AkramNadwi

কুরবানির সময় কি মুহররম মাসের চাঁদ উঠা পর্যন্ত বৈধ? ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/3800

بسم الله الرحمن الرحيم


——————–

|| প্রশ্ন:
একজন সাহেব প্রশ্ন করেছেন: কুরবানির সময় কখন শেষ হয়? কুরবানি কি মুহররমের চাঁদ উঠা পর্যন্ত বৈধ? এবং এ ধরনের কোনো কথা কি সহীহ হাদীসে এসেছে?

|| উত্তর:
কুরবানির সময় কখন শেষ হয়—এ নিয়ে এই উম্মতের মধ্যে দুইটি মত রয়েছে:

= প্রথম মত:
কুরবানির সময় দ্বাদশ জিলহজ্জ (১২ জিলহজ্জ)-এর সূর্যাস্তের আগেই শেষ হয়ে যায়। এ মত হচ্ছে হানাফি, মালিকি ও হাম্বলি মাযহাবের। এর দলীল হল হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীস, তিনি বলেন—
“নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন দিনের পর কুরবানির গোশত খাওয়া নিষেধ করেছেন।”
(সহীহ মুসলিম, কিতাবুল আদাহি, باب بيان ما كان من النهي عن أكل…)
কুরবানি শুরু হয় ১০ জিলহজ্জে। সেই হিসাবে তিন দিন হচ্ছে—১০, ১১ ও ১২ জিলহজ্জ। অর্থাৎ মানুষ এ তিন দিনেই কুরবানি করবে এবং এই দিনগুলোতেই খাবে। পরবর্তী দিনের জন্য জমা করে রাখবে না। জমা করে রাখার এই নিষেধাজ্ঞার কারণ ছিল মদীনায় আগত গরীব-মিসকিনদের অভাব, যার পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে মুআত্তা ইমাম মালিক, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে। তবে পরে এই নিষেধাজ্ঞা রহিত হয়ে যায়।

ইমাম মালিক রহ. মুআত্তা-এ হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“তোমরা তিন দিন পর্যন্ত কুরবানি করো।”
এই বর্ণনাটি সহীহ মুসলিমেও আছে।

= দ্বিতীয় মত:
কুরবানির সময় তেরোই জিলহজ্জ (১৩ জিলহজ্জ)-এর সূর্যাস্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এটি শাফেয়ি মাযহাবের মত এবং হাম্বলি মাযহাবে এটাই একটি বক্তব্য। এর দলীল হচ্ছে মুসনাদ আহমদ-এর একটি হাদীস—
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সমস্ত ‘আয়্যামে তাশরীক’ (তাশরীকের দিনগুলো) কুরবানি করার দিন।”
‘আয়্যামে তাশরীক’ বলা হয়—১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ্জকে। কুরবানি শুরু হয় ‘ইয়াওমুন্নাহার’ অর্থাৎ ১০ জিলহজ্জে। সুতরাং এদের মতে কুরবানির মোট সময় চার দিন: ১০, ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ্জ।

এই মত গ্রহণ করেছেন—
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, হাফিয ইবনুল কাইয়্যিম এবং আল্লামা শাওকানী প্রমুখ।

যদি কেউ কোন কারণে কুরবানির নির্ধারিত দিনগুলোতে কুরবানি না করতে পারে, তাহলে হানাফিদের মতে সে কুরবানির পশু অথবা তার সমমূল্যের টাকা সদকা করে দেবে।
আরো কিছু ইমামের মতে, পরে কাযা (বদলি) নিয়তে কুরবানি করে দেবে।

মুহররম পর্যন্ত কুরবানির অনুমতি নিয়ে বর্ণিত হাদীস:
এই দুটি মতই (৩ দিন ও ৪ দিন) উম্মতের মধ্যে প্রসিদ্ধ ও অনুসৃত। তবে, ইমাম আবু দাউদ তাঁর মারাসীল-এ একটি বর্ণনা এনেছেন—
তিনি আবান আল-আত্তার-এর মাধ্যমে ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাসীর থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনু ইব্রাহীম তাইমী থেকে এবং তিনি হযরত আবু সালামাহ ও সুলাইমান ইবন ইয়াসার রহ. থেকে বর্ণনা করেন:
“তাঁদের কাছে এমন সংবাদ পৌঁছেছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘যারা দেরি করতে চায়, তাদের জন্য পুরো মাসের শেষ পর্যন্ত কুরবানি বৈধ।’”
অর্থাৎ—এই দুই তাবেয়ী বলেন: আমাদের জ্ঞানানুসারে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেরি করা লোকদের জন্য মাসের শেষ পর্যন্ত কুরবানি করার অনুমতি দিয়েছেন।

বায়হাকী-এর এক বর্ণনায় আছে—“মুহররমের চাঁদ উঠা পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছেন।”
ইমাম ইবনু হাযম (জাহিরি মাযহাব) এই মত গ্রহণ করেছেন।

তবে এই বর্ণনা নকল এবং বুদ্ধি—উভয় দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয় ।

নকল (বর্ণনা)-এর দিক থেকে এই বর্ণনার উপর আলোচনা:

= প্রথমত, এটি একটি মুরসাল হাদীস, অর্থাৎ এতে এই বিষয়টি উল্লেখ নেই যে হযরত আবু সালামা ও সুলাইমান ইবন ইয়াসার (রহ.)—এই দুই তাবেয়ী—এটি কোথা থেকে জেনেছেন। কারণ তারা নিজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি শুনেননি। এমন হাদীসকে “মুরসাল” বলা হয়, যা অধিকাংশ উলামার দৃষ্টিতে হুজ্জত (প্রমাণস্বরূপ গ্রহণযোগ্য) নয়। এমনকি যারা মুরসাল হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন তারাও সংযুক্ত সনদযুক্ত (মুততাসিল) হাদীসকে মুরসালের উপর প্রাধান্য দেন। উপরে উল্লেখিত হযরত ইবনে উমর এবং হযরত আয়েশা রাযি. এর সহীহ হাদীস এই প্রসঙ্গে বিদ্যমান, তাই তারাই অগ্রাধিকার পাবে।

= দ্বিতীয়ত, এই রেওয়ায়েতটি আবান আল-আত্তার দ্বারা ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাসীর থেকে বর্ণিত, যার সনদকে ইমাম বুখারী সহীহ মানেননি, এবং ইমাম মুসলিম এটিকে কেবল শাহেদ (সমর্থক সূত্র) ও মুতাবিয়াত (অনুরূপ বর্ণনা) হিসেবে ব্যবহার করেছেন—অর্থাৎ নির্ভরযোগ্যতা নেই।

= তৃতীয়ত, এই হাদীসের বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনু ইব্রাহীম তাইমী সুলাইমান ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন, অথচ সহীহ হাদীসের প্রধান ছয়টি কিতাব (সিহাহ সিত্তা)-এর কোনোটিতেই এই সনদে কোনো হাদীস পাওয়া যায় না।

= চতুর্থতঃ এটি বলা যায় যে, যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (কুরবানির মাংস তিন দিনের বেশি রাখার) অনুমতি দিতেন, তাহলে তা অবশ্যই বহু রাবি সাহাবী যেমন — হযরত আবূ হুরাইরা, হযরত আয়েশা, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমর, হযরত আনাস, হযরত জাবির, হযরত আবূ সাঈদ খুদরি, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমুখের থেকে বর্ণিত হতো।

= পঞ্চমত, সাহাবা, তাবেয়ীন এবং আহলুল মদীনার আমল এই বর্ণনার বিপরীত। এমনকি হযরত আবু সালামা ও সুলাইমান ইবন ইয়াসার (রহ.) এর ব্যক্তিগত আমল ও ফতোয়া-তেও এই হাদীসের সমর্থন নেই। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.) এই ধরনের একটি দুর্বল বর্ণনা মুসনাদে আহমাদে উল্লেখ করে আশ্চর্যতা প্রকাশ করেছেন। হাফিয ইবন কাসীর তাঁর তাফসীরে একে “قول غریب” (অজানা মত) বলেছেন।

|| আকল (যুক্তি)-এর দিক থেকে এই বর্ণনার উপর আলোচনা:

প্রথমত, কুরবানি হচ্ছে হজের হাদী-এর একটি বিকল্প। হাদী (কুরবানির পশু) জবাই শুরু হয় মুজদালিফা থেকে মিনায় আগমনের পর। আর মিনার দিনগুলো হল—১০, ১১ ও ১২ জিলহজ্জ, এবং কেউ যদি ১৩ তারিখ পর্যন্ত থাকে তাও বৈধ। সুতরাং, কুরবানির দিনগুলোও স্বাভাবিকভাবেই ওই সীমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এর বাইরে যাবে না।

দ্বিতীয়ত, কুরবানির দিনগুলোতে রোযা রাখা নিষিদ্ধ। এজন্য অধিকাংশ আলেমের মতে ১০ জিলহজ্জ থেকে ১৩ পর্যন্ত রোযা রাখা জায়েজ নয়। সহীহ মুসলিমে হযরত নবীশা হুযালী রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে,
“তাশরীক-এর দিনগুলো হচ্ছে—খাওয়া, পান করা এবং আল্লাহর জিকির করার দিন।”
যদি কুরবানি মুহররম পর্যন্ত বৈধ হতো, তাহলে পুরো বিশ দিন রোযা নিষিদ্ধ হয়ে যেত—যা বাস্তবসম্মত নয় এবং কেউ তা মেনে নেয় না।

তৃতীয়ত, ঈদের দিনগুলোকে দীর্ঘায়িত করায় অনেক অসুবিধা তৈরি হয়। রমজানের পরে ঈদ মাত্র ১ বা ২ দিন, আর হজের পর হাজিদের সব কার্যক্রম তাশরীক-এর দিনগুলোর মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কুরবানিকে পুরো মাসব্যাপী বৈধ করলে সমস্ত উম্মতকে দীর্ঘ ঈদ উদযাপনের দিকে ঠেলে দেওয়া হতো, যা ইসলামের সহজ-স্বাভাবিক ও যুক্তিনির্ভর প্রকৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

সারসংক্ষেপ:
সারকথা হলো—কুরবানির দিনসমূহ হয় ১২ জিলহজ্জ পর্যন্ত, অথবা ১৩ জিলহজ্জ পর্যন্ত সীমিত। এর পরে কুরবানি করার ব্যাপারে কোনো সহীহ দলীল নেই। যে হাদীস পেশ করা হয়, তা نقلاً (বর্ণনা) ও عقلاً (যুক্তি)—উভয় দিক থেকেই বিভিন্ন কারণে অকার্যকর । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইমাম আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ী, আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.)—এই চার ইমামের কেউই মুহররম পর্যন্ত কুরবানি করাকে বৈধ মনে করেননি, বরং সারা উম্মতের মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই আমল কখনও প্রচলিত হয়নি।

সুতরাং, নিরাপত্তা ও সঠিকতা এই মধ্যেই রয়েছে যে, এমন মত গ্রহণ করা হোক যার দলীল মজবুত এবং যা মুসলমানদের মধ্যে যুগে যুগে ও সব সময়ে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে।

——————–

✍ মূল : ড. আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড, ইউকে।
✍ অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা : মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *