেশন করেন, তাহলে দুনিয়া আপনারাও খেয়ে উপভোগ করবে।” তারা সাথে সাথে বলল, “তুমি কি মনে কর যে আমাদের পূর্বপুরুষরা রান্না করতে জানতেন না? তাহলে তাদের টেবিলগুলোতে এত মানুষ কীভাবে আসত? মনে হচ্ছে তুমি নিরামিষভোজীদের দলের একজন। এখন আমরা তোমার বিরুদ্ধেও দশটি বই লিখব এবং তোমাকে জনসমক্ষে বিতর্কে লজ্জাজনক পরাজয়ের স্বাদ দিব।”
কে না জানে যে একজন ভালো অতিথিপতির দায়িত্ব হলো, মুরগি জবাই করা, মাংসের টুকরো করা, তারপর সেটিকে ভালোভাবে রান্না করা। একইভাবে মাছ ধোয়া, তার দুর্গন্ধ দূর করা, তেল ও মশলার সাথে সেটি রান্না করা, বিরিয়ানির উপকরণ সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করে সঠিক নিয়মে বিরিয়ানি প্রস্তুত করা, তারপর এই নানাবিধ খাবারকে সুশৃঙ্খলভাবে ডাইনিং টেবিলে সাজানো।
ঠিক তেমনই একজন ভালো আলেমের দায়িত্ব হলো, যে বিষয়ে লিখতে চান, সেটি সম্পর্কে অধ্যয়ন করা, নোট নেওয়া, তারপর সেই তথ্যগুলোকে যৌক্তিক ক্রমানুসারে সাজানো, প্রমাণ উপস্থাপন করা, প্রমাণ এবং প্রমাণিত বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা, প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দেওয়া, এবং সমস্ত কথা এমন ভাষায় উপস্থাপন করা যা শ্রোতা বুঝতে পারে এবং তার উপযোগী তুলনা ও উদাহরণ প্রদান করা।
একক শব্দকে জ্ঞান মনে করা একটি বড় প্রতারণা। তাজমহলের সৌন্দর্য তার কাঠামোয়। এই সুন্দর ভবনটি যেসব পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেগুলো এখনো বিদ্যমান। কিন্তু কোনো বোকাই কেবল পাথরগুলোকে তাজমহল বলতে পারে না। শিবলি ও সুলেমান যে উৎসগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন, সেগুলো আজ আরও উন্নত আকৃতিতে বিদ্যমান। সেগুলো আপনার গ্রন্থাগারে সাজিয়ে রাখলেই আপনি শিবলি বা সুলেমান হয়ে যাবেন না। গালিব ও ইকবাল যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, সেগুলো উর্দু অভিধানগুলোতে সংরক্ষিত আছে। সেগুলো মুখস্থ করলেই আপনি গালিব বা ইকবাল হয়ে যাবেন না।
এই দুনিয়া প্রতিযোগিতার দুনিয়া। অভিযোগ করা বন্ধ করুন, দোষারোপ থেকে তওবা করুন, অন্যদের ভ্রান্ত ঘোষণা করে মানুষকে তাদের থেকে দূরে রাখার নোংরা কাজের জন্য লজ্জিত হোন। নিজের অযোগ্যতার উপলব্ধি করুন, জ্ঞান অর্জন করুন, গবেষকদের বই পড়ুন এবং নিজের সময়ের শৈলীতে যৌক্তিক ক্রমানুসারে তথ্য উপস্থাপন করার যোগ্যতা অর্জন করুন। একদিন এই দুনিয়াও আপনাকে পড়তে শুরু করবে।
—————–
# তালীম/শিক্ষা # সমালোচনা
> মূল :
ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, যুক্তরাজ্য।
> অনুবাদ ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।