AkramNadwi

কুরআন এবং ফিকাহের গ্রন্থসমূহ ও কালামের পার্থক্য ❞

https://t.me/DrAkramNadwi/3862

بسم الله الرحمن الرحيم.

মূল : ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভী, অক্সফোর্ড।
অনুবাদ যাচাই ও সম্পাদনা :
মাওলানা মারজান আহমদ, সিলেট, বাংলাদেশ।

ফিকহের বইগুলো সাধারণত শাখাগত বা ব্যবহারিক বিষয়সমূহের বিশদ উপাদান নিয়ে রচিত হয়, আর কালামের বইগুলো আকীদাগত আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন ফিরকা বা মতবাদের মতপার্থক্য এবং তাদের অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা করে। প্রতিটি ফকিহ এবং মুতাকাল্লিমের চেষ্টা থাকে এমনভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা যাতে একজন সাধারণ মানুষ চোখ বন্ধ করেও সেগুলো অনুসরণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন মুতাকাল্লিম এ বিষয়ে আলোচনা করবেন যে কোন আকীদাগুলো মানুষকে মুসলিম বানায়, কোন বিষয়গুলো অস্বীকার করলে সে কাফির হয়ে যায়, এবং কোন বিষয়গুলো অস্বীকার করলে সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত থেকে বেরিয়ে যায়।

একইভাবে, একজন ফকিহ প্রতিটি বিষয়কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। উদাহরণস্বরূপ, নামাজের শর্তাবলী কী? এর রুকন, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাব কী? হারাম ও মাকরূহ কী? তেমনি, হজের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত এবং মুস্তাহাবসমূহ; তালাকের বিভিন্ন প্রকার; বাতিল এবং ফাসিদ বিক্রয়ের মধ্যে পার্থক্য কী ; জাহেলিয়াতের সুদ এবং ইসলামের সুদের মধ্যে পার্থক্য কী ইত্যাদি।

এখন, আপনি যদি এই বিষয়গুলো কুরআনে খুঁজতে যান, আপনি দেখবেন কুরআনে এই বিশদ আলোচনা নেই। তাহলে কি এর মানে এই যে, ফিকহ ও কালামের বইগুলো পূর্ণাঙ্গ এবং বেশি উপকারী, আর আল্লাহর কিতাব অসম্পূর্ণ এবং কম উপকারী?

আল্লাহর কিতাব অসম্পূর্ণ নয় এবং এটি কম উপকারীও নয়। বরং এটি একটি পরিপূর্ণ কিতাব এবং এর উপযোগিতা মানুষের কল্পনার চেয়েও বহুগুণ বেশি। তবে এর থেকে কিছু খুঁজে বের করা কঠিন পরিশ্রমের বিষয়। এর জন্য বুদ্ধি ব্যবহার করতে হয়, গভীর চিন্তা করতে হয়। এই পরিশ্রমের পর এটি থেকে যে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়, তা শুধু জবান ও দেহকেই নয়, বরং মন ও হৃদয়কেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব সমন্বিত, ব্যাপক এবং গভীরতর হয়ে থাকে।

এই বাস্তবতা বোঝার আগে একটি উদাহরণ নিয়ে চিন্তা করুন। আপনি পুরান দিল্লিতে জামে মসজিদের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এবং আপনাকে ফতেহপুরি মসজিদে যেতে হবে। আপনি এই এলাকার একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে রাস্তা জিজ্ঞাসা করেন। তিনি আপনাকে জানান, সোজা যান, এরপর এইদিকে মোড় নিন, এবং তারপর অন্যদিকে মোড় নিন। তিনি আপনাকে বিস্তারিতভাবে মুখে ব্যাখ্যা করেন এবং আপনার অনুরোধে লিখেও দেন। এমনকি আপনাকে জানান যে সেখানে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে। আপনি তার দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী চলবেন এবং সহজেই নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন।

আপনি আরেকজন ব্যক্তির কাছে একই প্রশ্ন করেন। তিনি আপনাকে এলাকার একটি মানচিত্র দেন। আপনি সেই মানচিত্র মনোযোগ দিয়ে পড়েন, দিক ঠিক করেন, সব রাস্তা পরীক্ষা করেন, এবং তারপর মানচিত্রের সাহায্যে গন্তব্যে পৌঁছান। এই পদ্ধতিটি পরিশ্রমসাধ্য, কিন্তু এর সুবিধা হলো, আপনি গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হন। আপনি জানেন, সেখানে পৌঁছানোর একাধিক পথ রয়েছে। যদি একটি পথ বন্ধ থাকে, আপনি অন্যটি বেছে নেবেন। যদি ভুল দিকেও চলে যান, আপনি আবার ফিরে আসতে পারবেন। শুধু গন্তব্য নয়, পুরো এলাকাটি সম্পর্কে আপনার ভালো জ্ঞান হবে। এই অতিরিক্ত জ্ঞান সময় ও প্রচেষ্টার অপচয় নয়, বরং আপনার লক্ষ্য পূরণের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

প্রথম পদ্ধতিটি সহজ মনে হয়, তবে এর বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে। যেমন, আপনি সেই এলাকার কোনো জ্ঞান অর্জন করবেন না। যেই রাস্তা ধরতে হবে তা কোনো কারণে বন্ধ থাকলে, আপনার কোনো ধারণা থাকবে না কী করতে হবে। আপনাকে আবার অন্য কারো কাছে জানতে হবে। আপনি সবসময় অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন এবং আপনার জ্ঞান সর্বদা অসম্পূর্ণ থাকবে।

প্রথম পদ্ধতিটি ফকিহ ও মুতাকাল্লিমদের পদ্ধতি, আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি কুরআনের পদ্ধতি। কুরআন আপনাকে একটি মানচিত্র তুলে দেয়, যেখানে গন্তব্যের দিকনির্দেশনা, বিভিন্ন পথ এবং পথচিহ্নসমূহ উল্লেখ রয়েছে। সফলতার সাথে গন্তব্যে পৌঁছানো ব্যক্তিদের গুণাবলী বর্ণিত রয়েছে, পথ হারানো ব্যক্তিদের অবস্থা বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানোদের পুরস্কার এবং পথ হারানোদের শাস্তি ও বঞ্চনার বিবরণও এতে রয়েছে।

যখন আপনি কুরআনের নির্দেশনায় নামাজ পড়েন, তখন বুঝতে পারেন আপনার প্রতিপালক কীভাবে নামাজের প্রকৃত অর্থ তুলে ধরেছেন। আপনি জানতে পারেন, নামাজ হলো জিকির, খুশু, কুনুত, কিয়াম, রুকু, সিজদা। এটি কুরআন তিলাওয়াত, কেবলার দিকে মুখ করে নির্ধারিত সময়ে আদায় করা, এর জন্য অজু ও গোসল আবশ্যক, এবং পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করতে হয়। আপনি এগুলো বিস্তারিতভাবে বুঝতে পারেন। এরপর কুরআনে উল্লিখিত নবীদের নামাজ নিয়ে চিন্তা করেন। এর পরে কুরআনের এই নির্দেশনা আপনার মনে আসে যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি বিষয়ে আদর্শ। আপনি তাঁর নামাজের অধ্যয়ন করেন এবং এরপর সুন্দরভাবে নামাজ আদায় করেন।

নিঃসন্দেহে, কুরআন থেকে নামাজ শিখতে অনেক বেশি সময় লাগে। তবে এটাও সত্য যে কুরআন থেকে শেখা নামাজ একটি জীবন্ত নামাজ হয়। এতে নামাজের আত্মার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আপনার মনোযোগ কুনুত ও খুশুতে থাকবে, কারণ কুরআনে এগুলোর উপরই জোর দেওয়া হয়েছে।

কুরআনের নির্দেশনা তখনই কার্যকর এবং অর্থবহ হয় যখন এর সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত অন্যান্য বিষয় যেমন প্রকৃতি, বুদ্ধি, এবং রসুলের আদর্শ যুক্ত করা হয়। আপনাকে প্রকৃতির গভীরে পৌঁছাতে হবে, সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো বুঝে পড়তে হবে এবং রসুলের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে।

এই পরিশ্রমসাধ্য পথটি অনেকের কাছে কঠিন মনে হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো চিন্তা করা। তাই মানুষ চায় কেউ একজন তাদের জন্য চিন্তা করুক। তারা যেন চিন্তা না করেও সেই চিন্তাশীল ব্যক্তির অন্ধভাবে অনুসরণ করতে পারে। এই চিন্তাশীল বিশেষজ্ঞরা সৎকর্ম ভেবে এই কাজটি ভালোভাবে সম্পন্ন করেছেন। পথচলতি মানুষ তাদের ভুল এবং প্রশ্ন তাদের সামনে উপস্থাপন করত। এই বিশেষজ্ঞরা নতুন নতুন বিশদ তথ্য যোগ করতেন, যেন মানুষ তাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পায় এবং ভুল থেকে রক্ষা পায়। এমনকি যদি ভুল হয়ে যায়, তার সংশোধন কীভাবে হবে তাও তারা শিখিয়ে দিতেন।

এইভাবে বিশেষজ্ঞরা প্রতিটি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সময়ের সাথে সাথে সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে। প্রতিটি সম্ভাব্য বিষয়ে আলোচনা হতে থাকে। প্রতিটি খুঁটিনাটির উপর আরও বিশ্লেষণ করা হয়। এমন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে, যা শতাব্দীতে একবার হয়তো প্রয়োজন হতে পারে। বরং কিছু বিষয় এমনও রয়েছে, যা কখনোই প্রয়োজন হয় না। আপনি যদি এই বিষয়টি বুঝতে চান, তবে ফিকহের বইগুলোর মধ্যে তালাক, দাসমুক্তি, এবং মানত ও কসম সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো একবার দেখুন।

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কুরআনের পদ্ধতি অনুযায়ী নামাজ শিখেছেন, আর আমরা কুদুরি এবং নূরুল ইযাহ থেকে শিখেছি। সুতরাং নামাজ সম্পর্কে যে বিস্তারিত বিষয় সমূহ আমরা বিভিন্ন গ্রন্থাবলির মাধ্যমে জানি, সাহাবায়ে কেরাম তা (আমাদের মতো সেরকম গ্রন্থাবলির মাধ্যমে) জানতেন না । তাঁরা নামাজের শর্ত, স্তম্ভ, সুন্নত ও মুস্তাহাব, বাতিলকারী ও মাকরূহ বিষয়গুলো সম্পর্কে (আমাদের মতো বিভিন্ন গ্রন্থাবলির মাধ্যমে) জানতেন না (মানে তাঁরা সরাসরি রাসুল সা. এর কাছ থেকে নামাজ দেখে দেখে শেখার কারণে তাঁদেরকে আমাদের মতো বিভিন্ন কিতাব থেকে আলাদা করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সহকারে জানতে হয়নি)। তবে এটাও সত্য যে তাদের নামাজ এবং আমাদের নামাজের মধ্যে সেই পার্থক্য রয়েছে, যা জীবন্ত সিংহ এবং কাগজের সিংহের মধ্যে দেখা যায়।

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *